পা দিয়ে শিশু গৃহকর্মীর গলা চেপে ধরে গৃহকর্ত্রী সাথী

0
122
সাথী পারভীন ডলি

শিশু গৃহকর্মী হেনা হত্যাকাণ্ডে অভিযুক্ত গৃহকর্ত্রী সাথী পারভীন ডলিকে গ্রেপ্তারের পর জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে আসছে নির্মম নির্যাতনের কাহিনি। সাথী পেশায় সার্ভেয়ার। তিন বছরের বেশি সময় তার বাসায় কাজ করে হেনা। এই সময়ে ‘পান থেকে চুন খসলেই’ নির্যাতনের শিকার হতো শিশুটি। তবে হেনা মারা যাওয়ায় অনুতপ্ত হওয়ার কথা পুলিশকে জানিয়েছে সাথী।

শিশু গৃহকর্মীকে কেন নির্যাতন করত সাথী? এমন প্রশ্নে পুলিশকে সাথী জানিয়েছে, হেনা মাঝেমধ্যে তার বাচ্চার জন্য রাখা খাবার খেয়ে ফেলত। খেলার সময় তার বাচ্চাকে মারধর করত।

গত ২৬ আগস্ট রাজধানীর কলাবাগান সেন্ট্রাল রোডের ৭৭ নম্বর ভবনের দ্বিতীয় তলার একটি ফ্ল্যাট থেকে শিশু গৃহকর্মী হেনার মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। ঘটনার দু’দিন পর শিশুটির পরিচয় নিশ্চিত হয় পুলিশ। তার বাবার নাম হক মিয়া ও মা হাছিনা বেগম। ময়মনসিংহের মুক্তাগাছায় তাদের বাড়ি। হেনার বাবা-মা মারা গেছেন অনেক আগে।

এ ঘটনায় কলাবাগান থানার এসআই বাবুল হোসেন বাদী হয়ে একটি হত্যা মামলা করেন। তিনি জানান, শিশু হেনাকে তার ফুফা-ফুফু সার্ভেয়ার সাথী পারভীনের বাসায় কাজে দেন। মাসে ২ হাজার টাকা বেতন দেওয়ার কথা ছিল। প্রথম কয়েক মাস ঠিকঠাক বেতন দিলেও পরে আর দেয়নি সাথী।

ঘটনার পর থেকে পলাতক সাথী পারভীন। গত শুক্রবার তার সাবেক স্বামী ডাক্তার শহীদুল হক রাহাতের সহায়তায় যশোর থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। গতকাল রোববার ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে এ তথ্য জানান ডিএমপির রমনা বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মোহাম্মদ আশরাফ হোসেন। এ সময় উপস্থিত ছিলেন নিউমার্কেট জোনের অতিরিক্ত কমিশনার শাহেন শাহ, সহকারী কমিশনার রেফাতুল ইসলাম ও কলাবাগান থানার ওসি সাইফুল ইসলাম।

পুলিশ জানায়, বাসার সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেছে, গত ২৪ আগস্ট বেলা ৩টার দিকে গলায় পা দিয়ে গৃহকর্মী হেনাকে নির্যাতন করে সাথী পারভীন। এ সময় হাতজোড় করে বাঁচার আকুতি জানায় হেনা। পরে তাকে লাথি মারে সাথী। আরেকটি ফুটেজে দেখা যায়, পরদিন সকাল ৯টা ৪ মিনিটে নিজের শিশু সন্তান নিয়ে দ্রুত বাসা থেকে বেরিয়ে যায় সাথী।

ডিসি মোহাম্মদ আশরাফ হোসেন বলেন, ঘটনার পর বাসায় তিনটি মোবাইল ফোন রেখে বেরিয়ে যায় সাথী। প্রথমে যায় কেরানীগঞ্জ। সেখান থেকে ফিরে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে ঘোরাফেরা করে। দু’দিন পর উত্তরায় বোনের বাসায় গিয়ে শিশু সন্তানকে রেখে বেরিয়ে আসে। তখন তার বোনকে ঘটনা খুলে বলে। এরপর কমলাপুরে ট্রেনে উঠে যায় খুলনা। সেখানে ঘোরাফেরার পর আসে সাবেক স্বামী রাহাতের কাছে। তার ধারণা ছিল, ভুল শিকার করে মাফ চাইলে সেখানে আশ্রয় পাবে।

পুলিশের এই কর্মকর্তা জানান, ২০২০ সাল থেকে সাথীর বাসায় কাজ করত এতিম শিশু হেনা। তার শরীরে নতুন-পুরোনো আঘাতের অনেক চিহ্ন দেখা যায়। ঘটনার পর থেকে কলাবাগান থানা পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিট বিষয়টি নিয়ে কাজ করে। ছয় দিনের মাথায় আসামিকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়। তিনি জানান, সাথীকে গ্রেপ্তারে রাজধানীর প্রায় ৩০০ স্থানের সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়। কিন্তু মোবাইল ফোন ব্যবহার না করায় সাথীর অবস্থান নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছিল না। সিসি ফুটেজে তাকে বিভিন্ন স্থানে ঘুরতে দেখা যায়। কখনও কখনও মুদি দোকানের সামনে তাকে পাওয়া যায়। অন্যের ফোন থেকে সাথী আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে যোগাযোগ করে।

জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে পুলিশ জানায়, ডালঘুটনি, দা ও বঁটি দিয়ে শিশুটিকে নির্যাতন করত গৃহকর্ত্রী সাথী। অনেক সময় লাঠি দিয়ে মারত।

সাথী পারভীন এলজিইডি মন্ত্রণালয়ের একজন সার্ভেয়ার। ২০০৩ সালে সেখানে কম্পিউটার অপারেটর হিসেবে যোগ দেয়। তখন মন্ত্রণালয়ের এক গাড়িচালককে বিয়ে করে। ২০১১ সালে ডিপ্লোমা করে সার্ভেয়ার হিসেবে চাকরি নিয়ে প্রথম স্বামীকে তালাক দেয়। ২০১৬ সালে বিএসসি করে নিজেকে ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে পরিচয় দেয়। অনলাইনে পরিচয়ের সূত্র ধরে ২০১৯ সালে রাহাতকে বিয়ে করে। রাহাত তখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাক্তার ছিলেন। ২০২০ সালে তাদের বিচ্ছেদ হয়। দ্বিতীয় স্বামীর ঘরে তার দুটি যমজ মেয়ে হয়। পরে একটি মেয়ে মারা যায়। আরেকটি মেয়ে লালনপালন করতেই হেনাকে বাসায় নেয় সাথী।

উপকমিশনার আশরাফ হোসেন বলেন, গৃহকর্মীর কাজ পছন্দ না হলে বা ভালো না লাগলে তাকে বিদায় করে দেবেন। কিন্তু নির্মম নির্যাতন করে মেরে ফেলবেন না। এ ধরনের অপরাধ করে কেউ পার পায় না।

পুলিশ জানায়, সাথী আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছে। পরে আদালত তাকে কারাগারে পাঠান। এ সময় শিশু গৃহকর্মী এনে নির্যাতন করে মেরে ফেলার বিষয়ে জানতে চাইলে সাথী পারভীন নিশ্চুপ ছিলেন।

শিশু হেনার ফুফা মো. মোসলেম বলেন, মৃত্যুর ২০-২২ দিন আগে হেনার সঙ্গে তার ফুফু রুফি আক্তারের কথা হয়। সে মাঝে মাঝে ফুফুর সঙ্গে কথা বলত। কিন্তু এভাবে নির্যাতন করার কথা বলতে শুনিনি। তবে গৃহকর্ত্রী সাথী পারভীন তাদের বলত হেনা খুব ভালো আছে। বড় করে তাকে ভালো জায়গায় বিয়ে দেবে। কিন্তু তার জীবনটাই নিয়ে নিল।

ফুফা জানান, বাবা-মা অসুখে মারা যাওয়ার পর হেনা তাদের কাছেই থাকত। গ্রামে বাবা-মায়ের কবরের পাশেই দাফন করা হয়েছে হেনাকে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.