চলতি বছর ডেঙ্গুতে মৃতদের ৫৫ শতাংশের প্রাণ গেছে হাসপাতালে ভর্তির এক দিনের মধ্যে। দুই থেকে তিন দিনের মধ্যে ২৬ শতাংশের মৃত্যু হয়েছে। চার থেকে পাঁচ দিনের মধ্যে ৭ শতাংশ এবং ৬ থেকে ১০ দিনের মধ্যে ১২ শতাংশের মৃত্যু হয়েছে। চিকিৎসকরা বলছেন, জ্বর এলে প্রথমে গুরুত্ব না দেওয়ায় দ্রুত ডেঙ্গু শনাক্ত না হওয়া এবং আক্রান্তদের হাসপাতালে দেরিতে ভর্তির কারণে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে।
গত ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মারা যাওয়া ৫৯৩ জনের তথ্য পর্যালোচনা করে এসব জানতে পেরেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। আট মাসে মৃত সব রোগীর তথ্যই পর্যালোচনা করেছে অধিদপ্তর। এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মোট ৬৩৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে ৪১ জন মারা গেছেন চলতি মাসের প্রথম তিন দিনে।
জনস্বাস্থ্যবিদরা বলছেন, ডেঙ্গু রোগী শনাক্তে দেরি হচ্ছে। রোগী ব্যবস্থাপনায় ঘাটতিতে এবার মৃত্যুসংখ্যা বেড়েছে। দ্রুত রোগ শনাক্তে বিনামূল্যে ডেঙ্গু পরীক্ষার ব্যবস্থা রাখতে হবে। সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা জনস্বাস্থ্যবিদ মুশতাক হোসেন বলেন, করোনা মহামারির সময় সাধারণ ও করোনা রোগী যেন মিলেমিশে না যায়, সে জন্য হাসপাতালে ট্রায়েজ ব্যবস্থা (রোগী বাছাই করে পৃথক করা) চালুর চেষ্টা হয়েছিল। সেই অভিজ্ঞতা ডেঙ্গুর এই জরুরি পরিস্থিতিতে কাজে লাগানো দরকার। সেটা হচ্ছে না। ডেঙ্গু শনাক্ত হলেও সবাই চিকিৎসার আওতায় আসছে না। হাসপাতালে রেখে সব ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। অনেকের জটিল উপসর্গ না থাকায় বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এটা মৃত্যুর বড় কারণ।
তিনি বলেন, রোগী শনাক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসকের পর্যবেক্ষণে রাখা জরুরি। তবে ঢাকায় প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার তেমন কোনো ব্যবস্থা নেই। ফলে গুরুতর অবস্থায় হাসপাতালে যেতে বাধ্য হচ্ছে রোগী। তাই দেরিতে হাসপাতালে আসার কথা বলে রোগীর ঘাড়ে দোষ চাপানো অত্যন্ত আপত্তিকর। সরকার তো পরীক্ষার ব্যবস্থাই নিশ্চিত করতে পারেনি। দেশের অধিকাংশ মানুষ শ্রমজীবী। তাদের কাজ না করলে ভাত জুটবে না। কাজ করতে করতে গুরুতর অবস্থায় তারা হাসপাতালে আসছে। এ জন্য রোগীকে দায়ী করা যায় না। মারা যাওয়া রোগীর অধিকাংশের বয়স ২০ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে। তারা কাজের প্রয়োজনে অধিকাংশ সময় বাসার বাইরে থাকে। এটাই বেশি মৃত্যুর কারণ কিনা, তা নিয়ে পর্যালোচনা প্রয়োজন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পর্যালোচনায় আরও দেখা গেছে, মৃতদের বড় অংশ কর্মক্ষম। বেশি মারা যাচ্ছেন নারী। এ পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত পুরুষ রোগীর মধ্যে ০.৩২ শতাংশ মারা গেছেন। নারীর মৃত্যু হার ০.৭৩ শতাংশ।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার পর্যালোচনায় দেখা যাচ্ছে, মারা যাওয়া ব্যক্তিদের ৪২ শতাংশের বয়স ২০ থেকে ৪০ বছর। তারা কাজের জন্য ঘরের বাইরে থাকেন বেশি। ইতোমধ্যে একশরও বেশি শিশুর মৃত্যু হয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক নাজমুল ইসলাম বলেন, দ্বিতীয় বা তৃতীয়বার ডেঙ্গু আক্রান্ত ব্যক্তিরা বেশি মারা যাচ্ছেন। রোগীরা ডেঙ্গু হলে ভাবেন, কাল বা পরশু হাসপাতালে যাব। অনেকে হাতুড়ে চিকিৎসক বা পাড়ার ওষুধের দোকান থেকে ওষুধ কিনে খান। এর মধ্যে রোগী শকে চলে যান। রোগীদের দেরিতে হাসপাতালে আসা আমাদের কাছে চ্যালেঞ্জিং। খারাপ রোগীর চিকিৎসা দিলেও ফিরে আসে কম, সে জন্য মৃত্যু বাড়ছে। জ্বর হলে কেউ যেন একদিনও দেরি না করে টেস্ট করে, ডাক্তারের কাছে যায়– এটা রোগীদের প্রতি আমাদের অনুরোধ।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক আহমেদুল কবীর বলেন, দেরিতে হাসপাতালে আসায় ডেঙ্গু রোগীর মৃত্যু বেশি হচ্ছে। অধিকাংশ রোগী শকে চলে যাচ্ছে। প্লাটিলেট বা ব্লিডিং কোনো ইস্যু নয়। রোগীরা মনে করে, ডেঙ্গু হয়েছে বাসায় চিকিৎসা করব। অনেকেই পরিচিত চিকিৎসকের কাছে টেলিফোনে যোগাযোগ করে চিকিৎসা নিয়ে বাসায় থাকে। এটা উচিত নয়। এই রোগীদের অবস্থা সবচেয়ে বেশি খারাপ হয়। প্রত্যেকের উচিত ডেঙ্গু আক্রান্ত হলে একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দেখানো। সশরীরে দেখলে চিকিৎসক বুঝতে পারেন রোগী শকে চলে যাবে কিনা।
তিনি বলেন, সতর্ক সংকেত শুরুর আগে বা শুরুর পরপরই এলে তা সহজে ম্যানেজ করা যায়। অনেক সময় রোগী আর্থিক কারণ ও বাসা কাছে থাকার কথা বলে চলে যেতে চায়। এসব ক্ষেত্রে রোগীকে হাসপাতালে রাখতে ডাক্তারকে বেশি সক্রিয় হতে হবে। আগে হাসপাতালে এলে অনেক ক্ষেত্রে মৃত্যু এড়ানো সম্ভব।
এবার শক সিনড্রোমে মৃত্যুর হার অনেক বেশি। শক সিনড্রোমে ৬৪ শতাংশের মৃত্যু হয়েছে। এ ছাড়া এক্সপান্ডেড ডেঙ্গু সিনড্রোম ২৪ শতাংশ, ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার আক্রান্ত ছিল ১২ শতাংশ রোগী।