এক তরুণীকে দিয়ে একজন ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তাকে ফোন করিয়ে প্রতারণার ফাঁদে ফেলেছে একটি অপরাধী চক্র। কৌশলে তাঁকে রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার একটি বাসায় নিয়ে যায় চক্রটি। সেখানে একটি কক্ষে আটকে রেখে বিবস্ত্র করে আরেক তরুণীর সঙ্গে ছবি তোলা হয় এবং ভিডিও ধারণ করা হয়। সেগুলো ছড়িয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে তাঁর কাছে তিন কোটি টাকা দাবি করা হয়। একপর্যায়ে স্বজনদের মাধ্যমে ব্যাংক হিসাবে ১৫ লাখ টাকা জমা করিয়ে এবং পরে ২৫ লাখ টাকা দেওয়ার শর্তে ছাড়া পান ওই সরকারি কর্মকর্তা।
ছাড়া পাওয়ার পর অপহৃত হওয়ার ঘটনা ভাটারা থানা পুলিশকে জানান ওই সরকারি কর্মকর্তা। পরে যে তরুণীর ফোনের সূত্র ধরে এতসব ঘটনা, সেই তরুণী ও তাঁর এক সহযোগীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। বর্তমানে তাঁরা কারাগারে আছেন।
এই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও ভাটারা থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মো. হাফিজুর রহমান বলেন, গত ২ মার্চ এক সহযোগীসহ ওই তরুণীকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে তাঁদের হেফাজতে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তাঁরা দুজনই দাবি করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। তাঁরা ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছেন।
অবশ্য ওই তরুণী ও সহযোগী আইনজীবীর মাধ্যমে আদালতে দাবি করেছেন, তাঁরা নিরাপরাধ। দুজনই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। গ্রেপ্তার হওয়ার কারণে তাঁদের পড়াশোনা বিঘ্নিত হচ্ছে। তাঁদের জামিন দেওয়া হোক।
আর ভুক্তভোগী কর্মকর্তা বলেছেন, পেশাগত কারণে নানা পেশার মানুষ তাঁকে ফোন দেন। কেউ কেউ নিজেকে অসহায় দাবি করে নানা দাবিদাওয়াও জানান। কিন্তু এক তরুণীর ফোনে তাঁর সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পরে যেভাবে তাঁকে ধরে নিয়ে বিবস্ত্র করে নির্যাতন করা হয়েছে, সেই ঘটনা ভাবতে গিয়েও আঁতকে ওঠেন।
যেভাবে ফাঁদে ফেলা হয় কর্মকর্তাকে
উচ্চপদস্থ ওই কর্মকর্তার দেওয়া তথ্যমতে, তিনি পরিবার নিয়ে ঢাকায় থাকেন। গত ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে তাঁর হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে ওই তরুণী ফোন করেন। বেশ কয়েকবার ওই নম্বর থেকে কল এলেও তিনি ধরেননি। একপর্যায়ে ওই তরুণী কর্মকর্তার হোয়াটসঅ্যাপে খুদে বার্তা পাঠান। পরে তরুণী আবারও তাঁকে মুঠোফোনে ফোন করেন। একপর্যায়ে ফোন ধরার পর ওই তরুণী নিজেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হিসেবে পরিচয় দেন। নিজেকে অসহায় দাবি করে তিনি ওই কর্মকর্তার কাছে চাকরি চেয়ে কাকুতি–মিনতি করেন। একপর্যায়ে তাঁর কথা বিশ্বাস করতে শুরু করেন ওই কর্মকর্তা। এরপর নানাভাবে তাঁকে প্রভাবিত করতে শুরু করেন ওই তরুণী। একপর্যায়ে তিনি কর্মকর্তার সঙ্গে সরাসরি দেখা করতে চান।
ওই কর্মকর্তা বলেন, গত ২৩ ফেব্রুয়ারি দুপুরে পেশাগত কাজে তিনি যমুনা ফিউচার পার্ক এলাকায় যান। তখন ওই তরুণী তাঁকে ফোন করেন। এরপর যমুনা ফিউচার পার্কে তাঁদের দেখা হয়। সে সময় তিনি ওই তরুণীর সঙ্গে আরও দুজন যুবককে দেখতে পান।
কর্মকর্তার ভাষ্য, ওই তরুণীর সঙ্গে কথা বলার এক পর্যায়ে তিনি কিছুটা অস্বাভাবিক হয়ে পড়েন। তরুণীর সঙ্গে একটা রিকশায় চেপে বসেন। কিছুটা দূরে যাওয়ার পর তরুণীর সঙ্গে থাকা যুবকেরা তাঁকে একটি সিএনজি অটোরিকশায় ওঠান। পরে তাঁর হাত–পা বেঁধে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার একটি বাসায় নিয়ে যাওয়া হয়।
ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, বসুন্ধরা এলাকার যে বাসায় তাঁকে নেওয়া হয়, সেখানে সাত থেকে আটজন যুবককে দেখতে পান তিনি। পরে তাঁকে বেদম মারধর করা হয়। একপর্যায়ে তিনি অচেতন হয়ে পড়েন। যখন তাঁর জ্ঞান ফেরে, তখন বিকেল ৫টা বাজে। এ সময় তাঁর শরীরে কোনো কাপড় ছিল না।
প্রতারণার শিকার এই ব্যক্তি দাবি করেন, তাঁকে আটক করে মারধর করার পর এক তরুণীর সঙ্গে তাঁর নগ্ন ছবি তুলে ও ভিডিও করে অপহরণকারীরা। পরে সেসব ছবি ও ভিডিও তাঁকে দেখানো হয়। একপর্যায়ে অপহরণকারীরা তাঁর কাছে তিন কোটি টাকা চাঁদা দাবি করেন। এত টাকা তিনি দিতে পারবেন না জানালে ওই বাসায় থাকা বঁটি তাঁর গলার কাছে ধরেন অপহরণকারীরা। যদি তাঁদের তিন কোটি টাকা না দেওয়া হয়, তাহলে খুন করার হুমকি দেন। একপর্যায়ে অপহরণকারীরা তাঁকে হুমকি দেন, যদি তাঁদের চাহিদামতো অর্থ না দেন, তাহলে কর্মকর্তার ছবি ও ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেবেন। পরে জীবন বাঁচাতে অপহরণকারীদের কথায় টাকা দিতে রাজি হন ওই কর্মকর্তা।
ওই কর্মকর্তা বলেন, ২২ ঘণ্টা তাঁকে একটি কক্ষে আটকে রাখেন অপহরণকারীরা। পরে টাকা দেওয়ার জন্য বারবার চাপ দিতে থাকেন। একপর্যায়ে তিনি অপহরণকারীদের কাছ থেকে মুঠোফোন নিয়ে স্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ করেন। অপহরণকারীদের দেওয়া দুটি ব্যাংক হিসাবে ১৫ লাখ টাকা দেওয়া হয়। পরে আরও ২৫ লাখ টাকা দেওয়ার শর্তে তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
এ ঘটনার পর বাসায় ফিরে আতঙ্কিত বোধ করেন ওই কর্মকর্তা। পরে তিনি কাছের লোকজনের কাছে ঘটনা খুলে বলেন। একপর্যায়ে তিনি পুলিশের শরণাপন্ন হন। পরে অপহরণকারী চক্রের সদস্যদের গ্রেপ্তারে পুলিশ কৌশল নেয়। যে তরুণীর সঙ্গে ওই কর্মকর্তার প্রথম পরিচয় হয়, সেই তরুণীকে বাকি ২৫ লাখ টাকা সরাসরি নেওয়ার জন্য প্রস্তাব দেন তিনি। গত ২ মার্চ যমুনা ফিউচার পার্কের কাছে ২৫ লাখ টাকা নিতে আসেন ওই তরুণী। পরে পুলিশ ওই তরুণী ও তাঁর এক সহযোগীকে গ্রেপ্তার করে। পরদিন তাঁদের আদালতে পাঠানো হয়। দুদিন রিমান্ডে নিয়ে তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ।
আসাদুজ্জামান
ঢাকা