তাপপ্রবাহ ৬২ জেলায়, বেড়েছে তাপজনিত রোগ

0
14
রোদে-গরমে ঘেমে-নেয়ে একাকার। এরই মধ্যে ধান শোকানো ,বস্তা বন্দী ও গুদামে ভর্তির কাজে ব্যস্ত কয়েকজন শ্রমিক। কাজের ফাঁকে তৃষ্ণা মেটাচ্ছেন শ্রমিক সর্দ্দার মিরাজুল ইসলাম। সদর উপজেলার হাতিকাটা এলাকা। ১০ মে

টানা চার দিন ধরে তাপপ্রবাহ বইছে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। শুরু হয়েছিল বুধবার। দিন দিন এর পরিধি বেড়েছে। শুক্রবার দেশের ৪৫ জেলায় বয়ে গিয়েছিল তাপপ্রবাহ। আজ শনিবার এ তাপ ছড়িয়ে পড়ে দেশের ৬২ জেলায়। আগের দিনের চেয়ে গতকাল বেড়েছে তীব্র থেকে অতি তীব্র তাপপ্রবাহের এলাকাও।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের সূত্র বলছে, আগামীকাল রোববারও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে তাপপ্রবাহ বয়ে যেতে পারে। তবে সেই সঙ্গে দুই বিভাগে সামান্য বৃষ্টির সম্ভাবনার কথাও বলেছে আবহাওয়া অফিস। তাতে তাপমাত্রার খুব বেশি হেরফের হওয়ার সম্ভাবনা কম।

এদিকে টানা এই তাপপ্রবাহে বেড়ে গেছে ডায়রিয়াসহ নানা অসুখ। শুধু রাজধানী নয়, দেশের বিভিন্ন স্থানে গরমের কারণে জ্বর, ডায়রিয়াসহ নানা রোগ বেড়ে গেছে। চিকিৎসকেরা বলছেন, এখন যে অবস্থা, তাতে ঝুঁকিতে আছে শিশু ও বয়স্ক ব্যক্তিরা। গরমের এ সময়ে তাঁদের যত্নে নজর দিতে হবে। এ ছাড়া বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি এবং গর্ভবতী নারীর স্বাস্থ্যের দিকেও বিশেষ নজর দেওয়া দরকার।

সিলেট ও সুনামগঞ্জ বাদ দিয়ে আজ দেশের ৬২টি জেলায় মৃদু থেকে তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে যায়। এর মধ্যে আজ চুয়াডাঙ্গায় এ বছরের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের এ জেলায় টানা তৃতীয় দিনের মতো দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় গতকাল। কয়েক দিনের মৃদু, মাঝারি ও তীব্র তাপপ্রবাহের পর আজ চুয়াডাঙ্গার ওপর দিয়ে অতি তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে গেছে। গরমে হাঁসফাঁস অবস্থা চারদিকে, কোথাও স্বস্তি নেই। আগামীকাল এ জেলায় তাপমাত্রা খানিকটা বাড়তে পারে—এমনটাই পূর্বাভাস আবহাওয়া অফিসের।

প্রখর রোদ থেকে বাঁচতে তোয়ালে মাথায় দিয়ে সড়ক পার হচ্ছেন এক ব্যক্তি । নওয়াববাড়ী মোড় , বগুড়া শহর,১০ মে

আজ অন্তত ৭ জেলায় তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে যায়। আগের দিন শুক্রবার শুধু রাজশাহী ও চুয়াডাঙ্গাতেই তীব্র তাপপ্রবাহ ছিল। আজ চুয়াডাঙ্গা ছাড়া রাজশাহী, ঢাকা, টাঙ্গাইল, মানিকগঞ্জ, ফরিদপুর, সিরাজগঞ্জ, যশোর জেলার ওপর দিয়ে তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে যায়।

দেশের উত্তরাঞ্চল এমনিতেই খরাপ্রবণ অঞ্চল। সেখানে বৃষ্টি অপেক্ষাকৃত কম হয়। গরমের তীব্রতা তাই উত্তরের জনপদে অনেকটা বেশি। টানা কয়েক দিনের তাপ ভোগাচ্ছে এ জনপদের সব মানুষকেই।

আজ বেলা ১১টার দিকে রাজশাহী নগরের শহীদ এ এইচ এম কামারুজ্জামান চত্বরে একটি গামছা মাথায় জড়িয়ে বসে ছিলেন রিকশাচালক মনোয়ার হোসেন। লম্বা হাতার একটি গেঞ্জিও দেখা গেল তাঁর গায়ে। জানালেন, রোদের তাপ শরীরের যেখানে পড়ছে, সেখানেই যেন পুড়ে যাচ্ছে। তাই এই প্রতিরোধব্যবস্থা। দুই দিন আগেও এত তাপ ছিল না। এখন রিকশার হ্যান্ডলেও হাত রাখা যাচ্ছে না।

ট্রেনকে সংকেত দেওয়ার কাজে ব্যবহৃত পতাকা দিয়ে রোগ থেকে বাঁচার চেষ্টা করছেন গেটম্যান। রাজশাহী নগরের রেলগেট এলাকা থেকে তোলা। ১০ মে
ট্রেনকে সংকেত দেওয়ার কাজে ব্যবহৃত পতাকা দিয়ে রোগ থেকে বাঁচার চেষ্টা করছেন গেটম্যান। রাজশাহী নগরের রেলগেট এলাকা থেকে তোলা। ১০ মে

রাজশাহী নগরীর বিভিন্ন স্থানে রোদের তাপ থেকে বাঁচতে ছাতা, কেউ ক্যাপ (টুপি), এমনকি বাজারের ব্যাগও মাথায় দিয়ে কিছুটা স্বস্তি খুঁজতে দেখা গেছে। শ্রমজীবী মানুষেরা বারবার কাজের ফাঁকে ঘাম মুছছিলেন আর পানি পান করছিলেন। অসহনীয় তাপমাত্রায় বাইরে মানুষও কম দেখা গেছে।

তাপ বেশি, তবে অস্বাভাবিক নয়

একটু প্রশান্তির আশায় কীর্তনখোলা নদীর তীরে সেতুর উপর বট গাছের ছায়ায় বিশ্রাম করছে মানুষ। চাঁদমারি খেয়াঘাট, বরিশাল নগর, ১০ মে
একটু প্রশান্তির আশায় কীর্তনখোলা নদীর তীরে সেতুর উপর বট গাছের ছায়ায় বিশ্রাম করছে মানুষ। চাঁদমারি খেয়াঘাট, বরিশাল নগর, ১০ মে

আবহাওয়া অধিদপ্তর চলতি মাসের শুরুতেই দেওয়া মাসের দীর্ঘমেয়াদি পূর্বাভাসে বলেছিল, চলতি মাসে এক থেকে একাধিক তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে যেতে পারে। তবে বছরের সবচেয়ে উষ্ণ মাস এপ্রিল কিন্তু অপেক্ষাকৃত কম উষ্ণ ছিল। মে মাসের শুরুটাও সহনীয় ছিল অনেকটাই। তবে গত বুধবার থেকে তাপপ্রবাহ বেড়ে গেছে ব্যাপকভাবে। এ অবস্থায় জনজীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। তবে আবহাওয়াবিদেরা বলছেন, দেশের প্রায় প্রতিটি এলাকায় তাপপ্রবাহ বয়ে যাওয়ার এ ঘটনা মোটেও নতুন নয়। আবার এই মে মাসেই কিন্তু দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রার রেকর্ড আছে বলে স্মরণ করিয়ে দেন আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ মুহাম্মদ আবুল কালাম মল্লিক। তিনি আজ সন্ধ্যায় প্রথম আলোকে বলেন, দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ তাপমাত্রার রেকর্ড ১৯৭২ সালের ১৮ মে। ওই দিন তাপমাত্রা ছিল ৪৫ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

দীর্ঘ সময় ধরে দিনে সূর্যের তাপ, বাতাসের কম গতিবেগ, দক্ষিণ থেকে আসা জলীয় বাষ্পের কমতি, বৃষ্টি না থাকা—এসব কারণেই তাপপ্রবাহ এমন বেড়ে গেছে বলে জানাচ্ছেন আবহাওয়াবিদেরা। আর হঠাৎ তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় বেড়ে গেছে রোগও।

ডায়রিয়া বাড়ছে

বুধবার থেকে টানা তাপপ্রবাহ শুরু হলেও ঢাকার আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) ঢাকা হাসপাতালে রোগীর সংখ্যা তেমন বাড়েনি। তবে আজ হঠাৎ করেই রোগীর সংখ্যা বেড়ে যায় বলে জানান হাসপাতালের ক্লিনিক্যাল লিড ডা. শোয়েব বিন ইসলাম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‌আজ (গতকাল) হঠাৎ আগের দিনের চেয়ে অন্তত ১০০ রোগী বেড়েছে। গরম কয়েক দিন ধরেই বাড়ছে। তবে আজ রোগীর সংখ্যা ছিল অপেক্ষাকৃত বেশি। অবশ্যই গরমের কারণে এমনটা হচ্ছে।

ঢাকার পাশাপাশি বরিশাল ও কুড়িগ্রামেও ডায়রিয়ার রোগীর সংখ্যা বাড়ছে বলে জানান ডা. শোয়েব।

বয়স্ক ব্যক্তিদের চেয়ে এ সময় শিশুদের সমস্যা অপেক্ষাকৃত বেশি হয়। আর এ সময় তারা যথেষ্ট সংখ্যায় আক্রান্তও হচ্ছে নানা রোগে—এ তথ্য জানান দেশের খ্যাতনামা শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আবিদ হাসান মোল্লা। তিনি বলেন, অত্যধিক গরমের কারণে তাপমাত্রা বেড়ে জ্বর হতে পারে, হিটস্ট্রোক হতে পারে, বমি হতে পারে। এ সময় বড় সমস্যা পানিশূন্যতা। আর এর কারণেই প্রস্রাব ঘন হয়ে যেতে পারে।

তীব্র গরমে হাঁসফাঁস করছে মানুষ। অনেকেই ছুটছে সড়কের পাশে ফুটপাতের শরবতের দোকানে। তবে এসব পানীয় থেকে হতে পারে ডায়রিয়া।  জামে মসজিদ সড়ক, নোয়াখালী্ছ ১০ মে
তীব্র গরমে হাঁসফাঁস করছে মানুষ। অনেকেই ছুটছে সড়কের পাশে ফুটপাতের শরবতের দোকানে। তবে এসব পানীয় থেকে হতে পারে ডায়রিয়া। জামে মসজিদ সড়ক, নোয়াখালী্ছ ১০ মে

অধ্যাপক মোল্লা আজ যশোরের কয়েকটি গ্রামে রোগী দেখেছেন। তিনি বলেন, শহরের মতো গ্রামেও শিশুদের মধ্যে গরমজনিত রোগ বেড়ে গেছে।

গরমের সময় দিনের বেলা, বিশেষ করে দুপুর ১২টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত খুব প্রয়োজন না থাকলে শিশু ও বয়স্ক ব্যক্তিদের বাইরে না যাওয়াই শ্রেয় বলে পরামর্শ দেন আবিদ হাসান মোল্লা। শিশুদের বারবার পানি খাওয়ানো, সম্ভব হলে ডাবের পানি পান করানো দরকার। তবে বোতলজাত কোমল পানীয়, আইসক্রিম, রাস্তায় বিক্রি হওয়া শরবত পরিহার করা ভালো বলে মনে করেন তিনি। বিশেষ করে রাস্তায় শরবতের কারণে পেটের পীড়া বাড়ছে বলে ধারণা তাঁর।

কত দিন থাকবে তাপ

আবহাওয়ার বার্তা অনুযায়ী, কাল রোববারও দেশের বিভিন্ন স্থানে তাপপ্রবাহ বয়ে যাবে। তবে এর পরিধি সামান্য কমতে পারে বলে মনে করেন আবহাওয়াবিদ বজলুর রশীদ। তিনি আজ বলেন, রোববার তাপপ্রবাহ থাকবে। এর পরিধি একই রকম বা কিছুটা কমতে পারে। তবে সোমবার দেশের কয়েকটি স্থানে বৃষ্টি হতে পারে। এখন যে তাপ, তা হঠাৎ করেই কমবে না। এর জন্য ঠান্ডা বায়ুর প্রবাহ দরকার। এটি এলে ধীরে ধীরে তাপ কমতে থাকবে এবং বৃষ্টির জন্য মেঘমালা সৃষ্টি হবে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.