ঘটনাটি ঘটেছিল আট বছর আগে। রাজধানীর উত্তরার দিয়াবাড়ির খাল থেকে উদ্ধার করা হয়েছিল বিপুল অস্ত্র, গুলি ও বিস্ফোরক। এত বছরেও এ ঘটনায় কোনো মামলা হয়নি। ওই ঘটনায় নগরীর তুরাগ থানায় পৃথক তিনটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হয়েছিল। সেই জিডিগুলোর সম্প্রতি চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছে পুলিশ। তবে প্রতিবেদনে কাউকে অভিযুক্ত করেনি পুলিশ।
এই বিপুল অস্ত্র উদ্ধারের পর দেশব্যাপী নানা আলোচনা শুরু হয়। পুলিশ কর্মকর্তারা তখন বলেছিলেন, কোনো সন্ত্রাসী গোষ্ঠী অস্ত্রগুলো সীমান্ত থেকে এনে তা রাখার নিরাপদ স্থান না পেয়ে খালে ফেলেছে। নাশকতা পরিকল্পনার অংশ হিসেবে এগুলো আনা হয়ে থাকতে পারে।
পুলিশ এখন বলছে, ওই সব অস্ত্র-গোলাবারুদ কারা, কী উদ্দেশ্যে এনেছিল, তা জানা সম্ভব হয়নি। বিষয়টি উল্লেখ করে সম্প্রতি ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতে তিনটি জিডির চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে।
জিডিগুলো তদন্ত তদারকের দায়িত্বে ছিলেন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইমের (সিসিটিসি) স্পেশাল অ্যাকশন গ্রুপের অতিরিক্ত উপকমিশনার (সদ্য পুলিশ সুপার পদে পদোন্নতিপ্রাপ্ত) আহমেদুল ইসলাম। সম্প্রতি তিনি বলেন, আদালতে দেওয়া প্রতিবেদনে বলা হয়েছে তদন্তে অস্ত্র, গুলি ও গোলাবারুদ উদ্ধারের সঙ্গে সন্দেহভাজন কারও সম্পৃক্ততা কিংবা কোনো সূত্রও পাওয়া যায়নি। পরে এসবের সঙ্গে কোনো সূত্র বা কারও সম্পৃক্ততা পাওয়া গেলে নতুন করে আবার তদন্ত শুরু করা হবে।
২০১৬ সালের ১৮ জুন প্রথম দফায় উত্তরার ১৬ নম্বর সেক্টরের বৌদ্ধ মন্দির ঘেঁষে দিয়াবাড়ি খাল থেকে সাতটি কালো ব্যাগের ভেতর থেকে ৯৫টি ৭.৬২ এম এম পিস্তল, ২টি ৯ এম এম পিস্তল, ৪৬২টি ম্যাগাজিন (২৬৩টি এসএমজি), ১০৬০টি গুলি, ১০টি বেয়নেট, ১৮০টি ক্লিনিং রড ও ১০৪টি স্প্রিং যুক্ত বাক্স উদ্ধার করা হয়। পরদিন ১৯ জুন দ্বিতীয় দফায় ওই খাল থেকে আরও তিনটি ব্যাগ উদ্ধার করা হয়। ওই ব্যাগে ছিল এসএমজির ৩২টি ম্যাগাজিন ও ৮টি ক্লিনিং রড।
ওই বছরের ২৫ জুন তৃতীয় দফায় একই এলাকার অন্য একটি খাল থেকে উদ্ধার করা হয় আরও তিনটি ব্যাগ। তাতে ৫টি ওয়াকিটকি, ২টি ট্রান্সমিটার, ২টি ফিডার কেব্ল, ২২টি কৌটা (যার মধ্যে ছিল আইসি, ট্রানজিস্টর, ক্যাপাসিটর ও সার্কিট), ৭ প্যাকেট বিস্ফোরক জেল, ৪০টি পলিথিনের ব্যাগে থাকা বিভিন্ন ইলেকট্রনিক সরঞ্জাম এবং ৩২৫টি রুপালি ও সবুজ রঙের স্প্রিংযুক্ত বাক্স ছিল। এ ছাড়া আরও কিছু বৈদ্যুতিক ডিভাইসও উদ্ধার করা হয়।
একই বছরের ১৮ জুন বেলা তিনটার দিকে নম্বরবিহীন একটি কালো জিপ থেকে খালে ব্যাগ ফেলতে দেখে এক পুলিশ কনস্টেবল তুরাগ থানায় খবর দেন। ওই কনস্টেবল সপরিবার ওই এলাকায় এক আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলেন। ওই খবরের ভিত্তিতে টহল পুলিশ ঘটনাস্থলে যায়। এর আগেই অবশ্য জিপটি নিয়ে সেখান থেকে পালিয়ে যান চালক। ওই ঘটনায় তুরাগ থানায় পৃথক তিনটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হয়েছিল।
ডিএমপির তৎকালীন কমিশনার মো. আছাদুজ্জামান মিয়া তখন ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছিলেন। ঘটনাস্থল পরিদর্শনে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘এটি কোনো সাধারণ অপরাধীর কাজ নয়। যারা দেশীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশে অশান্তি সৃষ্টি করতে চায়, মধ্যম আয়ের দেশ হওয়ার বিষয়টি ভন্ডুল করতে চায়, এটা তাদের কাজ।’
২০১৯ সালের ১৩ আগস্ট আছাদুজ্জামান মিয়া অবসরকালীন ছুটিতে যান। তিনি ডিএমপি কমিশনার থাকাকালে প্রায় তিন বছর ধরে ঘটনার তদন্ত হয়। কিন্তু ‘দেশীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে অশান্তি সৃষ্টিকারীদের’ আর শনাক্ত করা যায়নি।
এ বিষয়ে সম্প্রতি আছাদুজ্জামান মিয়া বলেন তিনি অবসরে যাওয়ার আগে এ ঘটনায় তদন্তের কিছুটা অগ্রগতি ছিল। আর তা হলো উদ্ধার করা গুলি আর চট্টগ্রাম বন্দর থেকে উদ্ধার হওয়া ১০ ট্রাক অস্ত্রের গুলির নমুনা ছিল একই। তখন সিটিটিসির অস্ত্র ও গোলাবারুদ বিশেষজ্ঞরা মন্তব্য করেছিলেন দিয়াবাড়ির খাল থেকে উদ্ধার হওয়া গুলিগুলো ১০ ট্রাক অস্ত্রেরই গুলির অংশ। এটা কোথা থেকে এল সেটি নিয়ে তদন্ত চলছিল।
২০০৪ সালে চট্টগ্রামে ১০ ট্রাক অস্ত্র উদ্ধার হয়েছিল। সেই সময়ে বাকি এই অস্ত্রগুলো ঢাকা শহরের কোথাও লুকানো ছিল। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তল্লাশির মুখে ধরা পড়ার ভয়ে হয়তো কেউ এগুলো দিয়াবাড়ির খালে ফেলে দিয়েছেন বলে ধারণা করেছিলেন সিটিটিসির অস্ত্র ও গোলাবারুদ বিশেষজ্ঞরা। এই তথ্য জানিয়ে আছাদুজ্জামান বলেন, এর পরের অগ্রগতি কী ছিল, তিনি জানেন না।
ডিএমপির স্পেশাল অ্যাকশন গ্রুপের এক কর্মকর্তা প্রায় একই ধরনের কথা বলেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, ‘দেশের কোনো সন্ত্রাসী দল সীমান্ত থেকে হয়তো অস্ত্রগুলো এনেছিল। নিরাপদ স্থান খুঁজে না পাওয়ায় এগুলো তারা কয়েক দফায় খালে ফেলে দেয়।’
স্পেশাল অ্যাকশন গ্রুপের আরেক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, দিয়াবাড়িতে উদ্ধার করা অস্ত্র ও গোলাবারুদ অকেজো ছিল। জঙ্গিদের কাছে এ পর্যন্ত যত অস্ত্র পাওয়া গেছে, তার বেশির ভাগই পাশের দেশ থেকে আনা।
অবৈধ ওই অস্ত্র উদ্ধারের অভিযান শেষে তৎকালীন পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) এ কে এম শহীদুল হক সাংবাদিকদের বলেছিলেন, বড় ধরনের নাশকতা ঘটাতেই অস্ত্র ও গোলাবারুদের মজুত করা হয়েছিল। নাশকতার পরিকল্পনা পুলিশের অভিযানের কারণেই নস্যাৎ হয়ে গেছে বলে তিনি মন্তব্য করেছিলেন। ২০১৮ সালের ১ জানুয়ারি অবসরে গেছেন শহীদুল হক। এর আগে দিয়াবাড়ি খাল থেকে অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধারের পর দেড় বছর আইজিপি ছিলেন তিনি। সেই সময় ওই ঘটনার কোনো কূলকিনারা হয়নি।
সম্প্রতি এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে সাবেক এই আইজিপি বলেন, ‘ তখন হাউস টু হাউস তল্লাশি চলছিল। ওই তল্লাশির কারণে অস্ত্র ও গুলি ফেলে গিয়েছিল। অনেক চেষ্টা করা হয়েছে। কারা ফেলে গেছে, তা পুলিশ আর বের করতে পারেনি। এখনো তিনি মনে করছেন, নাশকতার জন্যই অস্ত্র ও গুলিগুলো আনা হয়েছিল। পরিত্যক্ত অবস্থায় উদ্ধার হয়েছিল বলে জিডি করা হয়েছিল। কারও পজিশনে পেলে ওই ঘটনায় মামলা করা যেত।’
            

















