সন্দ্বীপের ঈদযাত্রা: বাড়ি না গিয়ে ঠাঁই যখন থানাহাজতে

0
92

স্বজনদের সঙ্গে ঈদ উদ্‌যাপন আমাদের একটি বহু পুরোনো ঐতিহ্য। শুধু আমাদের দেশেই নয়, সর্বত্রই প্রিয়জনদের সঙ্গে উৎসব কাটাতে ঘরমুখী হয় মানুষ। পূজা, বড়দিন, চীনা নববর্ষ—কোনোটাই এর ব্যতিক্রম নয়।

গত পবিত্র রোজার ঈদে ১ কোটি ২৩ লাখ সিম ঢাকা ছেড়েছিল বলে জানা যায়। এই বিপুলসংখ্যক যাত্রীর যাতায়াতের ভারে পরিবহনব্যবস্থার ওপর বাড়তি চাপ পড়ে, যাত্রায় বিলম্ব হয়, নানান অসুবিধা হয়।

কিন্তু প্রিয়জনের সান্নিধ্য পেলে মানুষ তা ভুলে যায়। কিন্তু ঈদে বাড়ি না গিয়ে থানাহাজতে যাওয়ার ঘটনা বিরল। সে ঘটনা ঘটেছে সন্দ্বীপে প্রিয়জনদের সঙ্গে ঈদ করতে যাওয়া ৯ যাত্রীর ভাগ্যে।

সন্দ্বীপের যাতায়াতব্যবস্থা

বাংলাদেশের অবশিষ্ট হাতে গোনা দুর্গম এলাকাগুলোর মধ্যে সন্দ্বীপ অন্যতম। ঢাকা, এমনকি চট্টগ্রাম থেকেও সরাসরি সেখানে যাওয়ার কোনো উপায় নেই। সাধারণের সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত রুটটি হলো বাসে চট্টগ্রাম থেকে কুমিরা, সেখান থেকে টেম্পোতে করে কুমিরা ঘাট, ঘাট থেকে ভ্যানে করে স্পিডবোটে ওঠার জায়গা।

স্পিডবোটে করে ওপারে সন্দ্বীপের গুপ্তছড়া ঘাটে নেমে আবার ভ্যানে করে টেম্পোস্ট্যান্ড, সেখান থেকে টেম্পোতে চড়ে বাড়ি। এটা হলো সুদিনে (নদী যখন শান্ত) ও জোয়ারের সময় যাতায়াতের ব্যবস্থা। ভাটার সময় কাদা ঠেলে বা নৌকায় কুমিরায় স্পিডবোটে চড়তে হয়। ওপারেও একই অবস্থা। মাঝেমধ্যে যাত্রীদের মালামালসহ কোমরপানিতে নামিয়ে দেওয়া হয়।

অপেক্ষাকৃত নিরাপদ স্টিমার আছে, কিন্তু সেটি ঘাটে ভেড়ে না। দুই পাড়েই নৌকায় চড়ে স্টিমারে উঠতে ও নামতে হয়। কিন্তু বর্ষার সময় ওপারে যাওয়ার সঙ্গে পরপারে যাওয়ারও আশঙ্কা থাকে। এই তো মাত্র এক বছর আগে নদী পারাপারে চার শিশুর মৃত্যু ঘটেছে। তারও পাঁচ বছর আগে লালবোট দুর্ঘটনায় ১৮ জনের মৃত্যু ঘটে। যাতায়াতও সময়সাপেক্ষ। চট্টগ্রাম থেকে পুরো এক দিন লাগে। জনপ্রতি খরচ হয় ন্যূনতম এক হাজার টাকা।

যাত্রী ও প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্য

সারা দিন ঘাটে অপেক্ষা করেও ঈদে বাড়ি ফেরার সুযোগ না পেয়ে সন্দ্বীপ-চট্টগ্রাম নৌরুটের কুমিরা ঘাটের কাউন্টারে ভাঙচুর করেছেন বিক্ষুব্ধ যাত্রীরা। কাউন্টারে হামলার অভিযোগে নয়জনকে আটক করেছে পুলিশ। ঈদের আগের দিন, ২৮ জুন বিকেল চারটার দিকে সীতাকুণ্ড উপজেলার কুমিরা ফেরিঘাটে এই ঘটনা ঘটে।

প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, সেদিন সকাল থেকে ঘাটে কয়েক হাজার যাত্রী অপেক্ষমাণ ছিলেন। সকালে একটা শিপ ছাড়ে। সেটার সব টিকিট ব্ল্যাকে বিক্রি হয়েছে। একপর্যায়ে বেলা সাড়ে তিনটার দিকে ঘোষণা দেওয়া হয়, আর কোনো নৌযান ছাড়বে না। ঘাটে তখনো দেড় হাজারের মতো যাত্রী ছিলেন, যাঁদের অনেকে ভোর চারটা থেকে অপেক্ষা করছিলেন।

এমন ঘোষণায় বিক্ষুব্ধ হয়ে যাত্রীরা হামলা করেন। এরপর আশ্বাস দেওয়া হয় শিপ আসবে। তখন যাত্রীরা শান্ত হন। কিছুক্ষণ পর পুলিশ ও কোস্টগার্ড আসে। স্থানীয় ছাত্রলীগের কিছু নেতা-কর্মীও আসেন। তখন ঘাটের লোকজনসহ ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা পাঁচ থেকে ছয়জন যাত্রীকে ধরে নিয়ে গিয়ে কাউন্টারের দরজা বন্ধ করে মারধর করেন। পুলিশ-কোস্টগার্ডের সামনেই তাঁদের মারধর করা হয়। কিন্তু পুলিশ নীরব দর্শকের ভূমিকায় ছিল।

প্রথমেই দুর্ভাগা তরুণদের বিরুদ্ধে মামলা তুলে নিতে হবে। ক্লান্তি ও রাগের মাথায় ভাঙচুর করলেও তাঁদের বঞ্চনার তালিকা দীর্ঘ—তাঁরা দূরদূরান্ত থেকে এসে স্বজনদের সঙ্গে ঈদ করতে পারেননি, হামলার শিকার হয়েছেন, হাজতবাস করেছেন। মনে রাখতে হবে, স্বজনদের সঙ্গে ঈদ করতে যাওয়া কোনো অপরাধ নয়। তাঁদের যাতায়াতের ব্যবস্থা করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব।

সরকারি ভাষ্য

নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, সেদিন দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার সিগন্যাল থাকার কারণে নৌকা দিয়ে যাত্রী ওঠানো সম্ভব ছিল না। সিগন্যাল স্বাভাবিক হলে পরে স্টিমারের দ্বিতীয় ট্রিপ দেওয়া হবে—এমন সিদ্ধান্ত হলে যাত্রীরা ভাঙচুর করে সরকারি সম্পত্তির ক্ষতিসাধন করেন। পুলিশের ভাষ্যও অনুরূপ, ‘যাত্রীরা কুমিরা ঘাটের কাউন্টারে হামলা করে সব লন্ডভন্ড করে ফেলেছে। বৈরী আবহাওয়ার কারণে কোনো নৌযান ছাড়ছে না। এটাকে কেন্দ্র করে কিছু উচ্ছৃঙ্খল তরুণ ভাঙচুর করেছে। তারা কাউন্টারের ক্যাশও লুট করেছে।’

হাজতবাস ও পরবর্তী ঘটনা

গ্রেপ্তার তরুণদের থানাহাজতে নিয়ে গেলে সেখানে এক করুণ দৃশ্যের অবতারণা হয়। যে মাকে দেখতে তরুণটি সন্দ্বীপ যাচ্ছিলেন, তাঁর মা থানাহাজতের সামনে আহাজারি করতে থাকেন। ইতিমধ্যে প্রচেষ্টা চলে গ্রেপ্তারকৃত তরুণদের ভাঙচুরকে বিএনপি–জামায়াতের নাশকতামূলক কাজ হিসেবে চালিয়ে দেওয়ার; তাহলে মামলা শক্ত হয়! গ্রেপ্তার তরুণদের রাজনৈতিক পরিচয় নিয়ে খোঁজখবর চলে দিনভর। পরে সন্দ্বীপের কয়েকজন আইনজীবী, বাম ও বিরোধী দলের কর্মীর প্রচেষ্টায় গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের জামিনের আবেদন করা হলে আদালত তা মঞ্জুর করেন এবং তরুণেরা মুক্তি পান।

নেপথ্যের ঘটনা

কুমিরা-সন্দ্বীপ ঘাটে পারাপারকে কেন্দ্র করে এক সিন্ডিকেট দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছে। প্রতিদিন তাদের আয় লাখ লাখ টাকা। স্টিমার এজেন্ট, ঘাটের ইজারাদার—সবাই সরকারি দলের নেতা। ঈদে তাঁদের উপার্জন বহুগুণ বেড়ে যায়। স্থানীয় মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ঈদের আগে বিরূপ আবহাওয়ার কারণে স্পিডবোট কয়েক দিন চলেনি।

এ সুযোগে স্টিমারে টিকিট বিক্রিতে ব্যাপক কালোবাজারি হয়। ঘরমুখী মানুষ দ্বিগুণ–তিন গুণ দামে টিকিট কিনে স্টিমারে যাতায়াত করেন। এই টাকা ভাগ হয় রাজনৈতিক নেতা-কর্মী ও অসাধু বিআইডব্লিউটিসি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মধ্যে। এতে স্পিডবোটচালকদের সিন্ডিকেট ক্ষুব্ধ হয়।

অভিযোগ আছে, আবহাওয়ার কারণে নয়, বরং এদের সুযোগ দেওয়ার জন্য সেদিন স্টিমারের নির্ধারিত ট্রিপ বাতিল করা হয়। মনে রাখতে হবে, সেদিন যাঁরা ঘাটে অপেক্ষমাণ ছিলেন, তাঁরা কেউ নিয়মিত যাত্রী নন, ঈদ উপলক্ষে আসা মৌসুমি যাত্রী। তাঁরা স্পিডবোটযোগে যাত্রা অনিরাপদ ভাবেন এবং ক্ষুব্ধ হয়ে ভাঙচুর করেন।

কী করলে অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি এড়ানো যেত

পুরো ঘটনাই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যর্থতার একটি উদাহরণ। এর কারণ হলো, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এখন আর নিরপেক্ষ নয়, তারা ক্ষমতাসীনদের অনুগামী। না হলে দলীয় ক্যাডাররা সেখানে উপস্থিত হয়ে গ্রেপ্তার তরুণদের ওপর হামলা করেন কীভাবে?

যাত্রীদের ওপর হামলাকারী ক্যাডারদের গ্রেপ্তার করা হলো না কেন? স্বজনদের সঙ্গে ঈদ করতে যাওয়া যাত্রীরা কাউন্টারের ক্যাশ লুট করেছেন—এ কথা পাগলেও বিশ্বাস করবে না। এ ছাড়া বিআইডব্লিউটিসির কোনো ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সেখানে উপস্থিত থাকলে তিনি পরিস্থিতি সামাল দিতে পারতেন বলে আমার বিশ্বাস।

এখন করণীয়

এক. প্রথমেই দুর্ভাগা তরুণদের বিরুদ্ধে মামলা তুলে নিতে হবে। ক্লান্তি ও রাগের মাথায় ভাঙচুর করলেও তাঁদের বঞ্চনার তালিকা দীর্ঘ—তাঁরা দূরদূরান্ত থেকে এসে স্বজনদের সঙ্গে ঈদ করতে পারেননি, হামলার শিকার হয়েছেন, হাজতবাস করেছেন। মনে রাখতে হবে, স্বজনদের সঙ্গে ঈদ করতে যাওয়া কোনো অপরাধ নয়। তাঁদের যাতায়াতের ব্যবস্থা করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব।

দুই. সন্দ্বীপে নিরাপদ যাতায়াতব্যবস্থা প্রবর্তন করতে হবে। পদ্মা সেতু নির্মিত হওয়ার ফলে যে ফেরিগুলো উদ্বৃত্ত হয়েছে, সেগুলোর অন্তত দুটি এখানে পারাপারের জন্য দিতে হবে। এ ফেরিগুলোর ল্যান্ডিংয়ের জন্য নদীর দুই পাড়েই ঘাটে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো গড়ে তুলতে হবে।

তিন. সন্দ্বীপকে নৌবন্দর ঘোষণা করতে হবে। সিন্ডিকেটমুক্ত করার জন্য সন্দ্বীপের সব ঘাটকে উন্মুক্ত করে দিতে হবে, যাতে এসব ঘাটে যে কেউ সরকার–নির্ধারিত চার্জ পরিশোধ করে নৌযান পরিচালনা করতে পারে।

সর্বোপরি, ‘অভাবিত উন্নয়ন’ সন্দ্বীপ চ্যানেলসহ উপকূলের অন্য যেসব জায়গায় পৌঁছায়নি, সেখানে পৌঁছাতে হবে।

  • মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান অর্থনীতিবিদ ও সাবেক সচিব

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.