দেশে ডিম উৎপাদনের তথ্য নিয়ে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে মতভেদ রয়েছে। উৎপাদন, চাহিদা ও সরবরাহের ঘাটতি নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন মতামত জানিয়েছেন সরকারি কর্মকর্তা এবং পোলট্রি শিল্পের উদ্যোক্তারা।
রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর (ডিএলএস) জানিয়েছে, দেশে ডিমের মাথাপিছু বার্ষিক চাহিদা (আনুমানিক) ১০৪টি। সেই হিসাবে ১৭ কোটি জনসংখ্যার জন্য বছরে ১ হাজার ৭৬৮ কোটি ডিমের প্রয়োজন, এবং গড়ে প্রতিদিনে চাহিদা দাঁড়ায় ৪ কোটি ৮৪ লাখ ডিম।
ডিএলএসের তথ্যানুসারে বর্তমানে বার্ষিক মাথাপিছু ডিমের উৎপাদন ১৩৫টি। জনসংখ্যার বিবেচনায় বছরে ২ হাজার ২৯৫ কোটি এবং গড়ে দিনে ৬ কোটি ২৮ লাখ ডিম উৎপাদন হয়।
ডিএলএসের কর্মকর্তারা বলেছেন, কোনো কোনো মৌসুমে ডিমের চাহিদা ও সরবরাহ ঘাটতি তৈরি হয়। তাছাড়া প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণেও এমনটি ঘটে থাকে। ফলে এসব সময়ে ডিমের বাজারে অস্থিরতা দেখা যায়।
এ প্রসঙ্গে ডিএলএস পরিচালক (উৎপাদন) ডা. এবিএম খালিদুজ্জামান তাদের তথ্য ভান্ডার পর্যালোচনা করে বলেন, প্রতি বছর আগস্ট থেকে অক্টোবর– এই তিন মাস ডিমের ঘাটতি প্রকট হয়।
কারণ ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, আলোচ্য সময়ে বাজারে সবজি ও মাছের সরবরাহ ঘাটতির কারণে ডিমের চাহিদা বেড়ে যায়; ফলে দামও বেড়ে যায়। তার মতে, অদক্ষ সরবরাহ ব্যবস্থার কারণে অনেকগুলো হাত হয়ে ভোক্তার হাতে ডিম পৌঁছায়। এতে করে খামারির বিক্রয় মূল্য থেকে ভোক্তার ক্রয়মূল্যের মধ্যে দামে বড় ধরনের ব্যবধান সৃষ্টি হয়।
পোলট্রি খাতের বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কাজী ফার্মসের পরিচালক কাজী জাহিন হাসান বলেন, ডিমের মোট উৎপাদন নিশ্চিত করা কঠিন। বাণিজ্যিক খামারগুলোতে প্রতিদিন আনুমানিক ৩ কোটি ৫০ লাখ থেকে ৪ কোটি ডিম উৎপাদন হয়। পাশাপাশি গৃহস্থ বাড়িতেও হাঁস ও মুরগির প্রচুর ডিম উৎপাদন হলেও তার সঠিক সংখ্যা নিশ্চিত করা কঠিন। এতে করে দেশে ডিমের প্রকৃত মোট উৎপাদন জানা দুরূহ।
কাজী জাহিন হাসান বলেন, ডিমের উৎপাদন স্থির নয়, চাহিদাও স্থির নয়। গরম আবহাওয়ায় মুরগি কম ডিম পাড়ে। সে কারণে গ্রীষ্মকালে ডিমের সরবরাহ কমে এবং দাম বাড়ে। চলতি বছরে বন্যায় বিভিন্ন জেলায় খামার ডুবে যাওয়ায় ডিমের উৎপাদন ঘাটতি তীব্র হয়েছে। ডিমের উচ্চমূল্য প্রমাণ করে যে সরবরাহ ঘাটতি ছিল।
কাজী জাহিন হাসান বলেন, একটি খাদ্য পণ্য অনেক সময় অন্য খাদ্যের বিকল্প হিসেবে খাওয়া হয়। বিশেষ করে শীতকালে যখন বাজারে পর্যাপ্ত সবজি পাওয়া যায়, তখন অনেকেই ডিমের পরিবর্তে সবজি কিনে থাকেন। এ সময় ডিমের চাহিদা কম থাকে এবং দাম কমে যায়। আবার কোনো কারণে বাজারে মাছ অথবা সবজির সরবরাহ কমে গেলে সাধারণ ভোক্তারা বেশি ডিম কিনতে চায়। তার স্পষ্ট নজির দেখা গেছে চলতি বছরের বন্যার পরে। ওই বন্যায় সবজি ও মাছের খামার তলিয়ে যাওয়ায় বাজারে সবজি ও মাছের সরবরাহও কমেছে। যার প্রভাবে ডিমের অপ্রত্যাশিত চাহিদা বেড়ে যায়; ফলে দামও বেড়ে যায়।
কাজী জাহিন হাসান বলেন, ডিমের ব্যবসায় যুক্ত সব পর্যায়ের ব্যবসায়ী সবসময় কম দামে ডিম কেনার চেষ্টা করেন, এখানে কেউ চাইলেও বেশি দামে ডিম বিক্রি করতে পারেন না। তীব্র প্রতিযোগিতামূলক এ বাজারে সরবরাহ কমে গেলে অথবা চাহিদা বৃদ্ধি হলেই কেবল দাম বেড়ে যায়। যখন বাজারে ডিমের মূল্য বেড়ে যায়, তখন সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তারা কোম্পানির বিরুদ্ধে মূল্য কারসাজির অভিযোগ আনেন। কোনো ব্যবসায়ী বা কোম্পানির বিরুদ্ধে মূল্য কারসাজির অভিযোগ বা কোনো নেতিবাচক মন্তব্য করার আগে সরকারি এই সংস্থাগুলো থেকে অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞ নিয়োগের মাধ্যমে বাজার পরিস্থিতি গবেষণা এবং পর্যালোচনা করা উচিত বলে মন্তব্য করেছেন কৃষি খাতের এই উদ্যোক্তা।
কাজী জাহিন হাসান বলেন, প্রতি বছরে জনসংখ্যা বাড়ে, সাথে সাথে ডিমের চাহিদাও বাড়ে, তার জন্য নতুন বিনিয়োগ প্রয়োজন। কিন্তু সরকারি কর্মকর্তাদের মনগড়া কারসাজির অভিযোগের কারণে এ খাতে নতুন বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত হচ্ছে। বর্তমান উদ্যোক্তাদেরও হয়রানি করা হচ্ছে। এ ধরনের হয়রানি বন্ধ না হলে দেশীয় শিল্প বিকশিত হবে না।
সরকারি-বেসরকারি তথ্যের ব্যাপক গরমিলে সংকটে পড়েছে দেশের পোলট্রি শিল্প খাত। বিশেষ করে ডিম, মাংস ও দুধের উৎপাদন এবং চাহিদার সঠিক তথ্য না থাকায় বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারাও বিপাকে পড়ছেন। উৎপাদন ঘাটতি ও সরবরাহ সংকটে কখনও কখনও অপ্রত্যাশিত হারে বাড়ছে এসব পণ্যের দাম। ফলে ভোগান্তি বাড়ছে সাধারণ ভোক্তাদের। এ সময় নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ডিএলএসের অপর এক কর্মকর্তা বলেন, ডিমের দামকে রাজনৈতিক ইস্যুতে পরিণত করা হচ্ছে।