জেলেনস্কিকে যে কথা বলেননি সি চিন পিং

0
101

চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং ফোনে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের সঙ্গে কথা বলেছেন। রাশিয়ার সঙ্গে ইউক্রেনের শান্তি আলোচনার প্রক্রিয়া শুরুর জন্য চেষ্টা করছে বেইজিং। একই সঙ্গে পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলোকে বেইজিং এই ধারণা দিতে চায় যে মস্কো ইউক্রেনের স্বাধীনতা পুরোপুরি গুঁড়িয়ে দেওয়ার যে প্রচেষ্টায় নেমেছে, তাতে সহযোগিতা করছে না চীন।

সি চিন পিং ও জেলেনস্কির মধ্যে ঘণ্টাব্যাপী ফোনালাপটি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর ১৪ মাস পর অনুষ্ঠিত হলো। এ যুদ্ধ চলাকালে চীন ঘোষণা করেছে রাশিয়ার সঙ্গে বেইজিংয়ের বন্ধুত্বের কোনো সীমা নেই।

চীনের একজন শীর্ষ কূটনীতিক ও ফ্রান্সে নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত লু শায়ে সম্প্রতি বলেছেন, লিথুয়ানিয়া, লাটভিয়া ও এস্তোনিয়া সাবেক সোভিয়েত রিপাবলিকের অন্তর্ভুক্ত দেশগুলোর আদৌ কোনো সার্বভৌমত্ব নেই। তাঁর এ বক্তব্যে চীন তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছে।

লু শায়ে প্যারিসে একটি টেলিভিশন চ্যানেলকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী, সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের দেশগুলো কোনো আন্তর্জাতিক চুক্তির আওতায় যতক্ষণ সার্বভৌম রাষ্ট্রের স্বীকৃতি না পাচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত তাদের কোনো কার্যকর মর্যাদা নেই।’

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ঠিক একই যুক্তিতে ইউক্রেনে আগ্রাসন শুরু করেছিলেন। ইউক্রেনও সাবেক সোভিয়েত রাষ্ট্র। ২০১৪ সালে বাল্টিক সাগরের অন্য তিনটি দেশ যেমনটা ন্যাটো এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নে যুক্ত হতে চেয়েছিল, ইউক্রেনও সেটা চেয়েছিল।

বাল্টিক সাগরের দেশগুলো নিয়ে লু শায়ের এ মন্তব্য থেকে বোঝা যায়, ইউক্রেনে মস্কোর আগ্রাসনকে কেন সমালোচনা করেনি বেইজিং। ১৯৯০-এর দশকে বাল্টিক সাগরের দেশগুলোর স্বাধীনতার বিষয়ে প্রথম আপত্তি জানায় রাশিয়া।

লু শায়ের মন্তব্যে ইউরোপীয়দের ভেতরে ভয়ানক যে প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিয়েছে, তাতে ভূত দেখতে শুরু করেছেন সি চিন পিং। এর ফলে এক ধাপ পেছনে যেতে বাধ্য হয়েছে চীন। গত সোমবার বেইজিংয়ের পক্ষ থেকে বেশ বেমানান একটি বিবৃতি দিয়ে বলা হয়, বাল্টিক দেশগুলোর বৈধতার কোনো সংকট নেই। চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মাও নিং ঘোষণা দেন, সোভিয়েত ইউনিয়ন বিলুপ্তির পর রাষ্ট্রগুলোর পৃথক সার্বভৌম-অস্তিত্ব রয়েছে।

রাষ্ট্রদূত লু শায়ের তাঁর বিবৃতিতে বলেন তাঁর এই মন্তব্য ব্যক্তিগত মতামত, এটা চীনের নীতি নয়। চীনের রাষ্ট্রীয় সংবাদপত্র ও কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র গ্লোবাল টাইমস বলে, ‘ইউরোপ সামান্য বিষয় বড় করে তুলছে।’

এই হইচইয়ের মধ্যে চীনের একটি দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য হুমকির মুখে পড়ল। চীন চায় যুক্তরাষ্ট্র ও এর ইউরোপীয় মিত্রদের মধ্যে যেন দূরত্ব থাকে।

ব্রাসেলসভিত্তিক সেন্টার ফর রাশিয়া ইউরোপ এশিয়া স্টাডিজের পরিচালক থেরেসা ফালন বলেছেন, ন্যাটো জোটের প্রতি সি চিন পিংয়ের কৌশল দুর্বল হয়ে পড়ল। এটা নির্ধারণ করা সি চিনের জন্য সত্যিই খুব গুরুত্বপূর্ণ এবং দ্রুত সেটা নির্ধারণ করতে হবে।’
ইউরোপীয়দের বিশেষ করে বাল্টিক দেশগুলোর প্রতিক্রিয়া থেকে স্পষ্ট যে তারা চীনের ক্রমবর্ধমান আগ্রাসী নীতির বিরুদ্ধে তাদের অবস্থান প্রকাশ করেছে। চীনের ‘নেকড়ে যোদ্ধা কূটনীতি’ সাধারণত যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বেইজিংয়ের অবস্থান প্রকাশ করতে ব্যবহৃত হয়।

জো বাইডেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই তাঁর প্রশাসন চীনের ‘নেকড়ে যোদ্ধা’ কূটনীতির স্বাদ পেয়েছিলেন। ২০২১ সালে চীনের শীর্ষ পররাষ্ট্রনীতি কর্মকর্তা ইয়াং লিছি যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এ সময় তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে এই বলে দোষ দেন যে ওয়াশিংটন ‘চীনের কণ্ঠরোধ’ করার চেষ্টা করছে। গত ফেব্রুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের আকাশে উড্ডয়নরত চীনের গোয়েন্দা বেলুন ভূপাতিত করার পর বেইজিংয়ের তরফ থেকে একই আচরণের নজির দেখতে পায় ওয়াশিংটন।

বাল্টিক-কাণ্ড ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁও যে সস্তা মূল্যে ইউরোপকে ওয়াশিংটন পররাষ্ট্রনীতি থেকে সরিয়ে আনার চেষ্টা করেছিল, তাঁর সেই অবস্থানের ওপরও চপেটাঘাত। এ মাসের শুরুতে বেইজিং সফরের সময় মাখোঁ এ ধারণা প্রচার করেছিলেন যে ইউরোপের পররাষ্ট্রনীতি যুক্তরাষ্ট্র থেকে ভিন্ন।

কিন্তু বাল্টিক-কাণ্ডে ইউরোপের নেতারা যুদ্ধকালে চীন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে রাশিয়াকে যে সমর্থন দিয়ে আসছে, সেটার প্রতি কঠোর মনোভাব দেখাতে শুরু করেছে।

ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লেন বলেছেন, ইইউ-চীন সম্পর্কের ভবিষ্যৎ নির্ধারণের ক্ষেত্রে চলমান ইউক্রেন সংকট প্রধান বিষয় হয়ে উঠেছে।
সি চিন পিং ও জেলেনস্কি ফোনালাপের কথা যদি বিবেচনা করি তাহলে দেখা যাবে, জেলেনস্কি যেখানে এটাকে ‘অর্থপূর্ণ’ বলে অভিহিত করছেন, সেখানে চীন  ‘শান্তি ও সংলাপ’ শুরুর ক্ষেত্রে ‘মূল অবস্থান’-এর ওপর গুরুত্ব দিয়েছে।

কথোপকথনকালে সি চিন পিং রাশিয়ার আগ্রাসনে সমর্থন দিতে তিনি যে ইচ্ছুক নন, সেটা আবার বলেন। সি বলেন, ‘সার্বভৌমত্ব ও ভূখণ্ডগত অখণ্ডতার প্রতি যৌথ সম্মানের’ বিষয়টি ‘চীন-ইউক্রেন সম্পর্কের রাজনৈতিক ভিত্তি’। এ ছাড়া সি আবারও পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের বিরোধিতা করেন।

এরপর চীনের ইউক্রেন যুদ্ধনীতির মূল্যায়নের জন্য কিছু কূটনৈতিক কসরত প্রয়োজন হবে। বেশ কিছু বিষয়ে চীন রাশিয়ার পক্ষ নিয়েছে। কখনোই তারা আগ্রাসনকে মস্কোর সুরে সুর মিলিয়ে যুদ্ধ বলেনি। এর পরিবর্তে বেইজিং অপেক্ষাকৃত নরম শব্দগুচ্ছ ‘বিশেষ সামরিক অভিযান’ ব্যবহার করেছে। তবে রাশিয়ার আক্রমণকে বেইজিং আগ্রাসনও বলেনি। বরং ইউক্রেনীয় প্রতিরোধ যোদ্ধাদের অস্ত্র সরবরাহ করে উত্তেজনা বৃদ্ধির জন্য তারা যুক্তরাষ্ট্র ও এর মিত্রদের দায়ী করেছে।

চীনের সরকারি সিজিটিএন-এ প্রচারিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বেইজিং কিয়েভে একটি তথ্য যাচাই কমিশন পাঠাবে আর জেলেনস্কি বেইজিংয়ে রাষ্ট্রদূত প্রেরণের ঘোষণা দিয়েছেন।

রাশিয়া ও ইউক্রেন চীনের মধ্যস্ততায় শান্তি আলোচনা শুরু করবে কি না, সেটা এখনো স্পষ্ট নয়। সেটা যদি হয় তাহলে নিজেদের অবস্থানে অপূরণীয় দূরত্ব নিয়েই তাদের বসতে হবে। এ ক্ষেত্রে প্রধান একটা পার্থক্য হলো, জেলেনস্কি জোর দিচ্ছেন শান্তি আলোচনার আগে অবশ্যই রুশ সেনাদের ইউক্রেন থেকে প্রত্যাহার করে নিতে। অন্যদিকে পুতিন বলেছেন, রাশিয়া যুদ্ধবিরতিতে যেতে আগ্রহী, কিন্তু ইউক্রেন থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করবেন না।

চীনের মধ্যস্থতা সেই মৌলিক পার্থক্যকে সমাধান করতে পারবে কি না, তা এখনো পরিষ্কার নয়।

  • ডেনিয়েল উইলিয়ামস, ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকার সাবেক পররাষ্ট্রবিষয়ক প্রতিবেদক
    এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.