রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর জন্য বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি ও কক্সবাজারের টেকনাফে পৃথক পাঁচটি ট্রানজিট কেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে। আগামী নভেম্বর মাসের মধ্যে কেন্দ্রগুলোর নির্মাণকাজ শেষ হলে ডিসেম্বরে প্রত্যাবাসন শুরু হতে পারে। প্রত্যাবাসন নিয়ে আশ্রয়শিবিরগুলোয় তোড়জোড় শুরু হয়েছে। নিরাপদ বসবাসের নিশ্চয়তা পেলে দেশে ফিরতে রাজি অধিকাংশ রোহিঙ্গা।
কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি আশ্রয়শিবিরে বর্তমান নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা সাড়ে ১২ লাখ। এর মধ্যে ৮ লাখ এসেছে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পরের কয়েক মাসে। কিন্তু গত ছয় বছরে একজন রোহিঙ্গাকেও মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো যায়নি।
এখন চীনের মধ্যস্থতায় পাইলট প্রকল্পের আওতায় ১ হাজার ১৭৬ জন রোহিঙ্গাকে রাখাইনে ফেরত পাঠানোর প্রস্তুতি চলছে। আগামী ডিসেম্বর মাসের মধ্যে যেকোনো সময় এই প্রত্যাবাসন শুরু হতে পারে বলে জানান শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) ও অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ মিজানুর রহমান। তিনি বলেন, ‘রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য নাইক্ষ্যংছড়ি ও টেকনাফে পৃথক পাঁচটি ট্রানজিট কেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে।
আশ্রয়শিবির থেকে তালিকাভুক্ত রোহিঙ্গাদের প্রথমে ট্রানজিট কেন্দ্রে আনা হবে। তারপর আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন করা হবে। আমাদের প্রস্তুতি অনেক, সরকার সিদ্ধান্ত জানালে প্রত্যাবাসন শুরু হবে।’ প্রায় ছয় কোটি টাকা ব্যয়ে পাঁচটি ট্রানজিট কেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে জানিয়ে মিজানুর রহমান বলেন, ‘স্থল ও নাফ নদী—দুই পথেই প্রত্যাবাসন হবে।’
পাঁচ ট্রানজিট কেন্দ্রের তিনটি ঘুমধুমে
আরআরআরসি ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা জানান, ১৯৯০ সালে মিয়ানমারের প্রায় ২ লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশ আশ্রয় নিয়েছিল। এর মধ্যে পৌনে দুই লাখ রোহিঙ্গাকে টেকনাফের কেরনতলীর ট্রানজিট কেন্দ্র থেকে নাফ নদী অতিক্রম করে ফেরত পাঠানো হয়েছিল মিয়ানমারে। যদিও পরবর্তী সময়ে এসব রোহিঙ্গা সীমান্ত পথে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছিল। এবার স্থলপথে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম ইউনিয়নকে বেছে নেওয়া হচ্ছে। তাতে নিরাপদ প্রত্যাবাসন সহজ হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
দেখা গেছে, বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের মৈত্রী সেতুর (লাল ব্রিজ) উত্তরাংশে ঘুমধুম সীমান্তে নির্মাণ করা হচ্ছে একটি ট্রানজিট কেন্দ্র। ১২ অক্টোবর সেখানকার একখণ্ড জায়গা বুঝে নিয়ে ট্রানজিট কেন্দ্রের সাইনবোর্ড টাঙিয়ে দেয় আরআরআরসি কার্যালয়। এই কেন্দ্রের কাছে বিজিবির একটি ফাঁড়ি রয়েছে। মৈত্রী সেতুর ওপারে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য, সেখানে রয়েছে দেশটির সীমান্তরক্ষী বিজিপির (বর্ডার গার্ড পুলিশ) আরেকটি ফাঁড়ি। ছোট্ট একটি খাল দুই দেশের সীমান্তকে ভাগ করে রেখেছে।
ঘুমধুম ইউনিয়নের তুমব্রু পশ্চিম ও পাহাড়পাড়াতে আরও দুটি ট্রানজিট কেন্দ্র নির্মাণ করা হবে। সেখানে সরকারি জমি চিহ্নিতকরণের কাজ চালাচ্ছে নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা ভূমি কার্যালয়।
নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রোমেন শর্মা বলেন, স্থলপথে মিয়ানমারে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য ট্রানজিট কেন্দ্রগুলো নির্মাণ করা হচ্ছে।
আরআরআরসি মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, নাইক্ষ্যংছড়ি তিনটি কেন্দ্র থেকে স্থলপথে রাখাইনে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন হবে। আর টেকনাফের ট্রানজিট কেন্দ্র থেকে প্রত্যাবাসন হবে নাফ নদী অতিক্রম করে।
নিরাপদ প্রত্যাবাসনে রাজি রোহিঙ্গারা
টানা ছয় বছর ধরে টেকনাফের শালবাগান আশ্রয়শিবিরের সি-৪ ব্লকে সপরিবার বাস করছেন রোহিঙ্গা মোহাম্মদ ফারুখ। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে কথা হয় তাঁর সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমরা দ্রুত মিয়ানমারে ফিরতে চাই, কিন্তু রাখাইনে নিরাপদে থাকার নিশ্চয়তা দিতে হবে মিয়ানমারকে।’
গত মে মাসে কক্সবাজারের আশ্রয়শিবির থেকে ২০ জনের একটি রোহিঙ্গা প্রতিনিধিদল রাখাইন রাজ্য পরিদর্শনে গিয়েছিল। সে দলে ছিলেন মোহাম্মদ ফারুখও। ফারুখ বলেন, প্রত্যাবাসন উপযোগী পরিবেশ সেখানে (রাখাইনে) আছে কি না, তা দেখাতে তাঁদের সেখানে নেওয়া হয়েছিল। তখন রোহিঙ্গাদের মংডু শহরের কাছে নির্মিত ‘মডেল ভিলেজ’ নামের আশ্রয়শিবিরে রাখার কথা বলা হয়েছিল। মডেল ভিলেজে থাকতে রাজি নয় জানানোর পর মিয়ানমার এখন রোহিঙ্গাদের ফেলে আসা বসতভিটাতে তাদের পুনর্বাসনে রাজি হয়েছে। রোহিঙ্গারাও সেখানে ফিরতে রাজি।
টেকনাফের শালবাগান আশ্রয়শিবিরের একটি দোকানে আড্ডা দিচ্ছিলেন কয়েকজন রোহিঙ্গা। আলোচনার বিষয় ছিল প্রত্যাবাসন। তাঁদের একজন মনজুল আলম বলেন, ‘আমরা ফিরতে পারলেই ভালো। বাংলাদেশের ত্রিপলের ছাউনিতে সবকিছু বিনা মূল্যে পাওয়া গেলেও কোনো ভবিষ্যৎ নেই। আমরা নিজের জন্মভূমিতেই (রাখাইনে) প্রতিষ্ঠিত হতে চাই।’
উখিয়ার কুতুপালং আশ্রয়শিবিরের রোহিঙ্গা নেতা ছৈয়দ করিম বলেন, ‘রাখাইনে স্বাধীনভাবে বসবাসের সুযোগ-সুবিধা পেলে বাংলাদেশে থাকা সব রোহিঙ্গা ফিরে যাবে। কিন্তু এখন যে প্রক্রিয়ায় প্রত্যাবাসন শুরু হতে যাচ্ছে, তাতে ১২ লাখ রোহিঙ্গার ফিরে যেতে ৩০ বছর সময় লাগবে। আমরা একসঙ্গে ১০ থেকে ১৫ হাজার করে ফিরতে চাই।’
রোহিঙ্গা নেতারা বলেন, জোর করে কোনো রোহিঙ্গাকে প্রত্যাবাসনের চেষ্টা করা হলে, তা ভেস্তে যেতে পারে। রাখাইনে বসবাসের উপযোগী পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। ভবিষ্যতে যাতে রোহিঙ্গারা নিপীড়নের শিকার না হয় এবং পুনরায় বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে না হয়, সেই নিশ্চয়তাও রোহিঙ্গাদের দিতে হবে। প্রত্যাবাসনের সঙ্গে জাতিসংঘের উদ্বাস্তুবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআরকেও যুক্ত রাখা দরকার।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, জোর করে প্রত্যাবাসনে আগ্রহী নয় যুক্তরাষ্ট্র। সর্বশেষ ১৭ অক্টোবর উখিয়ার রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবির পরিদর্শন করেন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক উপসহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী আফরিন আক্তার। ওই দিন বিকেলে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের সঙ্গে বৈঠক শেষে আফরিন আক্তার সাংবাদিকদের বলেন, রোহিঙ্গা পরিস্থিতি দেখতে তিনি কক্সবাজারে এসেছেন। মিয়ানমারে অনুকূল পরিবেশ তৈরির পরই কেবল স্বেচ্ছায় প্রত্যাবাসন সম্ভব। জোর করে কিংবা বাধ্য করে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন চায় না যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্র নিরাপদ ও টেকসই প্রত্যাবাসনের পক্ষে কাজ করছে।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) কক্সবাজার জেলা কামটির সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুর রহমান বলেন, সাড়ে ১২ লাখ রোহিঙ্গার আশ্রয়শিবিরে প্রতিবছর ৩৩ হাজার করে রোহিঙ্গা শিশুর জন্ম হচ্ছে। গত ছয় বছরে জন্ম নিয়েছে প্রায় দুই লাখ শিশু। প্রত্যাবাসন দীর্ঘায়িত হওয়ায় আশ্রয়শিবিরের রোহিঙ্গা তরুণ-যুবকেরা মাদক চোরাচালান, সন্ত্রাসে জড়াচ্ছেন, যা দেশের জন্য অশনিসংকেত। নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ।