ব্যবসা- বাণিজ্য ও বিনিয়োগের বাধা দূর করতে এফবিসিসিআইয়ের ৯০ সুপারিশ

0
110
এফবিসিসিআই

সংগঠনটি মনে করে, কর–ব্যবস্থাকে সহজীকরণ করার পাশাপাশি কাস্টমস বিভাগের কার্যক্রমে স্বচ্ছতা আনা ও অনানুষ্ঠানিক লেনদেন বন্ধ করা জরুরি।

বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতিপথ নির্ধারণে একটি গুরুত্বপূর্ণ চালিকা শক্তি। তবে বেশ কয়েক বছর ধরেই দেশে বিনিয়োগের অবস্থা একটি জায়গায় স্থবির হয়ে আছে।

বিশেষ করে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগের মধ্যে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) পরিস্থিতি আরও নাজুক পর্যায়ে রয়েছে। জিডিপিতে এফডিআইয়ের অনুপাত এখনো ১ শতাংশের কম, যা প্রতিযোগী অন্যান্য দেশের তুলনায় সবচেয়ে কম। যদিও এফডিআই বেসরকারি বিনিয়োগকে আকৃষ্ট করার পাশাপাশি অর্থনীতিকে বৈচিত্র্যপূর্ণ করে তুলতে সহায়তা করে।

এফডিআই আকর্ষণ করতে বাংলাদেশের ইতিবাচক গল্পগুলো বহির্বিশ্বে তুলে ধরতে হবে। মোদ্দাকথা, বাংলাদেশের ব্র্যান্ডিং জোরদার করতে হবে। কর–ব্যবস্থাকে সহজীকরণ করার পাশাপাশি কাস্টমস, অর্থাৎ শুল্ক বিভাগের কার্যক্রমে স্বচ্ছতা বাড়ানো ও অনানুষ্ঠানিক লেনদেন বন্ধ করা জরুরি।

সম্মেলনে যেসব সুপারিশ এসেছিল, সেগুলো এই প্রতিবেদনে সংযুক্ত করা হয়েছে। একই সঙ্গে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য-বিনিয়োগের প্রসার এবং বিদ্যমান বাধা দূর করতে প্রয়োজনীয় কিছু সুপারিশও রয়েছে।
মাশরুর রিয়াজ, চেয়ারম্যান, পলিসি এক্সচেঞ্জ

দেশের ব্যবসায়ী–শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন দ্য ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফবিসিসিআই) আয়োজিত ‘বাংলাদেশ বিজনেস সামিট ২০২৩’ শীর্ষক সম্মেলনের আউটকাম রিপোর্ট বা প্রতিবেদনে এসব সুপারিশ করা হয়েছে।

এই প্রতিবেদনে দেশে ব্যবসা-বাণিজ্য-বিনিয়োগের প্রসার ও এসব ক্ষেত্রে বিদ্যমান বাধাগুলো দূর করতে ১০টি খাত বা বিষয়ে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদে বাস্তবায়নের জন্য ৯০ দফা সুপারিশ করা হয়েছে। ডিজিটাল অর্থনীতি, অবকাঠামো, সরকারি-বেসরকারি সংলাপ, রপ্তানি প্রতিযোগিতা সক্ষমতা, বিনিয়োগ আকর্ষণ, কর খাতের সংস্কার, অর্থায়ন, ব্যবসা পরিবেশ ও প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বিষয়ে সুপারিশগুলো করা হয়েছে।

এই প্রতিবেদন গত শনিবার ঢাকায় বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে ব্যবসায়ী সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে আনুষ্ঠানিকভাবে তুলে দেন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন। গত মার্চে অনুষ্ঠিত তিন দিনব্যাপী সম্মেলনের বিভিন্ন অধিবেশনে যেসব চ্যালেঞ্জ ও সুপারিশ উঠে আসে, সেগুলোই মূলত এই প্রতিবেদনে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

বোস্টন কনসাল্টিং গ্রুপের গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্য উল্লেখ করে এফবিসিসিআইয়ের এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আগামী ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের অর্থনীতি এক ট্রিলিয়ন বা এক লাখ কোটি মার্কিন ডলারে উন্নীত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এ জন্য শক্তিশালী বেসরকারি খাত, প্রবাসী আয়, উদার অর্থনীতি, দূরদর্শী আর্থিক ব্যবস্থাপনা—এগুলোই ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি হওয়ার যাত্রাকে সমর্থন করবে। এ ছাড়া দেশে বর্তমানে সাড়ে তিন কোটি মানুষ মধ্যবিত্ত শ্রেণিতে থাকায়, ৬৮ শতাংশ জনগোষ্ঠী কর্মক্ষম হওয়ায়, তিন-চতুর্থাংশ মানুষ মুঠোফোন ব্যবহার করায় এবং সাড়ে ছয় লাখ ফ্রিল্যান্সার কাজ করার কারণে ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি ত্বরান্বিত হবে।

এফবিসিসিআইয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শুল্ক ও কর–ব্যবস্থার ওপর এমনভাবে পরিকল্পনা করতে হবে, যাতে করে তা এ দেশে ব্যবসা শুরু করতে বিনিয়োগকারীদের আকর্ষণ করে। কর–ব্যবস্থাকে রাজস্ব আদায়ের চেয়ে বিনিয়োগ আনার বিষয়ে বেশি ব্যবহার করা প্রয়োজন। কর–ব্যবস্থার সহজীকরণ করাটাও আবশ্যক।

ব্যবসার পরিবেশ নিশ্চিত করতে দীর্ঘমেয়াদি নীতি প্রণয়ন করতে হবে। এমনকি নীতি প্রণয়ন ও সংস্কারে সংশ্লিষ্ট বেসরকারি সংস্থাগুলোর মতামতকেও গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। পণ্য আমদানি-রপ্তানিতে কাস্টমস বিভাগের কাছ থেকে ছাড়পত্রপ্রাপ্তি সহজীকরণ ও অনানুষ্ঠানিক আর্থিক লেনদেন বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এ জন্য প্রয়োজনে আরও প্রকল্প হাতে নিতে হবে।

এফডিআই বাড়াতে স্বল্প মেয়াদে এফবিসিসিআই কিছু সুপারিশ করেছে। বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় উন্নীত হওয়ার পর যেসব চ্যালেঞ্জ দেখা দিতে পারে, সেগুলো মোকাবিলায় বস্ত্র খাতে বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে হবে। জাপানি বিনিয়োগকারীদের কর অবকাশ, নগদ সহায়তা কিংবা শতভাগ বিদেশি মালিকানার মতো সুবিধা দেওয়া দরকার। ১৫ বছরের কর অবকাশ সুবিধা দিলে পর্যটন খাতও বিকশিত হবে। তখন দেশি উদ্যোক্তাদের পাশাপাশি বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও এগিয়ে আসবেন।

ডিজিটাল অর্থনীতির বিকাশে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো উন্নয়নের পাশাপাশি বেসরকারি খাতে দেশীয় ডিজিটাল পণ্য উৎপাদনে পর্যাপ্ত পরিমাণে বিনিয়োগ করতে হবে। ইন্টারনেটের খরচ কমিয়ে আনতে হবে। বাংলাদেশি ডিজিটাল ডিভাইস বিশ্ববাজারে ছড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করাও জরুরি। জমিজমার রেকর্ড ডিজিটাল মাধ্যমে সংরক্ষণ করার ওপর জোর দেওয়া প্রয়োজন।

অবকাঠামো খাতে জ্বালানি নিরাপত্তার জন্য কাতার ও সৌদি আরবের মতো দেশের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি করতে হবে। সহযোগিতার মাধ্যমে প্রতিবেশী দেশ ভারত, নেপাল ও ভুটানের নবায়নযোগ্য জ্বালানির উৎস ব্যবহারে উদ্যোগ নেওয়ার প্রয়োজন আছে। পাশাপাশি দেশের অভ্যন্তরে নতুন কূপ অনুসন্ধান করতে জোর পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। ভোলার গ্যাস মূল ভূখণ্ডে আনতে হবে।

পণ্য রপ্তানিতে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়াতে তৈরি পোশাকের বাইরের অন্যান্য খাতেও শুল্কমুক্ত সুবিধায় কাঁচামাল আমদানির জন্য বন্ডেড ওয়্যারহাউস সুবিধা দেওয়ার সুপারিশ করেছে এফবিসিসিআই। এ ছাড়া জাতীয় লজিস্টিক নীতি দ্রুততম সময়ের মধ্যে সম্পন্ন করতে হবে। তৈরি পোশাক খাতে নতুন বাজার অনুসন্ধান এবং নতুন ও উচ্চ মূল্যের পণ্য তৈরির পাশাপাশি বিদ্যমান পণ্য উৎপাদনে সক্ষমতা বাড়ানোয় অগ্রাধিকার দিতে হবে।

অর্থায়নের বিষয়ে বাধা দূর করতে হবে। ছোট কোম্পানিগুলো যাতে পুঁজিবাজার থেকে ৭ কোটি থেকে ১৫ কোটি টাকার মতো মূলধন সংগ্রহ করতে পারে, সে বিষয়ে উদ্যোগ দরকার। ভারত ও চীনকে অনুসরণ করে সরকার পুঁজিবাজার থেকে অবকাঠামোর জন্য অর্থায়ন সংগ্রহ করতে পারে। সেই সঙ্গে ব্যাংক থেকে সরকারের নেওয়া ঋণে লাগাম টানতে হবে।

বাংলাদেশ বিজনেস সামিট নামের এই সম্মেলন আয়োজনে সহযোগিতা করেছে বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান পলিসি এক্সচেঞ্জ। প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান মাশরুর রিয়াজ বলেন, সম্মেলনে যেসব সুপারিশ এসেছিল, সেগুলো এই প্রতিবেদনে সংযুক্ত করা হয়েছে। একই সঙ্গে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য-বিনিয়োগের প্রসার এবং বিদ্যমান বাধা দূর করতে প্রয়োজনীয় কিছু সুপারিশও রয়েছে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.