ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসনসংখ্যা কমিয়ে কী বার্তা দেওয়া হচ্ছে

0
159
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

প্রায় দুই দশক ধরে দেখছি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিবছর আসনসংখ্যা কমবেশি বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু গত বছর ভর্তি পরীক্ষার আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ একটি সিদ্ধান্ত নেয়। সেই সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে অধিকাংশ বিভাগে আসন কমানো হয়। ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষে যেখানে মোট শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়েছিল ৭ হাজার ২০০, সেখানে গত বছর আসন কমানোর কারণে এ সংখ্যা নেমে আসে ৬ হাজারে। এ বছরও আসনসংখ্যা বাড়েনি। অর্থাৎ, আগের তুলনায় আসন কমেছে ১ হাজার ২০০, যা শতকরা হিসাবে ১৫ ভাগের বেশি। আসনসংখ্যা কমানোর মধ্য দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কোন বার্তা দিতে চায়, কিংবা কোন লক্ষ্যে পৌঁছাতে চায়, সেটাই এখন জিজ্ঞাসা। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রগতিশীল ছাত্রসংগঠনগুলো এ পদক্ষেপকে ‘জনবিরোধী’ বলে মন্তব্য করেছে।

বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বলছে, আবাসনব্যবস্থা, গ্রন্থাগার-সুবিধা, শ্রেণিকক্ষের পাঠদান ও পরিবহন যোগাযোগ থেকে শুরু করে সর্বত্র অতিরিক্ত শিক্ষার্থীর চাপ রয়েছে। গত ২০ বছরে অপরিকল্পিতভাবে অনেক বিভাগ ও ইনস্টিটিউট খোলার কারণে এমন অবস্থা তৈরি হয়েছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ‘প্রয়োজনভিত্তিক শিক্ষা’কে গুরুত্ব দিয়ে আসন কমানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এর ফলে বেকারত্বও কমে আসবে বলে আশা করা হচ্ছে। ‘প্রয়োজনভিত্তিক শিক্ষা’ বলতে বিশ্ববিদ্যালয় কী বলতে চায়, তার প্রমাণ মেলে বিভিন্ন বিভাগের আসনসংখ্যা কমানো-বাড়ানো দেখে। ‘বাজারে চাহিদা আছে’ এমন ১৫টি বিভাগ ও ইনস্টিটিউটে আসন বাড়ানো হয়েছে, আর প্রায় সব কটি মৌলিক বিষয়ে আসন কমানো হয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তিতে জিপিএ–৫ এর হিসাব যখন ‘অভিশাপ’

এই সিদ্ধান্ত উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রকে সংকুচিত করবে কি না, এ প্রশ্নও রেখেছেন কোনো কোনো শিক্ষাবিদ। প্রতিবছর হাজার হাজার ‘শিক্ষিত বেকার’ তৈরি হচ্ছে, ‘চাকরির বাজার’ যথেষ্ট প্রসারিত হয়নি, এসব বিবেচনায় আসন কমানো ঠিক হয়নি। কারণ, বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনার উদ্দেশ্য শিক্ষার্থীর চাকরি নিশ্চিত করা নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান কাজ—মৌলিক পাঠদানের মাধ্যমে গবেষণার ক্ষেত্রকে প্রসারিত করা। নতুন নতুন গবেষণা সমাজ ও রাষ্ট্রকে এগিয়ে নিতে সহায়তা করে। তাই বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার সুযোগ বরং বাড়ানো দরকার। এমনকি, অধিকসংখ্যক উচ্চশিক্ষিত জনগোষ্ঠী রাষ্ট্রের জন্য বোঝা নয়, সম্পদ হয়। আমাদের লক্ষ্যহীন শিক্ষাক্রম এবং দুর্বল গবেষণা-প্রকল্পের কারণে উচ্চশিক্ষার লক্ষ্য ব্যাহত হচ্ছে।

প্রতিবছর এইচএসসি পরীক্ষা দিচ্ছে ১২ থেকে ১৩ লাখ ছাত্রছাত্রী। তাদের মধ্যে শতকরা ৯০ থেকে ৯৫ ভাগ উত্তীর্ণ হচ্ছে। অর্থাৎ, উচ্চতর শিক্ষার প্রাথমিক শর্ত পূরণ করছে। এদিকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আসন আছে ৫০ হাজারের মতো। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকেও ভর্তি পরীক্ষা দেওয়ার জন্য ন্যূনতম যোগ্যতা নির্ধারণ করে দিতে হয়। তারপরও দেখা যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি আসনের বিপরীতে পরীক্ষা দেন গড়ে ৪৫ থেকে ৫০ জন।

আপাতভাবে মনে হতে পারে, আসনসংখ্যা কমানো হলে শিক্ষার্থীদের সুযোগগুলো বাড়ানো সম্ভব। তবে এই এক বছরে এ ক্ষেত্রে দৃশ্যমান কোনো পরিবর্তন আসেনি। যে বিশ্ববিদ্যালয়ে আবাসিক-অনাবাসিক দ্বৈত সুবিধা আছে, সেখানে হঠাৎ ভর্তি-ইচ্ছুক শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমানো কোনো ভালো সিদ্ধান্ত নয়। সবকিছু করতে হবে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা অনুসারে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ অবকাঠামো বাড়াতে ‘ভৌত মহাপরিকল্পনা’ প্রস্তুত করেছে।

তবে বিগত বছরগুলোতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসনসংখ্যা বাড়ানোর সময় অনেক বিভাগ আপত্তি করেছে। কোনো কোনো বিভাগের একাডেমিক কমিটিতে শিক্ষকেরা এ নিয়ে কথা বলেছেন। তা সত্ত্বেও বছর-বছর আসন বাড়ানো হয়েছে। এমনকি, এই সংখ্যা বৃদ্ধি করা হয়েছে অনেক ক্ষেত্রে বিভাগগুলোর সক্ষমতার দিকে না তাকিয়ে। ফলে এমনও দেখা যায়, অনেক বিভাগের শ্রেণিকক্ষে সব শিক্ষার্থীর বসার জায়গা হয় না। শিক্ষকেরা ঠিকমতো ক্লাস নিতে পারেন না শ্রেণিকক্ষের অভাবে। শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাতের ব্যবধান বেশি হওয়ার কারণে পাঠদান ও পাঠ গ্রহণও সফল করে তোলা যায় না।

তবে সবচেয়ে ভয়াবহ অবস্থা আবাসিক হলগুলোর। দুই সিটের রুমে ছয়জনকেও থাকতে হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে হলের বারান্দাকে ‘গণরুম’ বানিয়ে শিক্ষার্থীদের তোলা হয়েছে। গণরুমে তোলা আর তাঁদের নিয়ন্ত্রণ করার দায়িত্ব আবার ছাত্রনেতাদের! এসব শিক্ষার্থীকে বাধ্যতামূলকভাবে ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠনের মিছিলে যোগ দিতে হয়, বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশ নিতে হয়। তা–ও যদি এসব মিছিল বা কর্মসূচি শিক্ষার্থীবান্ধব হতো! কখনো কখনো প্রতিপক্ষকে দমনের হাতিয়ার হতে হয় নতুন শিক্ষার্থীদের। হলে সিট পাওয়ার আশায় তাঁদের অনেকে ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন। ফলে পড়াশোনাটাও ঠিকমতো ধরে রাখতে পারেন না।

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৫ ভাগ শিক্ষার্থী আবাসন সুবিধা পান। এই হারের মধ্যে ‘শুভংকরের ফাঁকি’ আছে। কারণ, একটি সিটের বিপরীতে একজন শিক্ষার্থীকে হলে তোলা হলে এই হার ১৫ ভাগে এসে নামবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পূর্ণ আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় নয়। তারপরও আবাসন ঘাটতি এখানকার প্রধান সমস্যা। ঢাকার বাইরের জেলা থেকে আসা দরিদ্র পরিবারের শিক্ষার্থীদের পক্ষে সম্ভব হয় না হোস্টেল বা মেসে থেকে পড়াশোনা চালানো। যাঁরা অনাবাসিক শিক্ষার্থী, তাঁদের সংকট গাড়ির সিটের—দাঁড়িয়ে-ঝুলে প্রতিদিন ক্যাম্পাসে আসতে হয়। কিছু শিক্ষার্থী অবশ্য একটু কৌশলী। তাঁরা উচ্চতর শিক্ষার নামে এমফিল-পিএইচডিতে ভর্তি হন, তবে ডিগ্রি সম্পন্ন করেন না কেবল আবাসিক সুবিধা ধরে রাখার জন্য। এই নিয়মে এখন বদল আনা জরুরি।

গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষাকে ‘বৃদ্ধাঙ্গুলি’ ও শিক্ষক নির্যাতন কেন?

আপাতভাবে মনে হতে পারে, আসনসংখ্যা কমানো হলে শিক্ষার্থীদের সুযোগগুলো বাড়ানো সম্ভব। তবে এই এক বছরে এ ক্ষেত্রে দৃশ্যমান কোনো পরিবর্তন আসেনি। যে বিশ্ববিদ্যালয়ে আবাসিক-অনাবাসিক দ্বৈত সুবিধা আছে, সেখানে হঠাৎ ভর্তি-ইচ্ছুক শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমানো কোনো ভালো সিদ্ধান্ত নয়। সবকিছু করতে হবে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা অনুসারে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ অবকাঠামো বাড়াতে ‘ভৌত মহাপরিকল্পনা’ প্রস্তুত করেছে। কিন্তু এ ধরনের পরিকল্পনা কোনো কাজেই আসবে না যদি না ‘একাডেমিক পরিকল্পনা’র সঙ্গে একে যুক্ত করা হয়। তা ছাড়া প্রতিটি ক্ষেত্রে সক্ষমতা ও ব্যবস্থাপনার সুষম সমন্বয় দরকার।

তারিক মনজুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.