ডেঙ্গুতে মৃত্যু বাড়ছেই। গেল সেপ্টেম্বরে দেশে ডেঙ্গুতে সর্বোচ্চ মৃত্যু ও সংক্রমণ হয়েছিল। পরিস্থিতি দেখে একাধিক জনস্বাস্থ্যবিদ ও বিশেষজ্ঞ ওই মাসে বলেছিলেন, অক্টোবর বা নভেম্বরে পরিস্থিতি নাজুক হয়ে উঠতে পারে। এ মাসের শুরুতেই ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়তে শুরু করেছে। সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় (গতকাল শনিবার সকাল আটটা থেকে আজ রোববার সকাল আটটা পর্যন্ত) নয়জনের মৃত্যু হয়েছে। আর এ সময় এক দিনে চলতি বছরের সর্বোচ্চ সংখ্যায় রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এর আগে গত ২১ সেপ্টেম্বর ২৪ ঘণ্টায় এডিস মশাবাহিত এ রোগে আক্রান্ত হয়ে নয়জনের মৃত্যু হয়েছিল। এটি ছিল এ বছরের সর্বোচ্চ মৃত্যু। আজ আবার নয়জন মারা গেলেন।
জনস্বাস্থ্যবিদ অধ্যাপক বে-নজীর আহমদ আজ বলেন, এভাবে দিনের পর দিন ডেঙ্গুতে মৃত্যু হচ্ছে আর সরকার নিষ্ক্রিয় দর্শক হিসেবে তা দেখছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়—সর্বোপরি সরকারের কাছে ডেঙ্গুতে মৃত্যু যেন কাঙ্ক্ষিত হয়ে গেছে। তাদের কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা যায় না। যদি দিনের পর দিন এভাবে মৃত্যু ও সংক্রমণ বাড়তে থাকে, তবে তা সরকারের নিষ্ক্রিয়তাই প্রমাণ করে।
আজ স্বাস্থ্য অধিদপ্তর যে ৯ জনের মৃত্যুর খবর দিয়েছে, তার মধ্যে ছয়জনেরই মৃত্যু হয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের এলাকার হাসপাতালগুলোয়। বাকি দুজনের মৃত্যু হয়েছে ঢাকা উত্তর সিটি ও চট্টগ্রাম বিভাগে। তাঁদের মধ্যে চারজন মারা গেছেন ঢাকার মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে, দুজন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। বাকি তিনজন মারা গেছেন ডিএনসিসি কোভিড–১৯ হাসপাতাল, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও কক্সবাজারের ২৫০ শয্যার হাসপাতালে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে ১ হাজার ৪২ রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে ৭১৭ জন পুরুষ এবং ৩২৫ জন নারী। একই সময়ে চিকিৎসা শেষে সুস্থ হয়ে বাড়িতে ফিরেছেন ৬৮৩ জন রোগী।
চলতি বছর এর আগে ২৪ ঘণ্টায় এত রোগী ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হননি।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. মুশতাক হোসেন আজ বলেন, ‘গতানুগতিক পন্থায় সরকার পরিস্থিতি মোকাবিলার চেষ্টা করছে বলেই পরিস্থিতি এত নাজুক হয়ে পড়েছে। তারা ভেবেছিল, এভাবেই পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। বাস্তবে যে এটা হয় না, তার প্রমাণ মিলছে। আমরা শুরু থেকেই এবারের পরিস্থিতি নাজুক হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করেছিলাম। কিন্তু সরকার এতে কান দেয়নি। ডেঙ্গু ছড়িয়েছে ঢাকার বাইরে বেশি। এদিকে সব নজর ঢাকার দিকে। স্বাস্থ্যব্যবস্থার বিকেন্দ্রীকরণ ছাড়া পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হবে না।’
সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ৩২২ জন ডেঙ্গু নিয়ে ঢাকার দুই সিটির হাসপাতালগুলোয় ভর্তি হয়েছেন। গাজীপুরের শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১৫০ জন। ঢাকার দুই সিটির বাইরে বিভাগভিত্তিক তথ্য অনুযায়ী, সর্বোচ্চ সংক্রমণ হয়েছে বরিশাল বিভাগে। এ বিভাগে ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা ১৯৫। এর মধ্যে বরগুনার হাসপাতালগুলোয় ভর্তি হয়েছেন ৬৪ জন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বয়সভিত্তিক রোগী ২১ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে।
দেশে ২০০০ সালে যখন নতুন করে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব হয়, তখন তা ছিল মূলত রাজধানীকেন্দ্রিক রোগ। কিন্তু দিন দিন এটা ছড়িয়ে গেছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। গত বছর থেকেই ডেঙ্গু ঢাকার বাইরে ছড়িয়েছে ব্যাপক হারে। চলতি বছর এখন পর্যন্ত ঢাকার বাইরে আক্রান্ত হয়েছেন ৩৬ হাজার ৪৭৮ জন। আর ঢাকায় আক্রান্তের সংখ্যা ১৩ হাজার ৪২৯।
জনস্বাস্থ্যবিদ বে–নজীর আহমদ বলছিলেন, ডেঙ্গু মোকাবিলায় ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের নানা সীমাবদ্ধতা থাকলেও এখানে বিশেষ করে মশা নিয়ন্ত্রণে কিছু উদ্যোগ আছে। তাদের অভিজ্ঞতাও আছে। কিন্তু দেশের অন্যত্র এটা প্রায় অনুপস্থিত। ঢাকার বাইরে, বিশেষ করে পৌরসভাগুলোয় মশা নিয়ন্ত্রণে প্রায় কোনো উদ্যোগই নেই। ডেঙ্গু পরিস্থিতি এবার সত্যিই খুব ভীতিকর।