ঘূর্ণিঝড় মোখার আঘাতে বিধ্বস্ত হয়েছে বাংলাদেশের সর্বদক্ষিণের উপজেলা টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপের ৩০০টির বেশি ঘরবাড়ি। ঘূর্ণিঝড়ের দুই দিন পর আজ মঙ্গলবার দুপুর ১২টা পর্যন্ত সেখানে সরকারি কোনো সহায়তা না পৌঁছানোয় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ অনেকটাই মানবেতর জীবন যাপন করছেন।
কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, ঘূর্ণিঝড় মোখার তাণ্ডবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা বঙ্গোপসাগরের বুকে আট বর্গকিলোমিটার আয়তনের দ্বীপ সেন্ট মার্টিন, তারপর শাহপরীর দ্বীপের জালিয়াপাড়া ও পার্শ্ববর্তী ক্যাম্পপাড়া।
বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ডের সর্বদক্ষিণের বিন্দুটির নাম শাহপরীর দ্বীপ। নাফ নদী ও বঙ্গোপসাগরের মোহনায় টেকনাফের সাবরাং ইউনিয়নের তিনটি ওয়ার্ড নিয়ে (৭, ৮ ও ৯ নং ওয়ার্ড) গঠিত এই শাহপরীর দ্বীপের লোকসংখ্যা প্রায় ৪২ হাজার। দ্বীপের দক্ষিণ পাড়ায় দাঁড়িয়ে বঙ্গোপসাগরের মধ্যে সেন্ট মার্টিন দ্বীপ খালি চোখে দেখা যায়।
নাফ নদীর তীরে ৯ নং ওয়ার্ডের একাংশ জালিয়াপাড়া। গতকাল সোমবার দুপুরে সেখানে গিয়ে দেখা যায়, ভাঙা ঘরগুলো এলোমেলোভাবে পড়ে আছে। কিছু ভাঙা ঘরে ত্রিপল টাঙিয়ে লোকজন মাথা গোঁজার ঠাঁই করে নিচ্ছিলেন। পরিবার নিয়ে কেউ কেউ বসে ছিলেন খোলা আকাশের নিচে।
সেন্ট মার্টিনে খোলা আকাশের নিচে হাজারো মানুষ, দুর্ভোগ
জালিয়াপাড়ার উত্তর প্রান্তে বেড়িবাঁধের ঢালুতে বিধবা মদিনা খাতুনের (৪২) ঘর। ঘূর্ণিঝড়ে তাঁর ঘরটি দুমড়েমুচড়ে যায়। তখন মদিনা দুই ছেলে নিয়ে পাশের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আশ্রয়কেন্দ্রে ছিলেন। সন্ধ্যায় ঘূর্ণিঝড় থেমে গেলে তিনি বাড়ি ফিরে দেখেন সবকিছু শেষ। মদিনা খাতুন বলেন, মাথা গোঁজার আপাতত ঠাঁই করতে একটা ত্রিপল দরকার। কিন্তু কোথাও ত্রিপল পাওয়া যাচ্ছে না। আগে ২০ ফুট দৈর্ঘ্য ও ৮ ফুট প্রস্থের একটি ত্রিপল ২৫০ টাকায় পাওয়া যেত। কিন্তু এখন কেউ কেউ পাঁচ-সাত মাইল দূরের বাজার থেকে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকায় ত্রিপল কিনে আনছেন। এই সামর্থ্য তাঁর নেই।
মদিনার প্রতিবেশী জাফর আলমের (৫৫) ত্রিপলের ছাউনির ঘরটিও ঘূর্ণিঝড়ে ভেঙে গেছে। স্ত্রী ও তিন ছেলেমেয়ে নিয়ে তিনি ঘরের কোণে বসে ছিলেন। ঘরে ছাউনি ছিল না। জাফর বলেন, সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত বাজারে খোঁজ নিয়ে একটি বাঁশ কিনতে পাওয়া যায়নি। আগে ছোট আকারের একটি বাঁশ ৪০ টাকায় পাওয়া যেত, এখন ৬০ থেকে ৭০ টাকায়ও পাওয়া যাচ্ছে না।
একই অবস্থা পাশের ক্যাম্পপাড়াতেও। ৩০ থেকে ৪০টি পরিবার খোলা আকাশের নিচে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছিল সেখানে। ক্যাম্পপাড়ার বাসিন্দা নুর মোহাম্মদ (৪৫) বলেন, এলাকাতে গৃহ নির্মাণসামগ্রীর তীব্র সংকট চলছে। বিশেষ করে বাঁশ ও ছাউনি দেওয়ার জন্য ত্রিপল পাওয়া যাচ্ছিল না।
শাহপরীর দ্বীপের ৩২০টি পরিবার পেল প্রথম আলো ট্রাস্টের ত্রাণ
ক্যাম্পপাড়ার আরও কয়েকজন জেলে বলেন, এলাকার ঘরে ঘরে খাদ্য ও সুপেয় পানির সংকট চলছে। নলকূপগুলোতে লবণ পানি আসায় সুপেয় পানি পাওয়া যাচ্ছে না। দ্রুত সময়ের মধ্যে গৃহহীন পরিবারগুলোকে মাথা গোঁজার ঠাঁই করে দেওয়া না হলে সংকট আরও বাড়বে।
জালিয়াপাড়া বাসিন্দা ও ৯ নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য আবদুস সালাম বলেন, ঘূর্ণিঝড় মোখার তাণ্ডবে জালিয়াপাড়া ও ক্যাম্পপাড়ার ৩০০টির বেশি ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। এসব ঘরবাড়ির অন্তত এক হাজার মানুষ খোলা আকাশের নিচে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন। একসময় জেলে পরিবারগুলো নাফ নদীতে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতেন। মাদক চোরাচালান ও রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ বন্ধের অজুহাতে গত সাত বছর ধরে নাফ নদীতে জেলেদের মাছ ধরা বন্ধ রাখা হয়েছে। আয়রোজগারের বিকল্প ব্যবস্থাও নাই। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের লোকজনকে দ্রুত মাথা গোঁজার ব্যবস্থা না করলে সমস্যা আরও বাড়তে পারে। অধিকাংশ পরিবারের নতুন করে ঘর তৈরির সামর্থ্য নেই।
ইউপি সদস্য আবদুস সালাম আরও বলেন, ঘূর্ণিঝড়ের পর প্রথম জালিয়াপাড়ার গৃহহীন পরিবারে খাদ্যসহায়তা দিয়েছে প্রথম আলো ট্রাস্ট। গতকাল দুপুরে জালিয়াপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে এ খাদ্যসহায়তা বিতরণ করা হয়। সেখানে তিনিও উপস্থিত ছিলেন। এর আগে ত্রাণসহায়তা নিয়ে কেউ এলাকাতে যায়নি। দুঃসময়ে প্রথম আলো ট্রাস্টের খাদ্যসহায়তা লোকজনের অনেক উপকারে এসেছে।
ঘূর্ণিঝড়ে শুধু সাবরাং ইউনিয়নে পাঁচ হাজার ঘরবাড়ি ভেঙে গেছে জানিয়ে সাবরাং ইউপি চেয়ারম্যান নুর হোসেন বলেন, এর মধ্যে অন্তত ৩ হাজার পরিবার মাথা গোঁজার ঠাঁই হারিয়েছে। চলতি মে মাসে বঙ্গোপসাগরে আরও দুই দফা নিম্নচাপ হওয়ার কথা জানিয়েছে আবহাওয়া দপ্তর। তখন ঝড়বৃষ্টি হলে গৃহহীন মানুষগুলোর দুঃখ–দুর্দশা আরও বাড়বে।