পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপি অংশ না নিলেও নানা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি আওয়ামী লীগ। জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে সব সিটিতেই জয় নিশ্চিত করতে ব্যাপক তৎপরতাও শুরু করেছে ক্ষমতাসীন দলটি। নির্বাচনকে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করার পাশাপাশি বেশি ভোটার উপস্থিতি নিশ্চিত করাও দলের জন্য কঠিন হয়ে পড়েছে।
তবে এই মুহূর্তে আওয়ামী লীগের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ দলীয় কোন্দল নিরসন, বিদ্রোহী প্রার্থী মোকাবিলা এবং মনোনয়নবঞ্চিত নেতাদের মাঠে নামানো। বিশেষ করে বরিশাল, গাজীপুর ও সিলেট– এই তিন সিটি নির্বাচনে দলীয় কোন্দল বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। গাজীপুর ও সিলেটে ‘বিদ্রোহী প্রার্থী’ সংকট তৈরি করেছে দলের জন্য। বরিশালে এই সংকট না থাকলেও মনোনয়নবঞ্চিত বিদায়ী মেয়রের অনুসারীদের নির্বাচনের মাঠে নামানো সম্ভব হয়নি এখন পর্যন্ত। আওয়ামী লীগ স্বস্তিদায়ক অবস্থানে রয়েছে রাজশাহী ও খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে।
আগামী ২৫ মে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। খুলনা ও বরিশালে নির্বাচন হবে আগামী ১২ জুন। আর ২১ জুন রাজশাহী ও সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ভোট হবে।
জানা গেছে, বরিশালে আওয়ামী লীগ মনোনীত মেয়র প্রার্থী নিয়ে অভ্যন্তরীণ কোন্দল সামলানো যাচ্ছে না। সেখানে মেয়র পদে বঙ্গবন্ধুর ভাগনে আবুল খায়ের আবদুল্লাহ খোকন সেরনিয়াবাতকে মনোনয়ন দেওয়ার পর দলের বিরোধ প্রকট আকার ধারণ করেছে। বিদায়ী মেয়র ও খোকনের ভাতিজা সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ মুখে ‘চাচাকে মেনে নেওয়ার’ কথা বললেও তাঁর অনুসারী কেউই এখন পর্যন্ত নির্বাচনী কাজে যুক্ত হননি। দু’জনই বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্য হওয়ায় তাঁদের মধ্যে মান-অভিমান ভাঙানোর দায়িত্ব কেন্দ্রীয় নেতারা নিতে চাইছেন না। এ ক্ষেত্রে দলীয় প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কিংবা পরিবারের অন্য কোনো প্রভাবশালী সদস্যের হস্তক্ষেপের অপেক্ষায় রয়েছেন দলের নীতিনির্ধারকরা। বর্তমানে বিদেশ সফররত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশে ফেরার পর এ বিষয়ে দিকনির্দেশনা পাওয়া যাবে বলে মনে করছেন তাঁরা।
এদিকে, গাজীপুরে ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থী বহিষ্কৃত মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের প্রার্থিতা বাতিল হলেও সেখানে আরও দু’জন প্রার্থী দলের জন্য প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়েছেন। জাহাঙ্গীরের মা জায়েদা খাতুন এবং আরেকজন বিদ্রোহী প্রার্থী মামুন মণ্ডল দলীয় প্রার্থী আজমত উল্লা খানের পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছেন। সেখানে দলের বিভক্তিও ভোটের মাঠের পরিস্থিতিকে জটিল করছে। এ ছাড়া সিলেটে দল মনোনীত প্রবাসী প্রার্থী আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীকে নিয়ে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের মধ্যে চাপা ক্ষোভের মধ্যেই সেখানে ‘বিদ্রোহী প্রার্থী’ হিসেবে আলোচনায় চলে এসেছেন সাবেক ছাত্রলীগ নেতা আব্দুল হানিফ কুটু। তাঁকে নিয়ে ভোটের মাঠে কিছুটা অস্বস্তিতে পড়েছে আওয়ামী লীগ। এই পরিস্থিতিতে তিন সিটিতে দলের পুরো শক্তিকে সক্রিয়ভাবে ভোটের মাঠে নামানো কঠিন হবে বলে মনে করছেন আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকরা।
এই অবস্থায় আওয়ামী লীগ তিন সিটির পরিস্থিতির চাপ শেষ পর্যন্ত কীভাবে সামলাবে– এ প্রশ্নে দলটির ভেতরও আলোচনা চলছে। তবে কেন্দ্র থেকে এরই মধ্যে এসব সংকট মোকাবিলায় তৎপরতা শুরু হয়েছে। সবার আগে অনুষ্ঠেয় গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন উপলক্ষে গঠিত কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক টিম এরই মধ্যে বৈঠক করে কর্মপরিকল্পনা চূড়ান্ত করছেন। দলীয় প্রচার-প্রচারণা সমন্বয়ের পাশাপাশি ভেতরে ভেতরে দ্বন্দ্ব-কোন্দল মেটানোর তৎপরতাও চলছে। আজমত উল্লা খানের পক্ষে নির্বাচনী প্রচার চালাতে ৯টি থানা এবং ৪৮০টি কেন্দ্রে কেন্দ্রভিত্তিক কমিটি গঠন করা হয়েছে।
বৃহস্পতিবার সিলেটে জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগ কর্মিসভা করেছে। সেখানে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক ও বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক শফিউল আলম চৌধুরী নাদেলসহ দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় নেতারা দলীয় কোন্দলের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে এসেছেন। অবিলম্বে এই কোন্দল নিরসনে সবাইকে মাঠে নামতে বলেছেন তাঁরা। শিগগির অন্য সিটি করপোরেশন নির্বাচনগুলো নিয়েও কেন্দ্রীয় তৎপরতা দৃশ্যমান হবে বলে জানান দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা।
জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য এবং গাজীপুরের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির প্রধান সমন্বয়ক মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বলেছেন, জাহাঙ্গীর আলমের বিষয়ে আওয়ামী লীগ মাথা ঘামাচ্ছে না। আমরা নিজেদের প্রার্থীকে জয়ী করতে তৎপর রয়েছি। তিনি বলেন, আগামী ৯ মের মধ্যে প্রস্তুতিমূলক সব কাজ শেষ করবেন তাঁরা। এরপর আনুষ্ঠানিক প্রচারণা কার্যক্রম শুরু হলেই দলীয় প্রার্থীকে জেতাতে সর্বাত্মকভাবে প্রচার-প্রচারণায় নামা হবে।
দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেন, আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগে পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচন দলের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দলীয় প্রার্থীদের বিজয়ী করতে সর্বস্তরের নেতাকর্মীকে ঐক্যবদ্ধভাবে মাঠে নামানো হবে।
গাজীপুর সিটি নির্বাচন
গাজীপুর সিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের মনোনয়ন বাতিল হয়ে যাওয়ার পরপরই দৃশ্যপট পাল্টে যেতে শুরু করেছে বলে দলীয় নেতাদের দাবি। ভোটযুদ্ধে নৌকার প্রার্থী আজমত উল্লা খানের জন্য বড় একটা বাধা ছিলেন জাহাঙ্গীর। নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে না পারলেও মা জায়েদা খাতুনকে নিয়ে জাহাঙ্গীর নির্বাচনের মাঠে থাকবেন– এমন ঘোষণায় মোটেও ভীত নয় আওয়ামী লীগ। ইতোমধ্যে জাহাঙ্গীরপন্থিদের অনেকেই নৌকার প্রার্থীর সঙ্গে এসে যোগ দিয়েছেন বলে জানান দলীয় নেতাকর্মীরা। বিদ্রোহী প্রার্থী জাহাঙ্গীরের মনোনয়নপত্র বাতিল হয়ে যাওয়ার পর আওয়ামী লীগ কিছুটা নির্ভার হলেও আজমত উল্লা খানের পথ এখনও নিষ্কণ্টক নয়।
জাহাঙ্গীরের মা জায়েদা খাতুন কিংবা আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী মামুন মণ্ডল নৌকার জয়ে তেমন কোনো প্রভাব ফেলবে না বলে মনে করছেন দলীয় নেতাকর্মীরা। তবে আজমত উল্লা খান কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীকেই দুর্বল মনে করতে নারাজ। গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ৩৫ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও আওয়ামী লীগের সাবেক বন ও পরিবেশ বিষয়ক উপ-কমিটির সদস্য মামুন মণ্ডল মেয়র পদে আটঘাট বেঁধেই নির্বাচনের মাঠে নেমেছেন। তিনি বলেন, মহানগরের বিশাল এক কর্মী-সমর্থক বাহিনীর সমর্থন নিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছি। তবে মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও নৌকার প্রার্থী আজমত উল্লা খান বলেন, আমার বিশ্বাস মামুন মণ্ডল দলের নেতৃত্বের প্রতি আস্থা রেখে তাঁর জায়গা থেকে সরে আসবেন।
গাজীপুর সিটি নির্বাচনে নৌকার প্রার্থীকে জয়ী করতে সব নেতাকর্মী ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন বলে জানান গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আতাউল্লাহ মণ্ডল। তিনি বলেন, নৌকার বিজয়ে দলের ভেতর কোনো বিভেদ থাকতে পারে না। থাকা উচিত নয়। আওয়ামী লীগের সব সহযোগী সংগঠানের নেতাকর্মীরা ইতোমধ্যে মাঠে নেমে পড়েছেন।
বরিশাল সিটি করপোরেশন
মেয়র পদে খোকন সেরনিয়াবাতকে মনোনয়ন দেওয়ার পর বরিশাল আওয়ামী লীগে বিরোধ প্রকট আকার ধারণ করেছে। খোকনের ভাতিজা বর্তমান মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ মনোনয়নবঞ্চিত হওয়ার পর দাবি করছেন– তিনি চাচাকে মেনে নিয়েছেন। তবে এখন পর্যন্ত তাঁর কোনো অনুসারী নির্বাচনী কাজে যুক্ত হননি।
অপরদিকে খোকনপন্থিদের দাবি, সাদিক নিয়ন্ত্রিত মহানগর আওয়ামী লীগের কমিটিকে তাঁরা বিশ্বাস করতে পারছেন না। প্রচারে নেমে কৌশলে খোকন সেরনিয়াবাতকে হারানো হতে পারে। তাঁরা মহানগর কমিটি ভেঙে দ্রুত আহ্বায়ক কমিটি গঠনের দাবি জানাচ্ছেন। ইসলামী আন্দোলনের দ্বিতীয় শীর্ষ নেতা সিনিয়র নায়েবে আমির মুফতি সৈয়দ মোহাম্মদ ফয়জুল করীম প্রার্থী হওয়ার নেপথ্যে সাদিক পরিবারের ষড়যন্ত্র রয়েছে বলে অভিযোগ খোকনপন্থিদের।
মহানগর আওয়ামী লীগ এবং সাদিকের বাবা হাসানাত আবদুল্লাহ নিয়ন্ত্রিত জেলা আওয়ামী লীগের কোনো স্তরের নেতাকর্মীরা খোকনের নির্বাচনী প্রচারে নেই। মহানগর যুবলীগ ছাড়া অপর কোনো অঙ্গ সংগঠনও নেই মেয়র প্রার্থীর পাশে। মহানগর-সদর আসনের সংসদ পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক শামীম এমপির অনুসারীদের নিয়ে নির্বাচনী প্রচার চালাচ্ছেন খোকন।
খোকনের ঘনিষ্ঠজন শহর আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মীর আমিন উদ্দিন মোহন বলেন, হাসানাত পরিবারকে তাঁরা কোনোভাবেই বিশ্বাস করতে পারছেন না। এর আগে বিভিন্ন নির্বাচনে কৌশলে নৌকাকে হারানোর অভিযোগ রয়েছে হাসানাত পরিবারের বিরুদ্ধে। খোকন সেরনিয়াবাত গত ২৪ এপ্রিল রাতে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে সার্বিক বিষয় অবহিত করেছেন।
এদিকে দুই পক্ষ পাল্টাপাল্টি কাউন্সিলর প্রার্থী দিচ্ছে। কয়েক মাস আগে সাদিকের উপস্থিতিতে এক অনুষ্ঠানে জেলা ছাত্রলীগের সহসভাপতি সাজ্জাদ সেরনিয়াবাতকে ২০ নম্বর ওয়ার্ডের হবু কাউন্সিলর হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়। সাজ্জাদের মতোই মেয়র সাদিকের অনুসারী অন্তত ১০ নেতা এক বছর আগেই হবু কাউন্সিলর হিসেবে নিজেদের ভাবতে শুরু করেন।
জানা গেছে, সাদিক মনোনীত কাউন্সিলর করা প্রার্থীর তালিকাও প্রায় চূড়ান্ত ছিল। সাদিকের মনোনয়ন পাওয়া মানেই জয় নিশ্চিত– পরিবেশটা এমনই ছিল। সাদিক মনোনয়ন না পাওয়ায় সব এলোমেলো হয়ে গেছে। স্বপ্নভঙ্গ হয়েছে সাদিক অনুসারী কাউন্সিলর প্রার্থীদেরও। এ সুযোগে ওয়ার্ডগুলোতে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন সাদিকবিরোধী গ্রুপের সম্ভাব্য প্রার্থীরা। এতে প্রত্যেক ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের ৩ থেকে ৫ জন কাউন্সিলর প্রার্থী হতে মাঠে নেমেছেন বলে জানা গেছে।
তবে বিভিন্ন সূত্র নিশ্চিত করেছে, আধিপত্য ধরে রাখতে প্রায় সব ওয়ার্ডে সাদিক অনুসারী কাউন্সিলর প্রার্থী দেওয়া হবে। খোকন সেরনিয়াবাত মেয়র নির্বাচিত হলে তাঁকে চাপে রাখা যাবে– এমন ভাবনাও আছে সাদিকপন্থিদের।
সিলেট সিটি করপোরেশন
সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নবঞ্চিত অনেক নেতা ধীরে ধীরে দলীয় প্রার্থী আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীর পক্ষে মাঠে নামছেন। তবে হঠাৎ করেই আলোচনায় চলে এসেছেন সাবেক ছাত্রলীগ নেতা আব্দুল হানিফ কুটু। গত বুধবার মেয়র পদে মনোনয়ন জমা দিয়েছেন তিনি। তাঁকে আওয়ামী লীগের ‘বিদ্রোহী’ বলে মনে করা হচ্ছে।
অপরদিকে কাউন্সিলর পদে প্রতিটি ওয়ার্ডে একক প্রার্থী দেওয়ার কোনো চিন্তা নেই ক্ষমতাসীন দলের। মহানগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আসাদ উদ্দিন আহমদ বলেন, সাবেক ছাত্রলীগ নেতার মেয়র পদে মনোনয়নপত্র জমাদান সম্পর্কে আমার কোনো বক্তব্য নেই। আমাদের লক্ষ্য, দলের মেয়র প্রার্থীকে বিজয়ী করা। কাউন্সিলর পদ নিয়েও কোনো মাথাব্যথা নেই। যে যার মতো নির্বাচন করবেন।
নির্বাচনে আনোয়ার ছাড়াও ১০ জন আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন। তবে তাঁরা কেউই দলের সিদ্ধান্তের বাইরে যাবেন না বলে জানান। কিন্তু হঠাৎ মনোনয়ন জমা দিয়ে আলোচনায় আসেন আশি ও নব্বই দশকের তুখোড় ছাত্রলীগ নেতা আব্দুল হানিফ কুটু। ১৯৮৬-৮৭ সালে ছাত্রলীগের ব্যানারে এমসি ইন্টারমিডিয়েট কলেজ ছাত্র সংসদে নির্বাচনে সাধারণ সম্পাদক ও ১৯৯১-৯২ সালে সরকারি কলেজ ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। পরে যুবলীগের রাজনীতির সঙ্গেও জড়িত ছিলেন। দীর্ঘদিন তিনি রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয় ছিলেন। মনোনয়নপত্র সংগ্রহ প্রসঙ্গে কুটু বলেন, ‘যে পদ্ধতিতে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বোর্ড সিলেট সিটিতে দলীয় প্রার্থী মনোনয়ন দিয়েছে, সেটা গ্রহণযোগ্য নয়। আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকর্মী আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে উৎসাহ দেওয়ায় আমি মনোনয়ন জমা দিয়েছি।’ টুকুকে অনেকেই হিসেবে নিচ্ছেন। গত সিটি নির্বাচনে দলের অনেকেই নৌকার পক্ষে কাজ করেননি। এবারও সে আশঙ্কা রয়েছে। বৃহস্পতিবার সিলেটে কর্মিসভায় দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেছেন, দলে খন্দকার মোশতাকের অনুসারী যেমন রয়েছে, তেমনি মুজিবাদর্শের লড়াকু এবং ত্যাগী কর্মীরাও রয়েছেন। গত নির্বাচনে ‘মোশতাক বাহিনীর’ কারণেই কামরানকে হারতে হয়েছিল। এদিকে ৪২টি ওয়ার্ডের মধ্যে অধিকাংশতেই আওয়ামী লীগের একাধিক প্রার্থী নির্বাচন করতে প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
রাজশাহী সিটি করপোরেশন
রাজশাহী সিটি নির্বাচনে মেয়র পদে কোনো সংকট নেই আওয়ামী লীগের। তবে কাউন্সিলর পদে অধিকাংশ ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের নেতারাই একে অপরের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার আশঙ্কায় দলটি কাউন্সিলর পদে কাউকেই মনোনয়ন দেবে না। শুধু মেয়র পদে জয় নিয়েই ভাবছে ক্ষমতাসীনরা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সিটি করপোরেশনের ৩০টি ওয়ার্ডের প্রায় প্রতিটিতেই আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা কাউন্সিলর পদে ভোট করার প্রস্তুতি নিয়েছেন। এ নিয়ে ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতাদের মধ্যে দ্বন্দ্বও চলছে।
শহরের ১৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর সাবেক যুবলীগ নেতা তৌহিদুল হক সুমনের বিরুদ্ধে কয়েক বছর ধরে মাঠ গুছিয়ে চলেছেন মহানগর যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আশরাফ হোসেন বাবু। এই ওয়ার্ডে যুবলীগ সভাপতি আব্দুল কুদ্দুস ভান্ডারীও নির্বাচন করবেন। এতে আওয়ামী লীগেরই তিনজন এবার ভোটযুদ্ধে অংশ নেবেন। সে ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের ভোট তিন ভাগ হবে। এই ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর বিএনপি নেতা নুরুজ্জামান টিটুও প্রার্থী হবেন। দলটির ভোট পড়বে একই ব্যালটে।
তবে যুবলীগ নেতা আশরাফ হোসেন বাবু বলেন, ‘কাউন্সিলর পদে দলীয় ইমেজ সামনে আসবে না। বরং ব্যক্তি ইমেজে ভোট হবে। মানুষ ব্যক্তিগত পছন্দ থেকে ভোট দেবেন। একাধিক প্রার্থী থাকলেও সমস্যা হবে না।’
নগরীর ২৭ নম্বর ওয়ার্ডে বর্তমান কাউন্সিলর মহানগর বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আনোয়ারুল আমিন আজম। এই ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের দু’জন প্রার্থী ভোট করবেন। তাঁরা হলেন মহানগর আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা নুরুল হুদা সরকার এবং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সহসভাপতি শফিউর রহমান শফি। একজন আওয়ামী লীগ নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, গতবার আওয়ামী লীগের একাধিক প্রার্থী থাকায় ভোট ভাগাভাগি হয়ে বিএনপি জিতে যায়। এবারও একাধিক প্রার্থী হলে বিএনপি এখানে জিতে যাবে।
শহরের ৮ নম্বর ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগ থেকে প্রার্থী হচ্ছেন বর্তমান কাউন্সিলর মাহবুবুল হক পাভেল। এখানে এ দলের আরও তিনজন প্রার্থী রয়েছেন। এই ওয়ার্ডে পাভেলকে জিততে হলে বিএনপির পাশাপাশি দলের তিন নেতাকেও মোকাবিলা করতে হবে।
এ বিষয়ে মহানগর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মোহাম্মদ আলী কামাল বলেন, ‘এখানে একক কাউকে মনোনয়ন দিলে সেটা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। প্রতিটি ওয়ার্ডেই তিন-চারজন করে আওয়ামী লীগ নেতা প্রার্থী হয়েছেন। তাই কাউকেই আমরা সমর্থন দেইনি। বর্তমান দলীয় কাউন্সিলরদেরও আমরা সমর্থন দিচ্ছি না। যিনি জিতে আসবেন, তিনিই আমাদের দলীয় প্রার্থী। মেয়রের বাইরে আমাদের কোনো ভাবনা নেই।’
খুলনা সিটি করপোরেশন
খুলনায় অধিকাংশ ওয়ার্ডেই নির্বাচন করছেন না বিএনপি নেতারা। এসব ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগ নেতারাই একে অন্যের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছেন। খুলনা নগরীর ৩১টি সাধারণ ওয়ার্ডের ২৫টিতেই কাউন্সিলর পদে আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা প্রার্থী হয়েছেন। সংরক্ষিত ১০টি ওয়ার্ডের প্রতিটিতেই আওয়ামী লীগ নেত্রীরাই একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী।
জানা গেছে, ২০১৮ সালের নির্বাচনে কেসিসির ৩১টি ওয়ার্ডের মধ্যে ১২টিতে আওয়ামী লীগ এবং ৯টিতে বিএনপি সমর্থিতরা কাউন্সিলর পদে জয়ী হন। বিজয়ী কাউন্সিলরদের মধ্যে চারজনই ছিলেন আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী। তাঁদের সাফল্যে উৎসাহিত হচ্ছেন অন্য নেতারা।
খুলনা মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এম ডি এ বাবুল রানা বলেন, ১৯, ২৪ ও ২৭ নং ওয়ার্ডে দল থেকে ৩ নেতাকে সমর্থন দেওয়া হয়েছে। বাকি ২৮টি ওয়ার্ডে প্রার্থিতা উন্মুক্ত রয়েছে। এখানে একাধিক নেতা প্রার্থী হলেও দলের আপত্তি নেই।
খুলনায় আওয়ামী লীগের নির্বাচনী কার্যক্রমের পুরোটাই পরিচালিত হচ্ছে মেয়র প্রার্থী তালুকদার আবদুল খালেককে কেন্দ্র করে। তপশিল ঘোষণার পর থেকে প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো ওয়ার্ডে কর্মিসভা অথবা অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময় সভা করছেন তিনি। সেখানে নগর নেতারা উপস্থিত থাকছেন।
আওয়ামী লীগের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির আহ্বায়ক কাজী আমিনুল হক জানান, থানা ও ওয়ার্ড নেতারা ঐক্যবদ্ধভাবে মেয়র প্রার্থীর পক্ষে মাঠে নেমেছেন। চলতি সপ্তাহের মধ্যে কেন্দ্রভিত্তিক কমিটি গঠন করা হবে।
নগরীর ২৫ ওয়ার্ডে আওয়ামী লগের একাধিক কাউন্সিলর প্রার্থী রয়েছেন। ১ নং ওয়ার্ডে বর্তমান কাউন্সিলর ও ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সদস্য আবদুর রাজ্জাকের প্রতিদ্বন্দ্বী হচ্ছেন ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি শাহাদাত মিনা। দু’জনই এলাকায় প্রচারণা চালাচ্ছেন। ভোটাররা জানান, ওয়ার্ডে আরও কয়েকজন প্রার্থী থাকলেও মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে তাদের দু’জনের মধ্যে। ২ নং ওয়ার্ডে বর্তমান কাউন্সিলর সাইফুল ইসলাম আওয়ামী লীগের সমর্থন প্রত্যাশী। তাঁর শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মনিরুজ্জামান মুকুল। এই ওয়ার্ডেও মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে তাঁদের দু’জনের মধ্যে।
৩ নং ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগ নেতা ও বর্তমান কাউন্সিলর আবদুস সালামের বিরুদ্ধে নির্বাচন করছেন ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মাকসুদ হাসান পিকু। এই ওয়ার্ডেও দ্বিমুখী লড়াই হবে। ১০, ১১ ও ১২ নং ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের তিনজন করে নেতা প্রচারণা চালাচ্ছেন। বাকি ওয়ার্ডগুলো ছয়টি বাদে অন্যগুলোতেও ক্ষমতাসীন দলের দুই বা আরও বেশি প্রার্থী মাঠে নেমেছেন। তবে ১৩, ১৫, ২৪, ২৫, ২৬ ও ২৭ নং ওয়ার্ডে একক প্রার্থী রয়েছে।
[প্রতিবেদনে তথ্য দিয়েছেন রাজশাহী, খুলনা, সিলেট ও বরিশাল ব্যুরো এবং গাজীপুর প্রতিনিধি]