ব্যস্ত দিনে ঠিক কবে ১০ মিনিটে রাজধানীর কুড়িল বিশ্বরোড থেকে ফার্মগেট পৌঁছেছিলাম মনে করতে পারি না। সম্ভবত করোনাকালের লকডাউনের জনমানবশূন্য সময় ছাড়া আর কখনই না। আজ রোববার দ্রুতগতির উড়াল সড়কের প্রথম দিনের যাত্রায় এমন অভিজ্ঞতাই হলো। গন্তব্য ছিল বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা থেকে কর্মস্থল কারওয়ান বাজার।
দ্রুতগতির উড়াল সড়কে প্রথম দিনে জনসাধারণের চলাচলের অভিজ্ঞতা নিয়ে প্রতিবেদন করার অ্যাসাইনমেন্ট আমার। এটা শুনেই আমার ৭৩ বছর বয়সী আম্মা সকালে বললেন, তিনি উড়াল সড়ক দেখতে চান। আম্মাকে সঙ্গী করেই সকাল ৯ টা ৪০ মিনিটে দেশের প্রথম দ্রুতগতির উড়াল সড়কে ওঠার অভিজ্ঞতা নিতে ছুটলাম।
রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার বাসা থেকে কুড়িল বিশ্বরোডের উড়াল সড়কে ঢোকার প্রশস্ত রাস্তা ঘিরে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও দায়িত্বরত কর্মীদের দেখা গেল। তাঁরা টোল প্লাজার কাছে যাওয়ার নির্দেশনা দিলেন। টোল প্লাজার কাছে পৌঁছে ৮০ টাকা টোল দিয়ে নিজের পরিচয় দিয়ে কিছু সময় অবস্থান করতে চাইলাম। গাড়ি একপাশে চাপিয়ে রাখতে বললেন দায়িত্বরত ব্যক্তিরা।
যানবাহনের চাপ কম। ছয়টির মধ্যে চারটি টোল আদায়ের কেন্দ্র দিয়ে যানবাহন পার হচ্ছে। সব ব্যক্তিগত গাড়ি। কোনো বাস বা ট্রাক নেই। আর সাইকেল, মোটরসাইকেল ও সিএনজিচালিত অটোরিকশা চলাচলের তো অনুমতিই নেই।
গতকাল শনিবার বিকেলে কাওলা থেকে তেজগাঁও পর্যন্ত সাড়ে ১১ কিলোমিটার উড়ালসড়ক উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রী টোল দিয়ে প্রথম যাত্রী হিসেবে গাড়িতে করে উড়ালসড়ক পার হন।
টোল প্লাজার একাংশের ব্যবস্থাপক হাসিব হামিদুল হক জানান, আজ সকাল ৬ টায় উড়াল সড়ক যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হয়। সকাল ৯ টা পর্যন্ত ২২৭টি গাড়ি টোল দিয়ে পার হয়েছে। বাস-ট্রাক পার হয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, চলাচল করা যানবাহনের মধ্যে ৯০ শতাংশই ব্যক্তিগত গাড়ি।
হাসিব হামিদুলের সঙ্গে কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে নজরে পড়ছিল খুব চাপ না থাকলেও গাড়ি আসছে। সামান্য সময়ের মধ্যে টোল দেওয়া হয়ে যাচ্ছে। মাহমুদ কাদির নামে একজন ব্যবসায়ী টোল দিচ্ছিলেন। তিনি তিনি বলেন, ব্যবসায়িক কাজে তিনি শান্তিনগর যাচ্ছেন। যানজট এড়াতে উড়াল সড়কে উঠেছেন।
একই প্রশ্ন জ্যোতির্ময় সাহা নামে এক ব্যক্তিকে করার পর তিনি হেসে উঠলেন। কারণ তিনি উড়াল সড়কে ঘোরার জন্য মেরুল বাড্ডার বাসা থেকে পরিবারের সদস্যকে নিয়ে কুড়িল বিশ্বরোডে এসেছেন। এখানে থেকে উড়াল সড়ক দিয়ে যাবেন মেরুল বাড্ডার বাসায়।
জ্যোর্তিময় সাহার ব্যক্তিগত গাড়ির টোল দেওয়া শেষে কথা হলো টোল আদায়কারী মোহাম্মদ জাহাঙ্গীরের সঙ্গে। একটি গাড়ি থেকে টাকা নিতে কয় মিনিট লাগছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘মিনিট না সেকেন্ড লাগছে। ৭-৮ সেকেন্ডের মধ্যে টোল আদায় শেষ হচ্ছে।’ তবে আমার অভিজ্ঞতায় সময়টা আরেকটু বেশি, তবে সেটা এক মিনিটের কম। তিনি শুধু যন্ত্রে টোল নেওয়ার সময়ের হিসাবটা দিয়েছেন। চালকের টাকা বের করে দেওয়া এবং ভাংতি ফেরত দেওয়ার সময়টাও হিসেবে ধরতে হবে।
টোলের টাকা একেক যানবাহনের জন্য একেক রকম। কার, ট্যাক্সি, স্পোর্টস ইউটিলিটি ভেহিক্যাল, মাইক্রোবাস (১৬ সিটের কম) এবং হালকা ট্রাক (৩ টনের কম)—টোল ৮০ টাকা। মাঝারি ট্রাক (৬ চাকা পর্যন্ত)—টোল ৩২০ টাকা। ট্রাক (৬ চাকার বেশি)—টোল ৪০০ টাকা। সব ধরনের বাস (১৬ সিট বা তার বেশি)—টোল ১৬০ টাকা।
সরকারি-বেসরকারি যৌথ বিনিয়োগের (পিপিপি) ভিত্তিতে ঢাকার দ্রুতগতির উড়ালসড়কের এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশ সেতু বিভাগ। ঢাকা উড়ালসড়ক প্রকল্পটি দুই ভাগে বিভক্ত। মূল নির্মাণকাজ ও সহযোগী কাজ। মূল নির্মাণকাজে ব্যয় ধরা হয়েছে ৮ হাজার ৯৪০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ২ হাজার ৪১৩ কোটি টাকা সরকার ব্যয় করছে। বাকিটা বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান খরচ করছে।
এর বাইরে জমি অধিগ্রহণ, ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন ও পরামর্শকদের পেছনে ব্যয়ে আলাদা একটি প্রকল্প আছে। এর পুরো অর্থই ব্যয় করছে সরকার। বর্তমানে এই প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়েছে ৪ হাজার ৯১৭ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে দুটি প্রকল্পে ব্যয় দাঁড়িয়েছে ১৩ হাজার ৮৫৭ কোটি টাকা।
এবার গাড়িতে চড়ে বসলাম। সঙ্গী আম্মা। গাড়ির চালক আবু বকর সিদ্দিক ৬০ কিলোমিটার বেগে গাড়ি চালাচ্ছেন। এই গতিবেগই বেঁধে দেওয়া হয়েছে। সেতু বিভাগ বলেছে, মূল উড়ালসড়কে ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ৬০ কিলোমিটার গতিতে যানবাহন চলাচল করতে পারবে। আর ওঠা-নামার স্থানে (র্যাম্প) সর্বোচ্চ গতিসীমা ঘণ্টায় ৪০ কিলোমিটার। আশপাশ দিয়ে ব্যক্তিগত গাড়ি যাচ্ছে। ফাঁকা রাস্তায় চলতে বেশ আনন্দ হচ্ছে।
ব্যস্ত দিনে সকালে এই এলাকা দিয়ে যাঁরা চলাচল করেন তাঁরা জানেন, কি পরিমাণ যানজটে পড়তে হয়। যানজট এড়াতে টোল দিয়ে উড়াল সড়কে যাওয়াটা কতটা লাভজনক হয়েছে বুঝতে গুগল মানচিত্রে যানজটের অবস্থাটা দেখে নিলাম। কারণ উড়ালসড়কে গাড়ি থেকে রেলিংয়ের বাইরে নিচে দেখার সুযোগ নেই। মানচিত্রে শুধু লাল আর লাল দাগ।
অর্থাৎ যানজট আছে। ছোটবেলায় ট্রেনে চড়ার স্মৃতি এসে ঝাপটা দিলো। রেল ক্রসিংয়ে গেট ফেলে অন্য যানবাহন আটকে ট্রেন দাপটের সঙ্গে বেরিয়ে যেত। এখনো যায়। উড়ালসড়ক থেকে চারপাশের দৃশ্য অপরিচিত লাগছিল। অনভিজ্ঞতায় বুঝতে পারছিলাম না ঠিক কোন জায়গা পার হচ্ছি।
উড়াল সড়ক থেকে রওনা দিয়েছিলাম সকাল ১০ টা ৪ মিনিটে। ১০ টা ১৪ মিনিটে পৌঁছে গেলাম ফার্মগেটের ইন্দিরা রোডে। অর্থাৎ সাড়ে ১১ কিলোমিটার পার হতে লাগল ১০ মিনিট। গন্তব্য কারওয়ান বাজার। ফার্মগেটের যানজট ঠেলে কারওয়ান বাজার পর্যন্ত দুই কিলোমিটার দূরত্ব পার হতে লাগল ২৩ মিনিট।
সবশেষে আমার আম্মা জালোওয়াশান আখতার খানের অনুভূতি জানতে চাইলাম। আম্মা হেসে বললেন, ‘ওপরে (উড়াল সড়ক) তো অনেক ভালো লাগল। নিচে (ফার্মগেট) এত জ্যাম!’