সারা বিশ্বেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকাররা অভিন্ন একটি বার্তা দিচ্ছেন, সেটা হলো ধীরস্থিরভাবে মূল্যস্ফীতির বিপক্ষে লড়াইয়ে জেতা যাবে না।
সিএনএনের এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, সম্প্রতি ব্যাংক অব ইংল্যান্ড সেই নজির স্থাপন করেছে। গত বৃহস্পতিবার যুক্তরাজ্যের কেন্দ্রীয় ব্যাংক অপ্রত্যাশিতভাবে শূন্য দশমিক ৫০ শতাংশীয় পয়েন্ট হারে নীতি সুদহার বাড়িয়েছে। এই সিদ্ধান্তের পর গভর্নর অ্যান্ড্রু বেইলি বলেছেন, এখনই নীতি সুদহার বাড়ানো না হলে উচ্চ মূল্যস্ফীতি শিগগিরই কমবে না, বরং দীর্ঘ সময় তা থেকে যাবে।
এক বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে নীতি সুদহার বৃদ্ধির কারণে বিশ্বের অনেক দেশে মূল্যস্ফীতির হার কমেছে, কিন্তু অনেক দেশেই তা এখনো লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় অন্তত ২ শতাংশ বেশি।
মূল্যস্ফীতির রাশ টানার ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হাতে সবচেয়ে বড় অস্ত্র হচ্ছে নীতি সুদহার বৃদ্ধি। কিন্তু এর ফল এক দিনেই পাওয়া যায় না। নীতি সুদহার বৃদ্ধির অন্তত ১২ মাস বা এক বছর পর তার ফল পাওয়া যায়।
যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভ জুনের মুদ্রানীতি কমিটির বৈঠকে নীতি সুদহার বৃদ্ধির ধারায় ছেদ টেনেছে। এর আগে গত বছরের মার্চ থেকে টানা ১০টি মুদ্রানীতি কমিটির বৈঠকে নীতি সুদহার বাড়িয়েছে ফেড। তবে ফেডের অনেক কর্মকর্তাই ইঙ্গিত দিয়েছেন, মুদ্রানীতি কমিটির পরবর্তী বৈঠকে আবারও সুদহার বাড়ানো হতে পারে। এ মাসে তা না বাড়ানোর কারণ হলো এই পদক্ষেপ এখনই কাজ না করলে পরিস্থিতির ওপর যেন তাদের নিয়ন্ত্রণ না হারায়, সেটা নিশ্চিত করা।
একটি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাজ খুবই সূক্ষ্ম, তাকে একধরনের ভারসাম্য বজায় রাখতে হয়। আপাতদৃষ্টে মনে হতে পারে, অর্থনীতির বিশেষ ক্ষতি না করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নীতি সুদহার বাড়াতে পারে। কিন্তু এই মুহূর্তে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বাড়তি ব্যবস্থা নেওয়া আবার মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে যথেষ্ট ব্যবস্থা না নেওয়ার শামিল।
পরিস্থিতি এত সঙিন যে ইউরোপীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট ক্রিস্টিন ল্যাগার্ড নীতি সুদহার বৃদ্ধির বিষয়কে গন্তব্যমুখী উড়ন্ত বিমানের সঙ্গে তুলনা করেছেন।
তাঁর কথায় বিষয়টি এ রকম: ‘শুরুতে বিমানকে দ্রুত বেগে ওপরে উঠতে হয়, কিন্তু কাঙ্ক্ষিত উচ্চতায় উঠে গেলে উড্ডয়ন কমিয়ে গতি বজায় রাখতে হবে বিমানটিকে। গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্য প্রয়োজনীয় উচ্চতায় উঠতে হবে বিমানকে, তার চেয়ে বেশি নয়।’
ইউরোপীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক শূন্য দশমিক ২৫ শতাংশীয় হারে নীতি সুদহার বৃদ্ধির দুই সপ্তাহ আগে ক্রিস্টিন ল্যাগার্ড বলেছেন, ‘বিমান এখনো ওপরে যাচ্ছে, গন্তব্যে পৌঁছাতে আমাদের নিচে নামতে হবে, সে জন্য যত গতি দরকার, ততটাই গতি ওঠাতে হবে।’
ইউরোপীয় ইউনিয়নের যে ২০টি দেশ ইউরো মুদ্রা ব্যবহার করে, সেসব দেশে মে মাসে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৬ দশমিক ১ শতাংশ। আগের মাসে এই হার ছিল ৭ শতাংশ।
ল্যাগার্ডের এই তুলনা ব্যাখ্যা করা যায় এভাবে: নিরাপদভাবে চলার জন্য বিমানের যে উচ্চতায় ওঠা দরকার, সেই উচ্চতায় না উঠলে বিমানে অপ্রত্যাশিত ঝাঁকুনি হতে পারে, তাতে গন্তব্যে পৌঁছানো বিপজ্জনক হয়ে উঠবে। সেই গন্তব্য হলো ২ শতাংশ মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকারদের হিমশিম খাওয়ার আরেকটি কারণ হলো অর্থনীতির কিছু কিছু খাতে নীতি সুদহার বৃদ্ধির প্রভাব না পড়া। যেমন যুক্তরাষ্ট্রের সেবার মূল্য এখনো বাড়ছে। গত মে মাসে এই বৃদ্ধির হার আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে বেশি।
উচ্চ মূল্যস্ফীতি দীর্ঘস্থায়ী হলে যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষে তা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়, বিষয়টি ঠিক তেমনও নয়। কিন্তু সে জন্য যে মূল্য চোকাতে হয়, সেটা করতে তারা রাজি কি না, সেটাই হচ্ছে মূল বিষয়।
নীতি সুদহার বাড়াতে যত দেরি করা হবে, ততই সুদহার আরও বেশি করে বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তা তৈরি হবে—অর্থনীতিবিদেরা এমনটাই মনে করেন।