এলডিসি থেকে উত্তরণের পরও যুক্তরাজ্য, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ায় শুল্কমুক্ত সুবিধা পাওয়ার আশ্বাস মিলেছে। যদিও মোট পোশাক রপ্তানির সাড়ে ১৬ শতাংশের গন্তব্য এই তিন দেশ।
স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা (এলডিসি) থেকে বেরিয়ে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে যুক্ত হওয়ার অপেক্ষায় আছে বাংলাদেশ। তারপর পণ্য রপ্তানিতে বিভিন্ন বাজারে শুল্কমুক্ত সুবিধাগুলো অব্যাহত থাকবে কি না, সেটি নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন তৈরি পোশাক খাতের রপ্তানিকারকেরা। তাঁদের জন্য সুসংবাদ, উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার পরও যুক্তরাজ্য ও কানাডায় শুল্কমুক্ত সুবিধা পাবে বাংলাদেশের পোশাক খাত। অন্যদিকে অস্ট্রেলিয়া আগে থেকেই শুল্কমুক্ত সুবিধা অব্যাহত রাখার আশ্বাস দিয়েছে। মোট তৈরি পোশাক রপ্তানির সাড়ে ১৬ শতাংশের গন্তব্য এই তিন দেশ।
তৈরি পোশাকের বড় বাজার হচ্ছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। এলডিসি থেকে উত্তরণের পর তিন বছর এই বাজারে শুল্কমুক্ত সুবিধা অব্যাহত থাকবে। তারপর শুল্কমুক্ত সুবিধা অব্যাহত রাখতে বাংলাদেশকে জিএসপি প্লাসের জন্য যোগ্যতা অর্জন করতে হবে। ২০২৪-৩৪ সালের জন্য জিএসপির নতুন নীতিমালার খসড়াও চূড়ান্ত করেছে ইউরোপীয় কমিশন। যদিও ইইউ পার্লামেন্টে সেটি এখনো অনুমোদিত হয়নি। খসড়াটি অনুমোদিত হলে বিধিনিষেধের কারণে বাংলাদেশ জিএসপি প্লাস পাবে না। পোশাক রপ্তানির অপর দুই বড় বাজার ভারত ও জাপানে এলডিসি থেকে উত্তরণের পর শুল্কমুক্ত সুবিধা অব্যাহত থাকবে, তেমন কোনো আভাস এখনো মেলেনি। ইইউ, ভারত ও জাপানেই রপ্তানি হওয়া মোট তৈরি পোশাকের সাড়ে ৫৫ শতাংশের গন্তব্য।
পোশাক খাত–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, যুক্তরাজ্য ও কানাডায় শুল্কমুক্ত সুবিধা পাওয়ার বিষয়টি অনেকটা মেঘ না চাইতেই বৃষ্টির মতো। এ জন্য সরকারকে কিছুই করতে হয়নি। অন্য দেশও একইভাবে শুল্কমুক্ত সুবিধা দিয়ে দেবে এমনটা ভাবা বোকামি হবে। তাই অন্য দেশগুলো থেকে এ ধরনের সুবিধা পেতে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে উদ্যোগী হয়ে ব্যবস্থা নিতে হবে।
জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান র্যাপিডের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুর রাজ্জাক বলেন, যেকোনো দেশের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) করতে গেলে ৫-১০ বছর সময় লেগে যাবে। সরকার ভারতের সঙ্গে সমন্বিত অর্থনৈতিক অংশীদারত্ব চুক্তি (সিইপিএ) করতে উদ্যোগ নিয়েছে। এটি করতেও এফটিএর মতোই সময় লাগবে। তাই জাপান ও ভারতের সঙ্গে বর্তমান শুল্কমুক্ত সুবিধাকে ২০২৬ সালের পর আরও তিন থেকে ছয় বছর বর্ধিত করতে উদ্যোগ নিতে হবে। অন্যদিকে ইইউতে জিএসপি প্লাস পেতে সরকারি পর্যায়ে আলোচনা দরকার।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যানুযায়ী, গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৪ হাজার ৬৯৯ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়েছে। তার মধ্যে মোটাদাগে শুল্কমুক্ত সুবিধায় ইইউতে ২ হাজার ৩৫৪ কোটি ডলার, যুক্তরাজ্যে ৫০৩, কানাডায় ১৫৫, জাপানে ১৬০, অস্ট্রেলিয়ায় ১১৫, ভারতে ১০১ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়েছে।
সবকিছু ঠিক থাকলে ২০২৬ সালে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে যুক্ত হবে বাংলাদেশ। ইইউর মতো যুক্তরাজ্যও আগেই ঘোষণা দিয়েছিল তারাও ২০২৯ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশকে শুল্কমুক্ত সুবিধা দেবে। এদিকে দেশটির সরকার সম্প্রতি উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য ডেভেলপিং কান্ট্রিস ট্রেডিং স্কিম (ডিসিটিএস) চালু করেছে। এর আওতায় বাংলাদেশের তৈরি পোশাকসহ ৯২ শতাংশ পণ্য শুল্কমুক্ত সুবিধা পাবে।
কানাডা সরকার উন্নয়নশীল দেশগুলোকে জেনারেল প্রেফারেনশিয়াল ট্যারিফ (জিপিটি) স্কিমের আওতায় শুল্কমুক্ত বাজার সুবিধা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই স্কিমের আওতায় তৈরি পোশাক উৎপাদনের নিয়ম শিথিল করাসহ অন্যান্য পণ্যেও দেশটিতে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার দেওয়া হবে। কানাডার পার্লামেন্ট গত ৮ জুন একটি ফাইন্যান্স বিল পাস করেছে; সেখানে জিপিটি স্কিমের মেয়াদ ২০৩৪ সাল পর্যন্ত বাড়ানো হয়।
বাংলাদেশ ২০০৩ সাল থেকে লিস্ট-ডেভেলপমেন্ট কান্ট্রি ট্যারিফ (এলডিসিটি) স্কিমের আওতায় কানাডায় সম্পূর্ণ শুল্কমুক্ত ও কোটামুক্ত প্রবেশাধিকার সুবিধা ভোগ করছে। এলডিসিটি স্কিম জিপিটির আওতায় পড়ে। জিপিটি স্কিম প্রতি ১০ বছর পরপর নবায়ন করা হচ্ছে। স্কিমটির বর্তমান সংস্করণের মেয়াদ ২০২৪ সালে শেষ হবে।
কানাডার এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি ফারুক হাসান এক বিবৃতিতে গত রোববার বলেন, ২০৩৪ সাল পর্যন্ত কানাডার শুল্কমুক্ত বাজারসুবিধা পাবে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক। কানাডা মোট পোশাকের মাত্র ১৪ শতাংশ বাংলাদেশ থেকে আমদানি করে। তার মানে হচ্ছে, এ বাজারে বাংলাদেশের আরও বড় সম্ভাবনা আছে। জিপিটি প্লাস সুবিধা নিয়ে দেশটিতে রপ্তানি আরও বাড়াতে আমাদের কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া উচিত।
বছর তিনেক আগে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) এক প্রতিবেদন উঠে আসে, এলডিসি থেকে উত্তরণে ঘটলে রাতারাতি বাজারসুবিধা হারিয়ে তীব্র প্রতিযোগিতার মুখে পড়বে বাংলাদেশের রপ্তানিকারকেরা। তাতে বাড়তি শুল্কের চাপে পড়ে রপ্তানি আয় ৫৩৭ কোটি ডলার কমতে পারে। যদিও ইইউ, যুক্তরাজ্য ও কানাডার কারণে সেই চাপ কিছুটা কমেছে। তবে পুরোপুরি সমস্যার সমাধান হয়নি।
জানতে চাইলে বিজিএমইএর সহসভাপতি শহিদউল্লাহ আজিম বলেন, অস্ট্রেলিয়ার পার্লামেন্টের সদস্যরা আমাদের আশ্বস্ত করেছেন, তাদের দেশে শুল্কমুক্ত সুবিধা ২০৩২ সাল পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে। অবশ্য এখনো তারা আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয়নি। ইইউ, ভারত ও জাপানের শুল্কমুক্ত সুবিধা উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার পর ছয় বছর পর্যন্ত অব্যাহত রাখার বিষয়ে কূটনৈতিক তৎপরতা প্রয়োজন। তিনি আরও বলেন, ২০২৬ সালের পর শুল্কমুক্ত সুবিধা অব্যাহত রাখতে সরকারকে আরও তৎপর হতে হবে। ব্যবসায়ীদের জন্য নয়, দেশের অর্থনীতির স্বার্থে এটা করতে হবে।