দায়মুক্তির পরও ফেরত আসছে না পাচার অর্থ

0
127

নানা সমালোচনার পরও পাচার করা অর্থ বিনা প্রশ্নে দেশে ফিরিয়ে আনতে মাত্র ৭ শতাংশ করের মাধ্যমে ‘অফশোর ট্যাক্স অ্যামনেস্টি’র বিধান প্রথমবারের মতো অর্থ আইনে যুক্ত করে সরকার। তবে সহজ শর্তের এই দায়মুক্তির সুবিধা নিচ্ছে না কেউ। এই অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে এ প্রক্রিয়ায় বিদেশ থেকে কোনো অর্থ আসেনি। অন্যদিকে, অর্থ আইন-২০২২-এ অপ্রদর্শিত সম্পদ আয়কর রিটার্নে প্রদর্শন না করলে সমপরিমাণ জরিমানারও বিধান করা হয়। এ ক্ষেত্রেও কোনো বৈদেশিক সম্পদ দেশে ফেরত আসেনি।

প্রচারের অভাব ও আস্থা সংকটে কেউ বৈদেশিক সম্পদ ফেরত আনার সুযোগ নেয়নি বলে জানিয়েছেন এনবিআর কর্মকর্তারা। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ভারত, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশ জরিমানা ও কর ধার্যের মাধ্যমে তা আদায় করে (ট্যাক্স রিকভারি) পাচার করা অর্থ বা সম্পদ উদ্ধারে সাফল্য পাচ্ছে। তবে বাংলাদেশের বিদ্যমান আইনি কাঠামো, বিচারিক প্রক্রিয়া এবং প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর সীমাবদ্ধতার কারণে ‘ট্যাক্স রিকভারি’ প্রক্রিয়া কার্যকর নয়। অন্যদিকে, অর্থ বা সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে তা দেশে আনার ক্ষেত্রেও সফলতা কম।

চলতি বাজেটে অর্থ আইন-২০২২ এর মাধ্যমে আয়কর অধ্যাদেশে অফশোর ট্যাক্স অ্যামনেস্টির বিধান অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এ বিধানের ফলে কোনো করদাতা নির্ধারিত সময়ে মধ্যে ৭ শতাংশ হারে কর পরিশোধ করে তার অপ্রদর্শিত বৈদেশিক সম্পদ প্রদর্শন করতে পারবেন। এ ক্ষেত্রে বৈদেশিক সম্পদের উৎস নিয়ে বাংলাদেশের কোনো কর্তৃপক্ষ প্রশ্ন তুলতে পারবে না।

এ বিধানের আওতায় যে কোনো পরিমাণ নগদ বা নগদ সমতুল্য, ব্যাংক জমা, ব্যাংক নোটস, ব্যাংক হিসাব, কনভারটিবল সিকিউরিটিজ এবং আর্থিক দলিলাদি ৭ শতাংশ কর পরিশোধ করে ব্যাংকের মাধ্যমে দেশে আনা যাবে। আগামী ৩০ জুন পর্যন্ত এ সুবিধা পাওয়া যাবে। অর্থ আইনের আয়কর অধ্যাদেশে নিবাসী বাংলাদেশি করদাতার আয়কর রিটার্নে অপ্রদর্শিত অফশোর সম্পদের জন্য জরিমানার বিধানও সংযোজন করা হয়েছে।

এই অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে (জুলাই-মার্চ) সরকারের এ সহজ সুযোগ কেউ গ্রহণ করেনি। তাই আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে এ সুযোগ আর রাখা হবে না বলে জানা গেছে।

সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, মূলত পাচার করা অর্থ ফেরাতেই এ সুযোগ দেওয়া হয়। টাকা পাচার করা বাংলাদেশে একটি অপরাধ এবং এর শাস্তির বিধান রয়েছে। কর দেওয়ার মাধ্যমে পাচার হওয়া টাকা ফিরিয়ে আনার এ পদক্ষেপ ছিল আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম বলেন, চলতি বাজেটে কর আরোপের মাধ্যমে পাচার করা অর্থ ফেরাতে সরকারের পদক্ষেপ সমর্থনযোগ্য নয়। বাংলাদেশ এবং আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী, অর্থ পাচার একটি গুরুতর অপরাধ। এ ধরনের অপরাধকে ঢালাওভাবে মাত্র ৭ শতাংশ কর দিয়ে বৈধতা দেওয়ার উদ্যোগ গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। তাঁর মতে, এ সিদ্ধান্ত বৈষম্যমূলকও বটে। কেননা দেশে বা বিদেশে যাঁরা বৈধভাবে আয় করেন, তাঁদের ২০ শতাংশ থেকে শুরু করে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত কর দিতে হয়। আগামী বাজেটে এ বিধান না রাখার পরামর্শ দেন তিনি।

গবেষণা সংস্থা সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, যতই সুযোগ দেওয়া হোক না কেন পাচারকারীরা টাকা ফেরত আনবে না। সিপিডির পক্ষ থেকে আগেই এমন বলা হয়েছিল। এখন প্রমাণিত হয়েছে, এ সুযোগ দিয়ে সরকার বদনাম কুড়ালেও কিছুই অর্জন করতে পারেনি।

তিনি আরও বলেন, যারা টাকা পাচার করেছে, তাদের অর্থ দেশেও রয়েছে। অর্থ ফেরত আনা কঠিন হওয়ার পরও কিছু দেশ ‘ট্যাক্স রিকভারি’ পদ্ধতিতে পাচারকারীর দেশীয় সম্পদ থেকে তিন গুণ পর্যন্ত অর্থ আদায় করে। বাংলাদেশ সেই পথে হাঁটতে পারে। একই সঙ্গে অর্থ পাচার রোধে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরও শক্তিশালী করতে হবে।

বিএফআইইউর প্রতিবেদনে যা আছে

বাংলাদেশ থেকে পাচার করা অর্থ বা সম্পদ উদ্ধারের কৌশল নির্ধারণ-সংক্রান্ত বিএফআইইউর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বর্তমানে বিভিন্ন দেশ অর্থ পাচারকরীদের চিহ্নিত করে ট্যাক্স রিকভারি প্রক্রিয়ায় খুব সফলভাবে ফাঁকি দেওয়া কর জরিমানাসহ আদায় করছে। এ পদ্ধতিতে সুইস ব্যাংক থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে যুক্তরাষ্ট্রের কর এজেন্সি ২০০৯ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত সময়ে ৪৫ হাজার অর্থ পাচারকারীর কাছ থেকে ৬৫০ কোটি ডলার আদায় করেছে। সুইস ব্যাংকে গোপন হিসাব রয়েছে এমন করদাতাদের কাছ থেকে ফ্রান্স প্রায় ১২০ কোটি ইউরো এবং ইতালি প্রায় ৫৭ কোটি ইউরো আদায় করেছে। একই তথ্যের ভিত্তিতে যুক্তরাজ্যের কর এজেন্সি কর এবং জরিমানা বাবদ প্রায় ১৫ কোটি পাউন্ড এবং স্পেন ২১ কোটি ইউরো আদায় করেছে। পাশের দেশ ভারতও আদায় করেছে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ কর ও জরিমানা।

সামগ্রিকভাবে পাচার করা অর্থ ফেরত আনার বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা প্রসঙ্গে প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের পাচারকারীরা সাধারণত সম্পদশালী ও প্রভাবশালী হওয়ায় প্রচুর অর্থ খরচ করে বড় বড় আইনজ্ঞ নিয়োগ করার মাধ্যমে বিচারিক প্রক্রিয়া বিলম্বিত করে। এতে অনেক সময় তদন্ত কার্যক্রম বা বিচারিক পর্যায়ে হতাশা চলে আসে।

এতে আরও বলা হয়, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মালিক বা ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিতদের সঙ্গে যোগসাজশ বা জালিয়াতির মাধ্যমে ঋণ নিয়ে বিদেশে অর্থ পাচার রোধে শুধু মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন প্রযোজ্য হয়। তা ছাড়া অপরাধটি অপেক্ষাকৃত নতুন হওয়ায় তদন্ত ও বিচারিক প্রক্রিয়ায় দক্ষ লোকবলের অভাব রয়েছে। এ ধরনের অপরাধে অভিযুক্তরা অত্যন্ত প্রভাবশালী হয়ে থাকেন। অনেক সময় বৈধ ব্যবসার আড়ালে অর্থ পাচার হয়। ফলে বিষয়টি আরও জটিল হয়ে পড়ে।

কোথায় কীভাবে পাচার হয়

এদিকে ওয়াশিংটনভিত্তিক প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির তথ্য অনুযায়ী, বাণিজ্যের আড়ালে বাংলাদেশ থেকে বছরে ৫০ থেকে ৬০ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়। বিএফআইইউর প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘মালয়েশিয়া মাই সেকেন্ড হোম’ বাংলাদেশিদের জন্য বহুল আলোচিত একটি অভিবাসন কর্মসূচি। চীন ও জাপানের পর এ কর্মসূচির বড় গ্রাহক বাংলাদেশিরা। জীবন যাপনের স্বস্তি ও নিরাপত্তার স্বার্থে ২০০৩ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ৪ হাজার ১৩৫ বাংলাদেশি মালয়েশিয়ায় বাড়ি কিনেছে। ফলে অন্তত ৪ হাজার কোটি টাকা দেশটিতে স্থানান্তরিত হয়েছে।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, কানাডা, যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশও অভিবাসন কর্মসূচি গ্রহণ করে থাকে। বাংলাদেশের অনেক নাগরিক উন্নত জীবনের প্রত্যাশায় কিংবা অবৈধভাবে উপার্জিত অর্থসম্পদ নিরাপদে স্থানান্তরের জন্য এসব দেশে অর্থ পাচার করে। অনেকে অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে পর্যায়ক্রমে অর্থসম্পদ অবৈধভাবে দেশের বাইরে নিয়ে যায়।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.