গত বছরের ৩০ এপ্রিল মারা যান ‘সুপার এজেন্ট’ মিনো রাইওলা। তাঁর মৃত্যুর পর আর্লিং হলান্ড-পল পগবাসহ অনেক তারকা ফুটবলার শোক প্রকাশ করে বার্তা দিয়েছিলেন। ইতালিয়ান বংশোদ্ভূত রাইওলা কখনো পেশাদার ফুটবল খেলেছেন বা কোচিং করিয়েছেন এমন কোনো তথ্য নেই। কিন্তু এরপরও তাঁর জন্য ফুটবলারদের এত শোক দেখে অনেকে অবাক হয়েছিলেন। বাস্তবতা হচ্ছে, কখনো ফুটবল না খেলেও রাইওলা ছিলেন ফুটবলের প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বদের একজন। ফুটবল অঙ্গনে যাঁর পরিচিতি ছিল সুপার এজেন্ট হিসেবে।
তবে রাইওলা একা নন, ফুটবলারদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণের কারিগর হিসেবে এ তালিকায় আছেন আরও অনেকে। যাঁদের মূল কাজ দলবদলের সময় ক্লাবগুলোতে ফুটবলারদের প্রতিনিধিত্ব করা এবং তাঁদের হয়ে দর-কষাকষি করে কাঙ্ক্ষিত ক্লাবে পৌঁছে দেওয়া। নিজেদের স্বার্থেই ক্লাব এবং ফুটবলার উভয় পক্ষের কাছেই ফুটবল এজেন্টরা আলাদা গুরুত্ব পেয়ে থাকেন। এ জন্য বড় অঙ্কের অর্থও পেয়ে থাকেন তাঁরা।
মেসি মায়ামিতে, বেনজেমা সৌদি আরবে, দলবদলে কে কোথায় যাচ্ছেন
আধুনিক ফুটবলের যাত্রা শিল্প থেকে যন্ত্রের দিকে ধাবিত হয়েছে—এমনটাই বলেছিলেন উরুগুইয়ান সাহিত্যিক ও ক্রীড়া লেখক এদোয়ার্দো গালেয়ানো। ফুটবলে যতই যান্ত্রিকতার ছোঁয়া লেগেছে, খেলাটা ততই শৃঙ্খলিত হয়েছে এবং পণ্যের আকার পেয়েছে। একপর্যায়ে ক্লাব ফুটবলের বদৌলতে খেলাটি আরও বৈশ্বিক হয়ে উঠেছে। ফুটবল লেখক ফ্রাঙ্কলিন ফয়ের তাঁর ‘হাউ সকার এক্সপ্লেইন দ্য ওয়ার্ল্ড’—এ যেমনটা লিখেছিলেন—বস্ক অঞ্চলের একটি ক্লাব ওয়েলস কোচের অধীন ডাচ ও তুর্কি খেলোয়াড়দের মাঠে নামাচ্ছে। অন্যদিকে মলডাভিয়ান একটি ক্লাব কিনে নিয়ে আসছে নাইজেরিয়ার খেলোয়াড়দের। আপনি যেখানেই তাকান, হঠাৎ আপনার মনে হবে, ফুটবল-ইতিহাসের ডাস্টবিনে জাতীয়তাবাদী সীমানা ও পরিচয় ভেসে গেছে।
আর বিশ্বায়নের এই সময়ে বিভিন্ন অঞ্চলের ফুটবলারদের তাঁদের উপযুক্ত ও কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছে দিতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছেন এজেন্টরা। ফুটবলারদের বাণিজ্যিক চুক্তিসহ নানা বিষয়ে তাঁরা কাজ করলেও এজেন্টদের প্রধান ভূমিকা রাখতে হয় মূলত দলবদলের সময়। বিশেষ করে জানুয়ারি, জুন এবং জুলাই মাসে তাঁদের ব্যস্ততা ও চাহিদা থাকে তুঙ্গে। তবে অনেক ক্ষেত্রে ফুটবলারদের ঘনিষ্ঠজনেরাও তাঁদের এজেন্ট হিসেবে কাজ করে থাকেন। যেমন লিওনেল মেসির এজেন্ট হিসেবে কাজ করেন তাঁর বাবা হোর্হে মেসি। সাম্প্রতিক সময়ে এজেন্ট হিসেবে বেশ আলোচনায় আছেন কিলিয়ান এমবাপ্পের মা ফাইজা লামারি।
নেইমার ২০২৬ বিশ্বকাপ খেলতে চান আনচেলত্তির অধীন
এমবাপ্পের দলবদল নিয়ে ফাইজার পদক্ষেপগুলো দারুণ চমকের সৃষ্টি করেছে। ফুটবল এজেন্ট হিসেবে তাঁর উত্থান সামনের দিনে দলবদলের সমীকরণেও নতুন বাঁক নিয়ে আসবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে নারী এজেন্ট হিসেবে ফাইজাই একমাত্র নন। ব্রাজিলিয়ান ফুটবল এজেন্ট ও রাইওলার এক সময়ের অংশীদার রাফায়েলা পিমেন্টাও এ সময়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছেন। বর্তমানে প্রথম ও একমাত্র নারী সুপার এজেন্ট হিসেবে বিবেচনা করা হয় পিমেন্টাকে। নিচে বর্তমান সময়ের উল্লেখযোগ্য ৫ এজেন্টের পরিচিতি তুলে ধরা হলো।
এমবাপ্পেকে রিয়ালে যেতে বলছেন তাঁর মা
হোর্হে মেন্ডেস
সম্ভবত এই সময়ে সবচেয়ে আলোচিত সুপার এজেন্ট হোর্হে মেন্ডেস। কয়েক দিন আগেও পর্তুগিজ এই এজেন্টের সবচেয়ে বড় পরিচয় ছিল, তিনি ফুটবল মহাতারকা ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর এজেন্ট। তবে কয়েক দিন আগে রোনালদোর সঙ্গে তাঁর বিরোধের খবর সামনে আসে। পর্তুগিজ এই এজেন্ট নাকি রোনালদোর আল নাসরে যাওয়ার ঘোরবিরোধী ছিলেন। যে কারণে দুজনের সম্পর্ক অবনতি হওয়ার কথাও শোনা যায়।
কেন ইন্টার মায়ামিতে গেলেন মেসি
তবে দুজনের ব্যক্তিগত সম্পর্কে আগের মতো আছেই বলেই জানান মেন্ডেস। তিনি বলেছিলেন, ‘আমাদের ব্যক্তিগত সম্পর্ক গভীরই আছে। ক্রিস্টিয়ানো সব সময় আমার হৃদয়ে থাকবে।’ তবে রোনালদো ছাড়াও অন্য অনেক পর্তুগিজ খেলোয়াড়ের ভাগ্য নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন মেন্ডেস। অন্যদের মধ্যে দিয়েগো কস্তা, আনহেল দি মারিয়া, দাভিদ দি হেয়া, হামেশ রদ্রিগেজ এবং হোয়াও ফেলিক্সের এজেন্ট হিসেবে কাজ করেছেন মেন্ডেস। শুধু ফুটবলই অবশ্য নয়, ফর্মুলা ওয়ানসহ অন্য খেলার তারকাদেরও প্রতিনিধিত্ব করেন মেন্ডেস।
রাফায়েলা পিমেন্টা
একসময় রাইওলার সঙ্গে কাজ করেছেন পিমেন্টা। এজেন্ট হিসেবে তাঁর উত্থান মূলত রাইওলার মৃত্যুর পর। আর্লিং হলান্ড, পল পগবা, ম্যাথিয়াস ডি লিট, জিয়নলুইজি দোন্নারুম্মা, মার্কো ভেরাত্তিসহ বর্তমান সময়ের অনেক তারকা ফুটবলের এজেন্ট হিসেবে কাজ করছেন এই ব্রাজিলিয়ান নারী।
দলবদলে এবার নতুন শর্ত দিলেন এমবাপ্পে
বিশেষ করে রাইওলার গড়ে তোলা বাজারকে বেশ দক্ষতার সঙ্গে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন পিমেন্টা। প্রিমিয়ার লিগের এক পরিচালক একবার বলেছিলেন, ‘পিমেন্টা হচ্ছেন ফুটবলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষ, যার কথা কেউ জানে না।’ এমনকি এখনো খুব অল্পসংখ্যক মানুষই পিমেন্টা সম্পর্কে জানেন। আইন নিয়ে পড়াশোনার বিষয়টিও তাঁকে এজেন্ট হিসেবে ভূমিকা রাখতে সহায়তা করেছে।
জনাথন বার্নেট
বার্নেটের প্রতিষ্ঠানের নাম আইসিএম স্টেলার স্পোর্টস গ্রুপ। তবে এজেন্ট হিসেবে বার্নেটকে পরিচিতি এনে দিয়েছেন গ্যারেথ বেল। লম্বা সময় ধরে ওয়েলস তারকার প্রতিনিধিত্ব করেছেন বার্নেট। বেলের উত্থানে দারুণ ভূমিকা ছিল তাঁর। বেলকে টটেনহাম থেকে রিয়াল মাদ্রিদে আসার পথটাও তৈরি করে দিয়েছিলেন বার্নেট। বেলের পর বার্নেটের উল্লেখযোগ্য গ্রাহক হচ্ছেন জ্যাক গ্রিলিশ। তাঁর মধ্যস্থতাতেই ব্রিটিশ রেকর্ড ভেঙে অ্যাস্টন ভিলা থেকে ম্যানচেস্টার সিটিতে যান গ্রিলিশ। এ ছাড়া অন্যদের মধ্যে রিয়াল মাদ্রিদ তারকা এদোয়ার্দো কামাভিঙ্গা, কালভিন ফিলিপস, ইব্রাহিমো কোনাতে এবং কিয়েরান টিয়ের্নের প্রতিনিধিত্বও করেন বার্নেট।
পেরে গার্দিওলা
নামটা দেখে কি পেপ গার্দিওলার কথা মনে পড়ছে? পড়তেই পারে, পেরে গার্দিওলা যে ম্যানচেস্টার সিটি কোচের ভাই। তবে ভাইয়ের পরিচয়ে নয়, পেরে গার্দিওলা নিজেই সুপার এজেন্ট হিসেবে পরিচিত। উরুগুয়ের তারকাদের বার্সেলোনায় পাঠিয়ে এর আগে বেশ আয়ও করেছিলেন পেরে। একসময় হেক্টর বেরলিন, জন তোরাল এবং লুইস সুয়ারেজসহ অনেকের এজেন্ট হিসেবে কাজ করেছেন পেরে। এজেন্ট হিসেবে ম্যানচেস্টারের দুই ক্লাবের ওপরও পেরের গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব আছে বলে শোনা যায়। এজেন্টি হিসেবে তাঁর বিশ্লেষণী ক্ষমতা, অভিজ্ঞতা এবং ফুটবলজ্ঞানের কারণে অনেক খেলোয়াড় এবং ক্লাব তাঁকে এজেন্ট হিসেবে প্রাধান্য দিয়ে থাকে।
ফেদেরিকো পাস্তোরেল্লো
ফুটবলের শীর্ষ সুপার এজেন্টদের মধ্যে ফেদেরিকো পাস্তোরেল্লা অন্যতম। রোমেলু লুকাকুকে প্রতিনিধিত্ব করে মূলত আলোচনায় এসেছেন পাস্তোরেল্লো। লুকাকুর চেলসি ছেড়ে ইন্টারে ফেরার বিতর্কিত দলবদলটিও হয়েছে তাঁর প্রতিনিধিত্বে। এর আগে লুকাকুকে অবশ্য রাইওলা প্রতিনিধিত্ব করেছেন। লুকাকু ছাড়া অন্যদের মধ্যে ইন্টার মিলান তারকা স্তেফান দি ভ্রিজের প্রতিনিধি হিসেবেও কাজ করেন পাস্তোরেল্লো।