প্রিলিমিনারি, লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা শেষে চাকরিতে নিয়োগের জন্য প্রাথমিকভাবে নির্বাচিত হন আশরাফুল ইসলাম। তালিকার শুরুর রোল নম্বরটিই তাঁর। তবে শেষ পর্যন্ত তিনি নিয়োগপত্র পাননি।
সাধারণ বীমা করপোরেশনে জুনিয়র অফিসার (গ্রেড-১০) পদে নিয়োগের জন্য প্রাথমিকভাবে নির্বাচিত মোট ৬৭ প্রার্থীর এই তালিকা গত ১৫ জানুয়ারি প্রকাশিত হয়।
তালিকা প্রকাশের বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়, নিয়োগের জন্য প্রাথমিকভাবে নির্বাচিত প্রার্থীদের প্রাক্–পরিচিতি, পূর্বকার্যকলাপ-সম্পর্কিত পুলিশ বিভাগের সন্তোষজনক প্রতিবেদন প্রাপ্তিসহ অন্যান্য দলিল যাচাইসহ এ-সংক্রান্ত সরকারি বিধি পরিপালন সাপেক্ষে নিয়োগের পরবর্তী কার্যক্রম গ্রহণ করা হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী আশরাফুল বলেন, প্রাথমিকভাবে নির্বাচিত হওয়া সত্ত্বেও তিনি কেন নিয়োগপত্র পাননি, সে বিষয়ে সাধারণ বীমা করপোরেশনের কর্মকর্তারা আনুষ্ঠানিকভাবে তাঁকে কিছু জানাননি। মৌখিকভাবে বলেছেন, তাঁর নিয়োগপত্র ইস্যু হয়নি। নিয়োগপত্র ইস্যু না হওয়ার কারণ হিসেবে তাঁরা অনানুষ্ঠানিকভাবে বলেছেন, তাঁর বিষয়ে গোয়েন্দা প্রতিবেদন হয়তো সন্তোষজনক নয়। কর্মকর্তারা আকার-ইঙ্গিতে তাঁকে বলেছেন, তিনি হয়তো কার্যক্রম নিষিদ্ধ হওয়া আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত—এমন কিছু গোয়েন্দা প্রতিবেদনে থাকতে পারে।
আশরাফুল বলেন, ‘আমি আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত, তা কেউ প্রমাণ করতে পারবেন না। ২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী সরকার পতনের আন্দোলনে আমি সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছি। আমার ফেসবুকে যেকেউ ঢুকলেই তা বুঝতে পারবেন। আমার নামে কোনো ফৌজদারি মামলা নেই। আমি সাজাপ্রাপ্ত আসামি নই। তাই কেন আমি নিয়োগপত্র পেলাম না, তা বুঝতে পারছি না।’
চাকরিতে নিয়োগ ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে রাজনৈতিক পরিচয় জানতে চাওয়ার বিধান বাতিল করার সিদ্ধান্ত গত জুলাইয়ের মাঝামাঝি নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে এই সিদ্ধান্ত হয়।
সাধারণ বীমা করপোরেশনের গত ২২ জুলাইয়ের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, প্রাক্–পরিচিতি ও পূর্বকার্যকলাপ যাচাই শেষে কর্তৃপক্ষের অনুমোদনক্রমে নির্বাচিত প্রার্থীদের স্থায়ী-বর্তমান ঠিকানায় নিয়োগপত্র পাঠানো হয়েছে। ৫ আগস্টের মধ্যে নিয়োগপত্র না পেলে করপোরেশনের মানবসম্পদ বিভাগে যোগাযোগ করতে পরামর্শ দেওয়া হয়।
আশরাফুল বলেন, তাঁর পরিচিত প্রার্থীরা নিয়োগপত্র পাচ্ছিলেন। কিন্তু তিনি না পাওয়ায় রাজধানীর দিলকুশায় সাধারণ বীমা করপোরেশনের প্রধান কার্যালয়ে মানবসম্পদ বিভাগে যোগাযোগ করেন। তাঁকে জানানো হয়, তাঁর নিয়োগপত্র ইস্যু হয়নি। এই চাকরিতে যোগদানের তারিখ ছিল ১২ আগস্ট। পরিচিত ব্যক্তিরা যোগ দিয়েছেন। তিনি পারেননি।
সাধারণ বীমা করপোরেশন একমাত্র রাষ্ট্রীয় সাধারণ বীমা প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানটি অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণ ও তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয়। আশরাফুল নিয়োগপত্র না পাওয়ার বিষয়টি নিয়ে ৬ আগস্ট ও ৭ আগস্ট সাধারণ বীমা করপোরেশনে দুটি চিঠি দিয়েছেন।
৬ আগস্ট দেওয়া চিঠিতে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সদস্য অধ্যাপক মোহাম্মদ তানজীমউদ্দিন খান নিয়োগপত্র প্রাপ্তির বিলম্বের বিষয়টি সদয় বিবেচনার অনুরোধ করেছেন।

আর ৭ আগস্টের চিঠিতে আশরাফুল লিখেছেন, ২০২৩ সালে চাকরির বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। প্রিলিমিনারি, লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার পর প্রকাশিত ফলাফলে তিনি প্রাথমিকভাবে নির্বাচিত হন। কিন্তু নিয়োগপত্র পাননি। মানবসম্পদ বিভাগে যোগাযোগ করে জানতে পারেন, তাঁর নামে কোনো নিয়োগপত্র ইস্যু করা হয়নি। নিয়োগপত্র না পাওয়ায় তিনি মনে করছেন, পুলিশ ভেরিফিকেশনে কোনো কারণে বিরূপ মন্তব্য করা হয়েছে, যা অত্যন্ত দুঃখজনক ও অনভিপ্রেত। তাঁর বিরুদ্ধে কোনো অপরাধের রেকর্ড নেই। তিনি চিঠিতে আবার পুলিশ ভেরিফিকেশন করার জন্য অনুরোধ জানান।
জানতে চাইলে সাধারণ বীমা করপোরেশনের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জয়নুল বারী বলেন, বোর্ড সভায় বিষয়টি উত্থাপনের আগে তিনি এ নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে চান না।
তবে সাধারণ বীমা করপোরেশনের উচ্চপর্যায়ের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বিরূপ কোনো মন্তব্য থাকতে পারে। গোয়েন্দা প্রতিবেদনকে আমলে নেওয়া হয়। তবে প্রতিবেদনে কী লেখা, তা তিনি জানেন না।
আশরাফুল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং বিভাগ থেকে এমবিএ করেছেন ২০২১ সালে। তিনি কুমিল্লার বড়শালঘর ইউ এম এ উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি ও ঢাকা কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। নিয়োগপত্র না পাওয়ার বিষয়টি নিয়ে তিনি ১৪ আগস্ট তাঁর ফেসবুকে একটি দীর্ঘ পোস্ট দিয়েছেন। পোস্টে লিখেছেন, ‘ক্যাম্পাসে আন্দোলন সংগ্রাম করতে গিয়ে ছাত্রলীগের হাতে মার খেলাম হিসাব ছাড়া। ঢাবির অনাবাসিক ছাত্র ছিলাম। তাই জাস্ট হলে থাকার জন্য হলেও আমাকে কোনদিন ছাত্রলীগের মিছিল, মিটিংয়ে যেতে হয়নি, এবং আমি এগুলো করবো না বলেই হলে থাকিনি।…আমার ফ্যামিলির অন্য কারও রাজনীতি নিয়ে কোন মাথাব্যথাও নাই। আমি উল্টো আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগের অপকর্মের বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগ্রামে সবসময় সক্রিয় ছিলাম, সোচ্চার ছিলাম।’
বিভিন্ন আন্দোলনে অংশ নেওয়ার প্রমাণ হিসেবে ফেসবুক পোস্টে নানা ছবি-ভিডিও যুক্ত করেছেন আশরাফুল। পোস্টে তিনি আরও লিখেছেন, ‘ছাত্রলীগের হাতে মার খাওয়া আর হাসিনা পিরিয়ডে পুলিশের মার খাওয়া, বা টিয়ারশেল খাওয়ার হিসাব দিতে গেলে তা খুব দীর্ঘ উপন্যাস হয়ে যাবে। আর ২৪ এর হাসিনা পতনে রাস্তায় তো ছিলামই। অনলাইনে এই আন্দোলনের প্রথম থেকে ছিলাম। ১৩/১৪ তারিখ থেকে রাস্তায়। ১৭ জুলাই ঢাবি ক্যাম্পাসে মল চত্বরে পুলিশের পেটানো খাইলাম। পা কাটালাম। টিয়ারশেল খাইলাম। পুরো আগস্টের ৫ পর্যন্ত রাস্তায় ছিলাম। সেই আমাকে আওয়ামী ট্যাগ দিতে পারে কীভাবে সেটা আমার মাথায় আসতেছে না। আর যদি সেটা না হয় তাহলে কেনো, কিসের ভিত্তিতে আমাকে চাকরিতে যোগদান করতে দিবেনা সেটা আমি বুঝলাম না। আমার এপয়েন্টমেন্ট লেটার ছাড়বে না সেটা কীভাবে সম্ভব!!!!’
আশরাফুলের গ্রামের বাড়ি কুমিল্লা। তাঁর বাবা মো. মিজানুর রহমান। আশরাফুল জানান, তাঁর বাবা দীর্ঘদিন সৌদি আরব ছিলেন। ২০১৯ সালে দেশে ফেরার পর থেকে তিনি অসুস্থ। মা মিনা রহমানও অসুস্থ। দুই বোনের মধ্যে একজনের বিয়ে হয়েছে। আরেকজন পড়াশোনা করেছেন। বাবা, মা, বোন ও স্ত্রীকে নিয়ে তিনি ঢাকার বাসাবো এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকেন। তিনি বর্তমানে টিউশনি ও ফ্রিল্যান্সিং করে সংসার চালাচ্ছেন। তিনিই পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী। আর গ্রামের বাড়ির কৃষিজমি থেকে কিছু অর্থ আসে।
আশরাফুলের বর্তমান বয়স ৩০ বছর ৬ মাস। তিনি বিয়ে করেছেন গত বছরের ৯ মার্চ। আশরাফুল জানান, তিনি ৪৩তম বিসিএসের মৌখিক পরীক্ষায় বাদ পড়েছেন। ৪৫তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষায় পাস করেছেন। মৌখিক পরীক্ষা এখনো হয়নি। আর ৪৬তম বিসিএস পরীক্ষায় অংশ নিতে পারেননি।
আক্ষেপ নিয়ে আশরাফুল বলেন, ‘সংসারের দায়িত্ব আমার কাঁধে। সরকারি চাকরির বয়সও প্রায় শেষের দিকে। তার চেয়েও বড় কথা, মেধার ভিত্তিতে একজন প্রার্থী কেন চাকরি পাবেন না?’
মানসুরা হোসাইন
ঢাকা