ডেঙ্গুতে ৪১% মৃত্যু জেলার বাইরে

0
93
ডেঙ্গু মশা

খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চলতি বছর এ পর্যন্ত ছয় ব্যক্তি ডেঙ্গুতে মারা গেছেন। এর মধ্যে পাঁচজনই জেলা সদরের বাইরের। আর একজন খুলনা শহরের। খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) সুহাস রঞ্জন হালদার মঙ্গলবার এ তথ্য জানান। তিনি বলেন, ‘শহরের বাইরের এই পাঁচজন অন্য জেলার বাসিন্দা কি না, তা খাতা দেখে বলতে হবে। তবে জেলার বিভিন্ন উপজেলার পাশাপাশি আশপাশের জেলা থেকেও রোগী আসছে।’

চলতি বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে এযাবৎ যাঁদের মৃত্যু হয়েছে, তাঁদের মধ্যে ৪০ শতাংশের বেশি মারা গেছেন নিজ জেলার বাইরে। বাকিরা মারা গেছেন নিজ জেলাতেই।

নিজ জেলার বাইরে ডেঙ্গুতে এত মৃত্যু চিকিৎসক ও জনস্বাস্থ্যবিদের কাছে ভাবনার বিষয়। তাঁরা এর পেছনে কয়েকটি কারণ উল্লেখ করেছেন। এক, স্থানীয় চিকিৎসার প্রতি মানুষ আস্থা রাখতে পারছে না। দুই, ঢাকা বা বড় শহরের বাইরে চিকিৎসা পরিকাঠামো এখনো মানসম্পন্ন নয়। তিন, নিজ জেলার বাইরে যখন একজন ডেঙ্গু রোগী যাচ্ছেন, তখন তাঁর ঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে, মৃত্যু ত্বরান্বিত হচ্ছে।

৪০ শতাংশের বেশি মৃত্যু অন্য স্থানে হওয়ার যে চিত্র পাওয়া গেছে, তা কাঙ্ক্ষিত নয়। স্থানীয় হাসপাতালের ওপর আস্থাহীনতা আছে বলে মনে হয়।ডা. মুশতাক হোসেন, উপদেষ্টা, আইইডিসিআর

গত ২১ জুলাই সরকারের নানা দপ্তরের সঙ্গে ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)। সেখানে ডেঙ্গু পরিস্থিতি, ডেঙ্গুতে মৃত্যু, এর চিকিৎসা, সরকারি–বেসরকারি নানা উদ্যোগ—এসব নানা বিষয় উঠে আসে। সেখানেই ডেঙ্গুতে কোথায় মৃত্যু হচ্ছে, সে বিষয়টিও তুলে ধরেন ডব্লিউএইচওর প্রতিনিধিরা। সেখানে তাঁদের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, চলতি বছরের ১৯ আগস্ট পর্যন্ত যাঁরা মারা গেছেন, তাঁদের ৪১ শতাংশের মৃত্যু হয়েছে নিজ জেলার বাইরে। আর ৫৯ শতাংশ নিজ জেলাতেই মারা গেছেন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক বে–নজির আহমেদ বলেন, অনেক সময় রোগীর জন্য হাসপাতালে শয্যা পাওয়া যায় না। চিকিৎসার অতিরিক্ত খরচ একটা সমস্যা। তাই রোগী নিয়ে এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে ছোটাছুটি রোগীর মৃত্যুকে ত্বরান্বিত করতে পারে। ঢাকার বাইরে চিকিৎসার অপ্রতুলতার উদাহরণ হিসেবে দেশের বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে আইসিইউ সেবা না থাকার কথাও তুলে ধরেন তিনি।

হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ডেঙ্গু রোগী
হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ডেঙ্গু রোগী

হাসপাতালের ওপর আস্থাহীনতা, স্থানীয় পর্যায়ে চিকিৎসার অপ্রতুলতার যেসব বিষয় জনস্বাস্থ্যবিদেরা তুলেছেন, তা পুরোপুরি মানতে নারাজ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘হাসপাতালের প্রতি আস্থাহীনতা সব দেশেই আছে। আর এটা আমাদের এখানে একদিনে তৈরি হয়নি।’

সুনির্দিষ্ট কোন জেলা থেকে ভিন্ন কোন জেলায় মৃত্যু হয়েছে রোগীদের, এর বিস্তারিত কোনো তথ্য ডব্লিউএইচওর প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়নি। তবে প্রতিবেদনে দেশের মানচিত্র দিয়ে রোগীদের এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাওয়ার চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। দেখা গেছে, সর্বোচ্চসংখ্যক রোগী আসছেন ঢাকা শহরে। সিলেট বিভাগের কিছু এলাকা বাদ দিয়ে প্রায় সব জায়গা থেকেই ঢাকায় রোগী এসেছেন। এরপরই আছে চট্টগ্রাম। সেখানে এ জেলার বিভিন্ন উপজেলার পাশাপাশি ফেনী, নোয়াখালী, পার্বত্য তিন জেলা ও লক্ষ্মীপুরের রোগী এসেছেন। তৃতীয় সর্বোচ্চ বড় যে শহরে অন্য জায়গা থেকে রোগীরা গেছেন, তার মধ্যে আছে বরিশাল। সেখানে বিভাগের বিভিন্ন জেলার রোগীদের আসার চিত্র পাওয়া গেছে।

ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসার জন্য বিভিন্ন হাসপাতালে যাওয়ার চিত্রের সঙ্গে সেখানকার মৃত্যুর সংখ্যার একটা সাযুজ্য দেখা গেছে। যেমন সবচেয়ে বেশি রোগী ছুটেছেন ঢাকায়, সেখানে মৃত্যুও বেশি। এরপরই আছে চট্টগ্রাম, বরিশাল।

ঢাকার হাসপাতালগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু মুগদা হাসপাতালে—৯৮ জন। এরপরই আছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল—৯০ জন। ঢাকার বাইরে সর্বোচ্চ মৃত্যু চট্টগ্রাম বিভাগে, ৫৭ জন। আর এ শহরের মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা গেছেন ৩৪ জন।

চট্টগ্রামের পর দেশের সর্বোচ্চ সংক্রমণ বরিশাল বিভাগে। এ বিভাগে মৃত্যু হয়েছে ৩৭ জনের। এর মধ্যে শের–ই–বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেই মারা গেছেন ২৫ জন। হাসপাতালের সহকারী পরিচালক (প্রশাসন) মো. মনিরুজ্জামান বলেন, ‘এ হাসপাতালে এ পর্যন্ত ডেঙ্গুতে যে ২৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। তাঁরা কে কোন জেলার বাসিন্দা, সে তথ্য আমরা এক জায়গায় করিনি। তবে অনেকেই মুমূর্ষু অবস্থায় এসেছেন। যখন অনেক ক্ষেত্রে কিছু করার ছিল না।’

উন্নত চিকিৎসার জন্য মানুষ বড় হাসপাতালে আসবে, এটা স্বাভাবিক বলেই মনে করেন চিকিৎসকেরা। কিন্তু রোগীর অবস্থা নাজুক হওয়ার আগেই তার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা স্থানীয়ভাবে নেওয়া দরকার বলে মনে করেন তাঁরা। আর সেই বন্দোবস্ত থাকলে মৃত্যু রোধ করা যায় বলে মনে করেন সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন। তিনি বলেন, ৪০ শতাংশের বেশি মৃত্যু অন্য স্থানে হওয়ার যে চিত্র পাওয়া গেছে, তা কাঙ্ক্ষিত নয়। স্থানীয় হাসপাতালের ওপর আস্থাহীনতা আছে বলে মনে হয়। আবার ডেঙ্গুর যে চিকিৎসা নির্দেশিকা দেওয়া হয়েছে, তা মাঠপর্যায়ে পালন করা হচ্ছে কি না বা সেটার তদারকি হচ্ছে কি না, সেটাও প্রশ্ন।

আরও ৭ জনের মৃত্যু

দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে আরও ৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে চলতি বছর ডেঙ্গুতে ৫৭৬ জন মারা গেলেন। আর আগস্টে এ পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে ৩২৫ জনের। গতকাল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম থেকে পাঠানো বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে। এতে বলা হয়, গত ২৪ ঘণ্টায় (মঙ্গলবার সকাল আটটা থেকে বুধবার সকাল আটটা পর্যন্ত) ডেঙ্গুতে ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে পাঁচজন এবং ঢাকার বাইরের হাসপাতালে দুজন মারা গেছেন।

পার্থ শঙ্কর সাহা

ঢাকা

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.