বৃষ্টি না থাকায় শেরপুর ও ময়মনসিংহের বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। তবে এই দুই জেলায় এখনো অনেক মানুষ পানিবন্দী। তাঁদের জন্য ত্রাণসহায়তা প্রয়োজন। আর নেত্রকোনায় আরও তিনটি উপজেলায় বন্যার বিস্তৃতি ঘটেছে। প্লাবিত হয়েছে ১২৩টি গ্রামের নিম্নাঞ্চল। জেলার ১৮৬টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠদান বন্ধ আছে।
গত রোববার সন্ধ্যায় বন্যার পানিতে ডুবে শেরপুরের নকলা উপজেলার গণপদ্দি ইউনিয়নের গজারিয়া গ্রামে মো. আবদুর রাজ্জাক (৫০) নামের এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। এর আগে নালিতাবাড়ীতে বন্যার পানিতে ডুবে দুই ভাইসহ চারজনের মৃত্যু হয়।
শেরপুর জেলা, উপজেলা প্রশাসন ও পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্রে জানা গেছে, রোববার দুপুরের পর থেকে বৃষ্টি না হওয়ায় এবং মহারশী ও সোমেশ্বরী নদীর পানি কমে যাওয়ায় গতকাল সোমবার জেলার ঝিনাইগাতী, শ্রীবরদী, শেরপুর সদর ও নকলা উপজেলার ২০ ইউনিয়নের সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। এসব ইউনিয়নের শতাধিক গ্রাম থেকে বন্যার পানি ধীরে ধীরে নিম্নাঞ্চলে নেমে যাচ্ছে। এখনো প্রায় ২০ হাজার মানুষ পানিবন্দী।
গতকাল দুপুরে সরেজমিনে শেরপুর সদর উপজেলার পাকুরিয়া ও ধলা ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রামে দেখা যায়, ঢলের পানির তোড়ে চৈতনখিলা বটতলা থেকে বাদাতেঘরিয়া গ্রাম হয়ে ধলাকান্দা পর্যন্ত সড়কের বিভিন্ন অংশ ভেঙে গেছে এবং সড়কের ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। সড়কের দুই পাশের বাদাতেঘরিয়া ও ধলা নামাপাড়া গ্রামের শতাধিক বাড়িঘর পানিতে প্লাবিত।
এ সময় কথা হয় ধলা ইউনিয়নের ধলা নামাপাড়া গ্রামের কৃষক মো. শামীম মিয়ার সঙ্গে। তিনি বলেন, দুই দিন ধরে ঘরে পানি উঠেছে। বর্তমানে পরিবার নিয়ে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছেন। কোনো সাহায্য পাননি।
জেলা প্রশাসক তরফদার মাহমুদুর রহমান বলেন, সেনাবাহিনী, পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস, বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, ব্যবসায়ীসহ সবাই বন্যাদুর্গতদের জন্য এগিয়ে এসেছে।
বাড়ি থেকে বুকপানি ভেঙে এসেছেন নালিতাবাড়ীর উত্তর নাকশী গ্রামের আলেয়া বেগম (৫২)। তিনি বললেন, ‘চাইর দিন ধইরা বাড়িঘরে পানি। রান্দুনের কোনো বাও (ব্যবস্থা) নাই। বাজার থাইকা শুকনা খাওন আইনা কোনো রহম দিন কাডাইতাছি। দুঃখের বিষয় অইল, এই পর্যন্ত কোনো ত্রাণ পাইলাম না। কেউ খোঁজ নিল না।’
নালিতাবাড়ী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মাসুদ রানা বলেন, চার দিনে এ পর্যন্ত ২৬ হাজার পরিবারকে রান্না করা খিচুড়ি ও শুকনা খাবারের প্যাকেট দেওয়া হয়েছে।
সুপেয় পানির সংকট
ময়মনসিংহের ধোবাউড়ায় অনেক এলাকায় পানি কমেছে। তবে সুপেয় পানির সংকটে ভুগছেন বন্যাকবলিত এলাকার মানুষ। গতকাল সকাল নয়টার দিকে ধোবাউড়া উপজেলা সদর ব্রিজপাড় এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, ঊরুসমান পানি মাড়িয়ে চলাচল করছেন লোকজন। বাড়িঘরে পানি ঢুকেছে। ধোবাউড়া সদর ইউনিয়নের গুজিয়ারকান্দা গ্রামের সৌরভ সরকার জানান, রোববার থেকে তাঁদের এলাকায় পানি একই রকম আছে।
এ উপজেলায় চলমান বন্যায় লক্ষাধিক মানুষ দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন। ৫৮ হাজার মানুষ পানিবন্দী বলে জানিয়েছেন জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা। এ ছাড়া তলিয়ে গেছে ১১ হাজার ৭০০ হেক্টর আমন ধানের জমি।
ধোবাউড়ার ইউএনও নিশাত শারমিন বলেন, বেসরকারিভাবে কিছু ত্রাণ দেওয়া হচ্ছে। সমন্বয় করে ত্রাণ বিতরণ করা হচ্ছে।
৫ উপজেলায় বন্যার পানি
ভারী বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে নেত্রকোনার দুর্গাপুর, কলমাকান্দার বন্যা বিস্তৃত হয়েছে নেত্রকোনা সদর, পূর্বধলা ও বারহাট্টা উপজেলা অবধি। অন্তত ২৫টি ইউনিয়নের ১২৩টি গ্রামের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে।
গতকাল সকাল ১০টার দিকে এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত কলমাকান্দার উব্দাখালী নদীর পানি বিপৎসীমার ১০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। অবশ্য জেলার বড় নদী সোমেশ্বরী ও কংস নদের পানি কিছুটা কম ছিল। তবে ধনু, নেতাই, মহাদেও, মঙ্গলেশ্বরী, মগড়াসহ বিভিন্ন ছোট-বড় নদ-নদীর পানি স্থিতিশীল আছে।
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. মোফাজ্জল হোসেন বলেন, বন্যার পানির কারণে ১৮৬টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠদান বন্ধ রাখা হয়েছে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. নুরুজ্জামান বলেন, জেলার ১০টি উপজেলায় ১ লাখ ৩৫ হাজার ৯০০ হেক্টর জমিতে আমন আবাদ করা হয়। আকস্মিক বন্যার কারণে ৫টি উপজেলায় ১৮ হাজার ১০৪ হেক্টর জমির ফসল তলিয়ে গেছে।
জেলা প্রশাসক বনানী বিশ্বাস বলেন, বন্যা মোকাবিলায় সব প্রস্তুতি আছে। কলমাকান্দা, দুর্গাপুর, পূর্বধলা ও নেত্রকোনা সদর উপজেলার জন্য বরাদ্দ করা নগদ ৩ লাখ টাকা, ২ হাজার ৫০০ প্যাকেট শুকনা খাবার ও ৬০ মেট্রিক টন চাল বিতরণ করা হচ্ছে।