ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে আবেগসিক্ত অভিবাদন

0
112
ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে সম্মাননা ক্রেস্ট তুলে দিচ্ছেন অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। মঞ্চে ছিলেন টাইমস মিডিয়া লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ. কে. আজাদ, সমকাল সম্পাদক মোজাম্মেল হোসেন, চ্যানেল টোয়েন্টিফোরের প্রধান নির্বাহী তরুণ চক্রবর্তী। শনিবার তেজগাঁওয়ের টাইমস মিডিয়া ভবনে

গণহত্যার প্রতিবাদে পাকিস্তানের পাসপোর্ট ছিঁড়ে, বিলেতের সুখ-সুবিধা ফেলে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে দেশে ফেরেন। এফআরসিএস পড়া বাদ দিয়ে যুদ্ধাহতদের জন্য খোলেন ফিল্ড হাসপাতাল। যুদ্ধ শেষে দেশ গড়তে নিজেকেই দান করেন। হন দেশের যোদ্ধা, বন্ধু সবার। তিনি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। তাঁর দীর্ঘ লড়াই-সংগ্রামকে অভিবাদন জানিয়ে তাঁকে সম্মান জানিয়েছে সমকাল ও চ্যানেল টোয়েন্টিফোর।

গতকাল শনিবার রাজধানীর তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলে টাইমস মিডিয়া ভবনে আনুষ্ঠানিকভাবে গণস্বাস্থ্যের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে ‘সমকাল-চ্যানেল টোয়েন্টিফোর গুণীজন সম্মাননা-২০২৩’ দেওয়া হয়। অনুষ্ঠানটি শিক্ষাবিদ, রাজনীতিক, চিকিৎসক, বুদ্ধিজীবী ও ব্যবসায়ীদের মিলনমেলায় পরিণত হয়। তাঁরা জাফরুল্লাহ চৌধুরীর কীর্তি ও অবদানের কথা বলেন।

তাঁরা সবাই এক বাক্যে বললেন, দেশের যে কোনো সংকটে মানুষের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েন জাফরুল্লাহ চৌধুরী। বহু প্রতিষ্ঠান গড়েছেন মানুষের জন্য। গুরুতর অসুস্থ অবস্থায়, হাতে ক্যানোলা পরে, কিডনির ডায়ালাইসিস থামিয়ে মানুষের দাবি-দাওয়া নিয়ে ছুটে চলেছেন।

৮২ বছর বয়সী জাফরুল্লাহ চৌধুরী অশক্ত শরীরে সম্মাননা অনুষ্ঠানের মঞ্চে হুইলচেয়ারে বসে, তাঁর গুণমুগ্ধদের কথা শুনেছেন। কখনও মৃদু হেসেছেন। কখনও মাথা নেড়ে দ্বিমত করেছেন। অভ্যাগত সবাই বললেন, সাদামাটা জীবন কাটিয়েছেন ‘জাফর ভাই’। সম্মাননার জমকালো অনুষ্ঠানেও সাদামাটাই ছিলেন জাফরুল্লাহ চৌধুরী। আসেন লুঙ্গি পরে।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রিয়ভাজন ছিলেন ডা. জাফরুল্লাহ। তাঁকে ডাকতেন ‘ডাক্তর’ বলে। মুক্তিযুদ্ধ এবং তার পর দেশ গড়ার সংগ্রামে স্মৃতিকাতর হয়ে ডা. জাফরুল্লাহ বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশকে সুইজারল্যান্ড করতে চেয়েছিলেন। মুজিব ভাইয়ের এ স্বপ্ন এখনও পূরণ হয়নি। মুজিব ভাইয়ের স্বপ্ন পূরণ হলে এত মানুষ আত্মহত্যা করত না। কিশোররা খুনখারাবিতে জড়াত না। সবাই খেতে পারত। চাকরি না থাকলে ভাতা পেত।’

সমকাল ও চ্যানেল টোয়েন্টিফোরের উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান টাইমস মিডিয়া লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ. কে. আজাদের অনুপ্রেরণায় জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে সম্মাননা দেওয়া হয়েছে। সমকালের সম্পাদক মোজাম্মেল হোসেনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। জাফরুল্লাহ চৌধুরীর হাতে সম্মাননার চেক তুলে দেন চ্যানেল টোয়েন্টিফোরের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা তরুণ চক্রবর্তী।

রন্টি দাসের গাওয়া ‘জন্ম আমার ধন্য হলো মাগো’ গানে শুরু হয় সম্মাননা অনুষ্ঠান। জীবদ্দশায় গুণীর কদর হয় না বলে আক্ষেপ করে প্রিয় বন্ধু ‘মতিহার’কে (কাজী মোতাহার হোসেন) চিঠি লিখে আক্ষেপের কথা জানিয়েছিলেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম। শতবর্ষী এ চিঠির অংশ বিশেষ পড়ে শোনান এ. কে. আজাদ। তিনি বলেন, কেউ চলে যাওয়ার পর বিশাল স্মরণ অনুষ্ঠান করার চেয়ে তাঁকে জীবদ্দশায় প্রাপ্য সম্মান জানানো উচিত। গত মাসে ব্র্যাক-সমকাল সাহিত্য পদকের অনুষ্ঠানে অর্থনীতিবিদ ড. রেহমান সোবহানকে সম্মাননা জানানো হয়েছে। সেই অনুষ্ঠানে হুইলচেয়ারে এসেছিলেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। তিনি শতায়ু হোন। কর্মক্ষম থাকতেই তাঁকে সম্মান জানানো উচিত। প্রস্তাব করতেই সমকাল-চ্যানেল টোয়েন্টিফোর সম্মত হয়েছে।

ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে উত্তরীয় পরিয়ে সম্মান জানান এ. কে. আজাদ। সম্মাননা পদক তুলে দেন সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। তিনি বলেন, জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে সম্মান জানাতে পেরে সবাই সম্মানিত হয়েছি। ডা. জাফরুল্লাহ চাইলে এ দেশের শীর্ষ ধনী হতে পারতেন। তিনি প্রতিষ্ঠান তৈরি করেছেন। কিন্তু নিজে মালিক হননি। এসব প্রতিষ্ঠানের মালিকানা সামাজিক, ব্যক্তিগত নয়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা মানে সমাজ বদলের বিপ্লব। সেই বিপ্লবের সৈনিক ডা. জাফরুল্লাহ। সম্পদ থাকলে দাতা হওয়া যায়। কিন্তু সমাজ বদলে নিজেকেই দান করেছেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। যা আর কেউ পারে না।

সবাই রাজনীতি ও রাজনৈতিক দল সরাসরি করেন না। কিন্তু সাধারণ মানুষের হয়ে, এককভাবে কাজ করে জনকল্যাণের রাজনীতির পথ দেখান কিছু বিরলপ্রজ মানুষ। ডা. জাফরুল্লাহকে তেমনই এক ব্যক্তি মনে করেন সমকাল সম্পাদক। মোজাম্মেল হোসেন বলেছেন, এ কারণে তাঁর অন্যায় সমালোচনা উচিত নয়। দেশের জন্য, মানুষের জন্য তাঁর সারাজীবনের যে ত্যাগ, তা অতুলনীয়। সম্মাননার প্রকাশনা ও চিত্রকর্ম জাফরুল্লাহ চৌধুরীর হাতে তুলে দেন সমকাল সম্পাদক।

তরুণ চক্রবর্তী বলেছেন, ডা. জাফরুল্লাহকে সম্মান জানাতে পেরে সমকাল-চ্যানেল টোয়েন্টিফোর সম্মানিত হয়েছে। যাঁরা দেশের জন্য অনুকরণীয় ত্যাগ স্বীকার ও আত্মোৎসর্গ করেছেন, তাঁদের সম্মান জানাবে সমকাল-চ্যানেল টোয়েন্টিফোর।

এর পর মুক্ত আলোচনায় প্রিয় ‘জাফর ভাই’কে নিয়ে সংবিধানের অন্যতম প্রণেতা গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন বলেন, দেশের যে কোনো বিপদে ছুটে যান জাফরুল্লাহ চৌধুরী। তাঁর মতো একজনও নেই।

কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি বঙ্গবীর আবদুল কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম বলেন, জীবিত মানুষকে সম্মান দিতে পারি না। মৃত্যুর পর অনেক কথা হয়। আজ অবিশ্বাস্য ঘটনার সাক্ষী হলাম।

বাসদের উপদেষ্টা খালেকুজ্জামান বলেন, এসব স্বীকৃতির অনেক আগেই জাফরুল্লাহ চৌধুরী সবার ‘জাফর ভাই’ হয়ে গেছেন।

জেএসডির সভাপতি আ স ম আবদুর রব বলেন, আরেকজন জাফরুল্লাহ চৌধুরী পাওয়া যাবে না।

মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ করে মৈত্রী সম্মাননাপ্রাপ্ত জুলিয়ান ফ্রান্সিস বলেন, জাফরুল্লাহ আমাদের মতো মানুষদের তাগাদা দিয়ে নিয়েছিলেন বলেই ফিল্ড হাসপাতাল মুক্তিযোদ্ধাদের অন্যতম ভরসার কেন্দ্র হতে পেরেছিল।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ বলেন, জাফরুল্লাহ চৌধুরীর মতো সাহসী মানুষ বিরল। করোনা আক্রান্ত হলে, তাঁর রিপোর্ট দেখে ভয় পেয়েছিলাম। জাফর ভাই বললেন, ভয় পেয়ো না। বলো কী হয়েছে? তাঁকে প্লাজামা দেওয়া হয়। পরে সাধারণ মানুষের জন্য জাফর ভাই একটা প্লাজমা ব্যাংক করেন।

অর্থনীতিবিদ বিনায়ক সেনও বলেন, জাফরুল্লাহ চৌধুরীর মতো সাহসী মানুষ দেখিনি। তাঁকে নাগরিক সমাজের গৌরব বলে আখ্যা দেন সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।

ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স বাংলাদেশের সভাপতি মাহবুবুর রহমান বলেন, দেশ গড়তে জাফরুল্লাহ নিরন্তর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। কখনও থামেননি।

১৯৮২ সালে ওষুধ নীতিমালা হয় জাফরুল্লাহ চৌধীর হাত ধরে। ওষুধ ব্যবসায়ী হিসেবে এর বিরোধী ছিলেন জানিয়ে স্কয়ারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তপন চৌধুরী বলেন, অনেক সমালোচনা করেছিলাম ডা. জাফরুল্লাহর। কিন্তু তিনিই সঠিক ছিলেন। ওষুধের দাম কমে নীতিমালার কারণে।

অধ্যাপক আবদুল কাসেম ফজলুল হক বলেন, ভালো কাজের মাধ্যমে অমরত্ব লাভ করেছেন জাফরুল্লাহ চৌধুরী।

অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন বলেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মূর্ত প্রতীক ডা. জাফরুল্লাহ। তিনি মানুষের মুক্তির জন্য প্রতিদিন লড়াই করছেন।

সাবেক সচিব এনাম আহমদ চৌধুরী বলেন, জাতি কৃতজ্ঞ জাফরুল্লাহ চৌধুরীর কাছে।

সুজনের সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, নাগরিক আন্দোলনে বিপদে পড়াদের ভরসা জাফর ভাই।

মুক্ত আলোচনায় জাফরুল্লাহ চৌধুরীর কর্ম সম্পর্কে আরও বলেন, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমান, সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহ্‌দীন মালিক, সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান, অধ্যাপক আসিফ নজরুল, রামরুর চেয়ারপারসন অধ্যাপক ড. তাসনীম সিদ্দিক, নারী অধিকারকর্মী খুশী কবির, ফেমার প্রেসিডেন্ট মুনিরা খান, ডা. জাফরুল্লাহর ছোট বোন কবি আলেয়া চৌধুরী প্রমুখ।

অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না, বিএনপির প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী, সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, বাসদের সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশীদ ফিরোজ, মার্কসবাদী বাসদের শুভ্রাংশ চক্রবর্তী, গণঅধিকার পরিষদের সদস্য সচিব নুরুল হক নুর, গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক ডা. মিজানুর রহমান, জেএসডির সাধারণ সম্পাদক শহিদউদ্দিন স্বপন, গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টির সাধারণ সম্পাদক মোশরেফা মিশু ও বিএনপির সাবেক এমপি শাম্মী আখতার প্রমুখ।

বিশিষ্টজনের মধ্যে ছিলেন– রামরুর সমন্বয়ক অধ্যাপক ড. সি আর আবরার, নারী অধিকারকর্মী হামিদা হোসেন, ব্যারিস্টার সারা হোসেন, ডা. লেলিন চৌধুরী, লেখক আলতাফ পারভেজ, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর মোহাম্মদ এ. (রুমী) আলী, হা-মীম গ্রুপের সিনিয়র নির্বাহী পরিচালক জালাল আহমেদ প্রমুখ।

শিল্পপতি ও ব্যবসায়ী নেতাদের মধ্যে ছিলেন– বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম, ঢাকা চেম্বারের সভাপতি ব্যারিস্টার সামির সাত্তার, বাংলাদেশ চেম্বারের সভাপতি আনওয়ার-উল আলম চৌধুরী, বিটিএমএর সাবেক সভাপতি আবদুল হাই সরকার প্রমুখ ।

ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর একমাত্র ছেলে বারিশ চৌধুরী, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান ডা. আলতাফুন নেছা মায়া, ট্রাস্টি ডা. আবদুল কাসেম চৌধুরী ও সন্ধ্যা রায়, গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. আবুল হোসেন, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মনজুর কাদির আহমেদ, গণস্বাস্থ্য সমাজভিত্তিক মেডিকেল কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ডা. মুহিব উল্লাহ খন্দকার, গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক বদরুল হক ও গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রেস উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম মিন্টু উপস্থিত ছিলেন।

এ ছাড়া সমকালের প্রকাশক আবুল কালাম আজাদ, উপদেষ্টা সম্পাদক আবু সাঈদ খান ও আলমগীর হোসেন, চ্যানেল টোয়েন্টিফোরের নির্বাহী পরিচালক তালাত মাহমুদসহ দুই প্রতিষ্ঠানের সিনিয়র সাংবাদিক ও কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.