তানিয়ার মৃত্যু ঠেকানো যায়নি, এমন অবহেলায় অনেকে

0
282
২০ বছর বয়সী তানিয়ার শয্যা ঘিরে চিকিৎসক

অন্তঃসত্ত্বা নারীকে সন্তান প্রসবের আগে অন্তত চারবার চিকিৎসাসেবা নেওয়া উচিত। এ সময় ৩১ শতাংশ মাতৃমৃত্যু হয় রক্তক্ষরণে। গত পাঁচ বছরে হাসপাতালে সন্তান প্রসব বেড়েছে।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ২০ বছর বয়সী তানিয়ার শয্যা ঘিরে চিকিৎসক, নার্সদের ভিড়। যন্ত্রণায় কাতরাতে থাকা সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা এই মায়ের কষ্ট উপশমের চেষ্টা চলছিল। কিন্তু সংকটের তুলনায় অপ্রতুল সেবায় বাঁচানো গেল না তাঁকে। হাসপাতালের গাইনি ওয়ার্ডে ২৩ মে মৃত্যু হয় তাঁর।

ঘটনার সময় এই প্রতিবেদক সেখানে উপস্থিত ছিলেন। কর্তব্যরত চিকিৎসক নাজনীন সুলতানা বলেন, বিকেল চারটায় তানিয়াকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়, পাঁচটায় তিনি মারা যান। তিনি অ্যান্টেপারটাম হেমোরেজ (এপিএইচ) বা গর্ভকালীন অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মারা গেছেন।

হাসপাতালের শয্যায় তানিয়ার হাড্ডিসার দেহে কিছুটা উঁচু পেট জানান দিচ্ছিল, তাঁর দেহে আরেকটা প্রাণ ছিল। মায়ের সঙ্গে সেই সন্তানেরও বিদায় হয়েছে। বৈদ্যুতিক পাখার বাতাসে উড়তে থাকা তানিয়ার চুলগুলোকেই তখন শুধু সজীব মনে হচ্ছিল। মেয়েটির শয্যার কাছে দাঁড়িয়ে মনে অনেক প্রশ্ন জাগছিল। ঠিক কী কী কারণে তাঁর মৃত্যু হলো?

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের তথ্যমতে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত চার মাসে গাইনি বিভাগে মোট ৩ হাজার ২৯৫ সন্তান প্রসব হয়। এর মধ্যে ৩৬ জন মা ও ১০২টি নবজাতকের মৃত্যু হয়। আর মৃত অবস্থায় জন্ম হয় ৫২২ শিশুর।

জানা গেল, কৈশোর পেরোতে না পেরোতে বিয়ে, দুই বছরের কম সময়ের মধ্যে দুবার গর্ভধারণ, সময়মতো চিকিৎসা না পাওয়া—সব মিলিয়ে অযত্ন-অবহেলায় তাঁর মৃত্যু হয়েছে। অথচ চিকিৎসকের ভাষায়, তানিয়ার সমস্যা ছিল প্রতিরোধযোগ্য।

তানিয়ার শ্বশুর-শাশুড়ির ভাষ্য, চাঁদপুর থেকে ঢাকায় আসার পথে বারবার হাসপাতাল বদল করতে হয়েছে, যথাযথ চিকিৎসা পাননি তানিয়া। চিকিৎসকদের ভাষ্য, অনেক পরিবার শেষ সময়ে অন্তঃসত্ত্বা মাকে হাসপাতালে আনে, তখন মা ও গর্ভের সন্তানকে বাঁচানো কঠিন হয়ে যায়।

বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপ (বিডিএইচএস) প্রতিবেদন অনুসারে, চারবার বা এর বেশি গর্ভকালীন সেবা নেওয়ার হার আগের তুলনায় ৫ শতাংশ কমে ৪১ শতাংশে নেমেছে।

আজ ২৮ মে নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস উপলক্ষে ২৩ মে তথ্য সংগ্রহের কাজে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে এমন দৃশ্য দেখতে পান এই প্রতিবেদক। এবার দিবসটির প্রতিপাদ্য, ‘গর্ভকালে চারবার সেবা গ্রহণ করি, নিরাপদ মাতৃত্ব নিশ্চিত করি’।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের তথ্যমতে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত চার মাসে গাইনি বিভাগে মোট ৩ হাজার ২৯৫ সন্তান প্রসব হয়। এর মধ্যে ৩৬ জন মা ও ১০২টি নবজাতকের মৃত্যু হয়। আর মৃত অবস্থায় জন্ম হয় ৫২২ শিশুর।

২০২১ সালের বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকসের তথ্য অনুসারে, দেশে প্রতি লাখ জীবিত শিশু জন্ম দিতে গিয়ে ১৬৮ মা মারা যায়।

না খাইতে চাইলে কী করব! আমার ঘরে যা ছিল, তা তো দেওয়া হইছেই।

তানিয়ার শ্বশুর

তানিয়ার শ্বশুর বিল্লাল হোসেন বলেন, তাঁদের বাড়ি চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জ উপজেলার পশ্চিম কাউনিয়ায়। ২২ মে রাত ১২টার দিকে তানিয়ার অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ শুরু হলে তাঁকে স্থানীয় একটি বেসরকারি হাসপাতালে নেন তাঁরা। সেখান থেকে শহরের সরকারি হাসপাতালে (২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতাল, চাঁদপুর, তবে তাঁর স্ত্রী বলছেন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স) যান। পরদিন ২৩ মে চিকিৎসকদের পরামর্শে তাঁকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আনেন তাঁরা।
স্বামী সোহাগ হোসেন (২৩) আসেননি কেন জানতে চাইলে তানিয়ার শ্বশুর বলেন, তাঁর ছেলে গেঞ্জি কারখানায় কাজ করতেন।

এক বছর ধরে বেকার। এখন সৌদি আরব যাওয়ার চেষ্টা করছেন, টাকা জমা দেওয়ার তারিখ থাকায় আসতে পারেননি। হাড্ডিসার তানিয়াকে গর্ভধারণের পর ঠিকমতো খাওয়ানো হয়েছিল কি না জানতে চাইলে শ্বশুর বলেন, ‘না খাইতে চাইলে কী করব! আমার ঘরে যা ছিল, তা তো দেওয়া হইছেই।’ তিনি বলেন, দুই বছর আগে পারিবারিকভাবে সোহাগ ও তানিয়ার বিয়ে হয়। বিয়ের সময় তানিয়া এসএসসি পরীক্ষার্থী ছিলেন, বিয়ের পর আর পড়েননি।

হাসপাতালে উপস্থিত তানিয়ার শাশুড়ি হাসিনা বেগম বলেন, গত বছর তানিয়ার মৃত সন্তান জন্ম নেয়। হাসপাতালে অস্ত্রোপচারের (সিজারিয়ান সেকশন) মাধ্যমে মৃত সন্তান প্রসব হয়। এর মাস দেড়েক পর তিনি দ্বিতীয়বার অন্তঃসত্ত্বা হন। সপ্তাহ দুয়েক আগেও একবার রক্তক্ষরণ হলে তানিয়াকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

একজন অন্তঃসত্ত্বা নারীর যত্ন নেওয়ার দায়িত্ব পরিবার ও রাষ্ট্রের। তানিয়ার ক্ষেত্রে বাড়ি থেকে হাসপাতাল পর্যন্ত অবহেলা হয়েছে।

ওজিএসবি সভাপতি অধ্যাপক ফেরদৌসী বেগম

চিকিৎসায় অবহেলা

স্ত্রীরোগ ও প্রসূতিবিদ্যায় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সংগঠন অবসটেট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশের (ওজিএসবি) সভাপতি অধ্যাপক ফেরদৌসী বেগম বলেন, গর্ভফুল জরায়ুর গায়ে ঢুকে থাকে। কোনো কারণে গর্ভফুল জরায়ুর গা থেকে আলগা হয়ে গেলে বা জরায়ুতে শিশু ওপরে ও গর্ভফুল নিচে চলে এলে রক্তক্ষরণ শুরু হয়।

তানিয়ার মতো মাতৃমৃত্যুকে ‘মেডিকেল ইনজাস্টিস (চিকিৎসায় অবিচার)’ বলে মন্তব্য করে অধ্যাপক ফেরদৌসী বলেন, একজন অন্তঃসত্ত্বা নারীর যত্ন নেওয়ার দায়িত্ব পরিবার ও রাষ্ট্রের। তানিয়ার ক্ষেত্রে বাড়ি থেকে হাসপাতাল পর্যন্ত অবহেলা হয়েছে। প্রথম সন্তান জন্মের কমপক্ষে দুই বছর পর দ্বিতীয় সন্তান নিতে হয়। তাঁর শরীর দ্বিতীয় গর্ভধারণের জন্য প্রস্তুত হয়নি। রক্তক্ষরণের চিকিৎসায় সময় নষ্ট করার কোনো সুযোগ নেই। জেলা হাসপাতালেই ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রথম চিকিৎসাই হচ্ছে রক্ত বন্ধ করা এবং রক্ত দেওয়া। অনেক সময় দ্রুত অস্ত্রোপচার করে শুধু মাকে বাঁচানো হয়।

গর্ভকালীন সেবা নেওয়ার হার কম

গর্ভকালীন চিকিৎসাসেবা কমপক্ষে চারবার নেওয়ার কথা বলা হলেও দেশে এ হার বেশ কম। ২০২২ সালের বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপ (বিডিএইচএস) প্রতিবেদন অনুসারে, চারবার বা এর বেশি গর্ভকালীন সেবা নেওয়ার হার আগের তুলনায় ৫ শতাংশ কমে ৪১ শতাংশে নেমেছে। ভালো মানের গর্ভকালীন সেবা পাওয়ার হার মাত্র ২১ শতাংশ।

পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের কর্মসূচি ব্যবস্থাপক মো. মনজুর হোসেন বলেন, অন্তত চারবার গর্ভকালীন সেবা নেওয়া এবং হাসপাতালে প্রসবের বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টিতে জনপ্রতিনিধি ও স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সম্পৃক্ত করে ব্যাপক প্রচার চালাচ্ছে সরকার। কমপক্ষে চারবার সেবা নিলে সম্ভাব্য জটিলতা শনাক্ত হয় ও ব্যবস্থা নেওয়া যায়।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.