খামারে উৎপাদিত যেসব ডিম ঢাকা শহরে পাওয়া যায়, তাতে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি মাত্রায় ভারী ধাতুর উপস্থিতি পাওয়া গেছে। সর্বোচ্চ অনুমোদিত মাত্রার (ম্যাক্সিমাম পার্মিসিবল লিমিট বা এমপিএল) চেয়ে বেশি পরিমাণে দস্তা, তামা, সিসা ও লোহা পাওয়া গেছে ডিমে। মাত্রাতিরিক্ত এসব ভারী ধাতুর কারণে স্বাস্থ্যঝুঁকির আশঙ্কা রয়েছে।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ (বিসিএসআইআর) এবং হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছয়জন গবেষকের যৌথ গবেষণায় এমন তথ্য উঠে এসেছে।
ডিমের মাধ্যমে বিষাক্ত পদার্থ গ্রহণ এবং ঢাকা নগরীর মানুষের সম্ভাব্য স্বাস্থ্যঝুঁকি পরিমাপ নামের সেই গবেষণা নেদারল্যান্ডসভিত্তিক চিকিৎসা ও বিজ্ঞানবিষয়ক জার্নাল সায়েন্স ডিরেক্টের ওয়েবসাইটে গত ২৮ জুন প্রকাশিত হয়েছে।
সারা দেশে লাখ লাখ টন খাবার তৈরি হয়। সব খাবারের তথ্য আমাদের কাছে নেই। ডিমের পাশাপাশি খাদ্য নিয়েও গবেষণা হোক। তখন বোঝা যাবে কোন খাদ্যটা খারাপ।
এই গবেষণায় ডিমে ১০টি ভারী ধাতুর উপস্থিতি খোঁজা হয়। তাতে ডিমে সব কটি ধাতুরই উপস্থিতি পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ছয়টি ধাতুর উপস্থিতি সর্বোচ্চ অনুমোদিত মাত্রার (এমপিএল) মধ্যে রয়েছে। বাকি চারটি (দস্তা, তামা, সিসা ও লৌহ) ধাতুর উপস্থিতি পাওয়া গেছে এমপিএলের চেয়েও বেশি। ডিমে তামার এমপিএল ১০, সেখানে পাওয়া গেছে ২৪.৯ পর্যন্ত; সিসার এমপিএল ০.১, সেখানে পাওয়া গেছে ১.৯ পর্যন্ত; লোহার এমপিএল ১৭.৬, সেখানে পাওয়া গেছে ৬৪.৫৯ পর্যন্ত এবং দস্তার এমপিএল ২০, সেখানে পাওয়া গেছে সর্বোচ্চ ৩৯.২৬।
ক্যানসার, হৃদ্রোগ, শ্বাসপ্রশ্বাসে জটিলতা, রক্তশূন্যতা, মস্তিষ্ক-কিডনি-স্নায়ুর ক্ষতিসহ নানা ধরনের শারীরিক সমস্যার জন্য দায়ী থাকে বাড়তি মাত্রায় থাকা এসব ভারী ধাতু। গবেষণায় বলা হয়েছে, ডিমে এসব ভারী ধাতুর উপস্থিতি প্রাপ্তবয়স্কদের চেয়ে শিশু ও বয়স্কদের জন্য বেশি ঝুঁকি তৈরি করে।
এমন পরিস্থিতিতে আজ পালিত হচ্ছে বিশ্ব ডিম দিবস। প্রতিবছরের অক্টোবর মাসের দ্বিতীয় শুক্রবার দিবসটি পালিত হয়। সরকারের প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে দিবসটি পালন করবে।
ঢাকার ৬টি বাজার থেকে ডিম সংগ্রহ
ঢাকা শহরের মানুষ যে ডিম খায়, তাতে ভারী পদার্থের উপস্থিতি আছে কি না, তা দেখার জন্য এই গবেষণা করা হয়। ফলে গবেষণার জন্য কিছু পাইকারি বাজার নির্বাচন করা যায়, যেখান থেকে ডিম পুরো ঢাকা শহরে ছড়িয়ে যায়। এমন ছয়টি বাজার থেকে গবেষকেরা ১২টি করে মোট ৭২টি ডিম সংগ্রহ করেন। ২০২০ সালের ১২ থেকে ১৭ জুলাই পর্যন্ত মহাখালী, মোহাম্মদপুর, সাভার, মিরপুর-১, যাত্রাবাড়ী ও কারওয়ান বাজারের পাইকারি বাজার থেকে ডিমগুলো সংগ্রহ করা হয়।
গবেষণাটি করেছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক মো. শাহজাহান, অধ্যাপক আবদুস সামাদ ও মো. মাহমুদুল হাসান; একই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক দোলন রায়; বিসিএসআইআরের কেমিক্যাল গবেষণা বিভাগের খন্দকার শাহীন আহমেদ এবং হাজী দানেশের পরিসংখ্যান বিভাগের শিক্ষক স্মিতা সরকার।
এ বিষয়ে গবেষক দলের সদস্য অধ্যাপক আবদুস সামাদ জানান, ভারী ধাতু বিশ্লেষণের জন্য বিসিএসআইআরের গবেষণাগার ব্যবহার করা হয়েছে। বিশ্লেষণের আগে নমুনা সংগ্রহ ও প্রস্তুতি প্রক্রিয়ার কাজ করা হয়েছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা প্রকল্পের তহবিলের টাকায় হয়েছে গবেষণাটি।
ধারণা করছি, খাবারের মাধ্যমে মুরগির শরীরে বিষাক্ত ভারী ধাতু প্রবেশ করছে। সেখান থেকে ডিমে। আর ডিম থেকে মানুষের শরীরে। তাই খামারে পালন করা মুরগির খাবার আরও নিরাপদ হওয়া উচিত।
ট্যানারির বর্জ্য ঢাকা ও চট্টগ্রামের কিছু জায়গায় প্রক্রিয়াকরণ হয় এবং পরে সেগুলো পোলট্রির খাদ্য উৎপাদনে ব্যবহৃত হয় বলে উল্লেখ করেন প্রান্তিক খামারিদের সংগঠন বাংলাদেশ পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশনের (বিপিএ) সভাপতি সুমন হাওলাদার। তিনি বলেন, খাদ্য উৎপাদনকারীরা নিরাপদ পোলট্রি খাদ্য না দিলে প্রান্তিক খামারিরা নিরাপদ মুরগির মাংস ও ডিম দিতে পারবেন না।
মুরগির খাদ্য নিয়ে আরও গবেষণা হওয়া উচিত বলে মনে করেন অন্যতম গবেষক জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক দোলন রায়। তিনি বলেন, ‘ধারণা করছি, খাবারের মাধ্যমে মুরগির শরীরে বিষাক্ত ভারী ধাতু প্রবেশ করছে। সেখান থেকে ডিমে। আর ডিম থেকে মানুষের শরীরে। তাই খামারে পালন করা মুরগির খাবার আরও নিরাপদ হওয়া উচিত।’