আমি খুব কম মানুষকে জানি, যারা প্রকৃতপক্ষে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার জন্য তাৎক্ষণিক বিদেশ থেকে চলে এসেছিলেন। তাদের মধ্যে খুব অল্প সংখ্যক যেমন ফজলে হাসান আবেদ ও মুহম্মদ ইউনূস স্বাধীনতার পরপরই বিদেশ থেকে বাংলাদেশে ফিরে আসেন। জাফরুল্লাহর মতো তারা দুঃখী মানুষের সেবায় আত্মনিয়োগ করেন।
মুক্তিযুদ্ধ তাদের মতো অল্প বয়সী পুরুষ ও নারীর জীবন পরিবর্তনে ব্যাপক প্রভাব ফেলে। প্রচলিত জীবন ছেড়ে শিক্ষা ও শ্রেণির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ পেশাগত অগ্রগতিতে তাদের অণুপ্রাণিত করে। ইউনূস ও আবেদ তাদের প্রজেক্টেড ক্যারিয়ারের পথ থেকে সরে গিয়ে বিশ্বখ্যাত প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন, যেগুলো শুধু বাংলাদেশে নয়, সারাবিশ্বে লাখ লাখ মানুষের জীবনকে উন্নত করতে কাজ করছে। তাদের অন্যান্য সামাজিক কর্মকাণ্ড দারিদ্র্যবিমোচন ও মানবউন্নয়নে বাংলাদেশের সাফল্যকে বিশ্বব্যাপী তুলে ধরতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
জাফরুল্লাহ সব সময় বাংলাদেশকে মনেপ্রাণে ধারণ করতেন। বিদেশের মাটিতে গিয়েও দেশের প্রতি তার টান ছিল সবসময়। প্রতিটি বাঙালি চিকিৎসকের স্বপ্ন থাকে এফআরসিএস সনদ নেওয়া। কিন্তু এই সনদের জন্য চূড়ান্ত পরীক্ষার মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে ডা. জাফরুল্লাহ পাকিস্তানি নাগরিকত্ব ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নেন এবং প্রকাশ্যে পাসপোর্ট ছিঁড়ে ফেলেন। সৈনিক হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের সিদ্ধান্ত নেন তিনি। আগাগোড়া বৈপ্লবিক চেতনায় উদ্ভাসিত হওয়ার কারণেই তার পক্ষে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব হয়েছে। যখন তিনি কলকাতায় যান তখন আর দেরি না করে সেখানে আশ্রয় নেওয়া স্বদেশিদের অনেকের সঙ্গে কাজে যোগ দেন। এরপর তাৎক্ষণিক ত্রিপুরা চলে যান এবং যুদ্ধক্ষেত্রে সৈনিকদের জন্য ফিল্ড হাসপাতাল স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেন। সম্ভবত, এফআরসিএস-এর জন্য অধ্যয়ন করা জ্ঞান একটি যুদ্ধক্ষেত্র হাসপাতাল কীভাবে স্থাপন করা যায় সে সম্পর্কে কাউকে অভিজ্ঞ করে না। তবে সীমিত সক্ষমতা ও অল্প প্রশিক্ষিত জনবল নিয়ে একজন যুবকের এই ধরনের সাহস, ঝুঁকি গ্রহণের ক্ষমতা ও বিপ্লবী চেতনা এমন কিছু করে দেখিয়েছিল যা আগে কেউ কখনও ভাবেনি।
জাফরুল্লাহ চৌধুরীর সাভারে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র স্থাপনের পদক্ষেপও একটি বিপ্লবী ধারণার ওপর ভিত্তি করে। আমার ধারণা, জাফরুল্লাহ মাও সেতুং-এর নেতৃত্বে চীনা-বিপ্লব ধারণার দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন, যার মাধ্যমে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের শুরুর বছরগুলোতে সীমিত সম্পদ ও যথাযথ প্রযুক্তি ব্যবহার করে মৌলিক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সবার জন্য চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে চেয়েছিলেন।
জাফরুল্লাহর আরও বিপ্লবী কাজ ছিল সাভার এলাকার কর্মজীবীদের স্বাস্থ্য সমস্যার সমাধান করতে রোগ প্রতিরোধমূলক ক্ষেত্রগুলোতে স্বল্প ব্যয়ের পদ্ধতিতে বিনিয়োগ। এর বিপ্লবী দিকটি ছিল এমন, গ্রামের তরুণীদের বদ্ধ ঘর থেকে বের হওয়ার সুযোগ তৈরি করা হয়েছিল, তাদেরকে চিকিৎসাকর্মী হিসেবে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। পরে আস্তে আস্তে তাদের (তরুণীদের) বহুবিধ পেশায় অংশগ্রহণ করার ব্যবস্থা হয়। সাইকেল চালানো, গাড়িচালক হিসেবে, মেশিনারিতে কাজ করা এবং নিরাপত্তাকর্মী হিসেবে কাজেও যোগ দেওয়া শুরু করে গ্রামের তরুণীরা। এখনকার দিনে নারীদের এসব কাজে অংশগ্রহণ বেশ সচরাচর। কিন্তু ১৯৭০ এর দশকে এগুলোই ছিল সামাজিকভাবে বিপ্লবী কাজ। পরে তো ক্ষুদ্রঋণের মাধ্যমে নারীদের আয়ের পথ বের হলো। সত্তরের দশকের শেষ দিকে সাভারে সর্বত্র গণস্বাস্থ্যের নারীদের দেখা মিলত। অথচ একসময় নারীদের এমন চিত্র দুর্লভই ছিল।
এইরকম ‘খালি পায়ে’র একদল স্বাস্থ্যযোদ্ধা তৈরির জন্য চিকিৎসা শিক্ষার বিপ্লবী কায়দা নিতে হয়েছিল। জাফরুল্লাহ মনে করতেন এবং আমারও মনে আছে, আমাকে ব্যক্তিগতভাবে কিংবা যেখানে যে প্ল্যাটফর্মে সুযোগ পেতেন তিনি এর ব্যাখ্যা দিয়ে বলতেন, চিকিৎসাবিদ্যার শিক্ষার্থীদের জন্য তৈরি করা এমবিবিএস ডিগ্রির কোর্সসমূহ অনুপযুক্ত এবং যেখানে দেশের সিংহভাগ মানুষ প্রত্যন্ত অঞ্চলে থাকে তাদের জন্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে এটি কস্ট-ইফেকটিভও নয়।
তার কথা হচ্ছে, জটিল রোগ ও অসুস্থতার চিকিৎসার জন্য দীর্ঘমেয়াদি প্রশিক্ষণ অবশ্যই জরুরি। তবে জ্বর, হালকা মাত্রার সংক্রমণ, ডায়রিয়াজনিত রোগবালাই, সামান্য জখম ও রোগপ্রতিরোধ কার্যক্রমের জন্য স্বল্পমেয়াদি, খুব সহজে কাজে লাগে এমন প্রশিক্ষণ সাশ্রয়ী হতে পারে। এগুলো অল্প সময়ের ব্যবধানে আয়োজন করা যায় এবং এতে সমাজে বিপুল সংখ্যক চিকিৎসক/সেবাপ্রদানকারী/নার্স তৈরি করা যেত। লোকজনের কাজেও লাগত অনেক বেশি। এইসব প্রশিক্ষণ নেওয়া ব্যক্তিরা প্রত্যন্ত অঞ্চলে গিয়ে থাকতেও চাইতেন। অন্যদিকে পাঁচ বছরের এমবিবিএস পাস করা চিকিৎসকেরা প্রত্যন্ত অঞ্চলের যেখানে চিকিৎসাসেবাটা অনেক বেশি জরুরি, সেখানে থাকতে চান না। দেখা যায়, গ্র্যাজুয়েটরা প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে নগরাঞ্চলে বদলির জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়সহ দপ্তরগুলোতে তদবিরে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। চিকিৎসা শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে এমনটিই ছিল জাফরুল্লাহর চিন্তাধারা। এর কারণে এমবিবিএস ডিগ্রিধারী বহু চিকিৎসকের এবং বিএমএ’র বিরাগভাজনও হয়েছেন। কিন্তু তিনি তার কথা বলে গেছেন এবং একপর্যায়ে ঠিকই নিজের চিন্তাকে বাস্তবে রূপ দিতে গণ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাও করেছেন।
ওষুধশিল্প নিয়ে জাফরুল্লাহর চিন্তাও তার সময়ে সবচেয়ে অগ্রগামী ছিল। আমার মনে আছে, আশির দশকের শুরুর দিকে হবে, জাফরুল্লাহ আমাকে বোঝাচ্ছিলেন যে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো বেশি দামে ব্র্যান্ড নামে ওষুধ বিপণন করে ব্যবসাটা একচেটিয়া করে নিয়েছে। অথচ আরও কম দামে এগুলোর জেনেরিক স্থানীয়ভাবে কম পয়সায় উৎপাদন করা যেত। তিনি যখন জেনারেল এরশাদকে ব্র্যান্ড নামের ওষুধ নিষিদ্ধের বিষয় বোঝাতে সক্ষম হলেন, সেসময় বাংলাদেশের ওষুধ খাতের অনেকেই বিশেষ করে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো এর সমালোচনা ও বিরোধিতা করেছিলেন। তবে ভাল ব্যাপার হচ্ছে, তৎকালীন সরকার এ অবস্থানে অনড় ছিল। বিপুল সংখ্যক ব্র্যান্ড নামের ওষুধ নিষিদ্ধ হয়। এই নিষিদ্ধের ফলে একপর্যায়ে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর বেশিরভাগ বাংলাদেশ থেকে বিদায় নেয়। একে একে ফাইজার, আইসিআই ও গ্ল্যাক্সো’র মতো বড় বড় কোম্পানি বাংলাদেশ ছেড়ে যায়।
তবে ভাল ব্যাপার ছিল জাফরুল্লাহ এরশাদের সঙ্গে ওষুধনীতি সংশোধন নিয়ে দেনদরবার করার ফলে স্কয়ার বেক্সিমকো’র মতো কোম্পানিসহ দেশের স্থানীয় ওষুধ শিল্পটা বেশ উন্নতি করার সুযোগ পায়। জাফরুল্লাহ অবশ্য এমন সম্ভাবনার কথা আগেই বলেছিলেন। স্থানীয় কোম্পানিগুলোকে জায়গা ছেড়ে দিয়ে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো যখন চলে গেল, স্কয়ার বেক্সিমকো’র মতো ব্যবসাগুলোর পোয়াবারো হয়। বহুজাতিক কোম্পানিগুলো যাওয়ার সময় তাদের উৎপাদন ব্যবস্থা, সুনাম-খ্যাতি এবং সবচেয়ে বড় বিষয় প্রযুক্তিগত ও ব্যবস্থানাগত দক্ষতা স্থানীয় কোম্পানিগুলোর কাছে বেঁচে দিয়ে যায়। পরে যেমন রেনাটা, এসকেএফ ও এসিআই হিসেবে নামে ব্যবসা শুরু করে। বর্তমানে দেশের চাহিদার ৯০ শতাংশ ওষুধ আমরা উৎপাদন করছি এবং রপ্তানি আয়েরও বিপুল সম্ভাবনা এটি।
ওষুধনীতি এবং এর যে ফলাফল, এটি অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদের দারুণ একটি উদাহরণ। দূরদর্শিতা ও সাহসে ভর করা জাফরুল্লাহর এই বিপ্লবী সচেতন চিন্তা সেসময় বাংলাদেশে বড় সংখ্যার বিদেশি বিনিয়োগ টানতে সক্ষম হয়। এমন এক সরকারকে তিনি বুঝিয়ে ফেলেন, জাতীয়তাবাদের প্রতি যার কোন শক্তপোক্ত প্রতিশ্রুতি ছিল না, বরং পশ্চিমা দেশগুলোর দিক থেকে বেশ চাপেই ছিল। আর বহুজাতিক কোম্পানিগুলো তো ওইসব পশ্চিমা দেশেরই।
দিন শেষে, জাফরুল্লাহর বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের প্রভাব সীমিত পরিসরেই রয়ে গেছে। সাভারের বাইরে এর সামাজিক ব্যাপ্তি তেমন একটা ছড়ায়নি। জাতীয় পর্যায়ে শুধু ওষুধনীতিতেই সীমাবদ্ধ রয়ে গেছে। চিকিৎসা শিক্ষাব্যবস্থা সংস্কার নিয়ে তার যে চিন্তা, বিএমএ এটির বিরুদ্ধে থাকায় তা বেশি দূর এগোয়নি। বাংলাদেশি বিজ্ঞানীদের নিয়ে স্বল্প খরচের কোভিড সংক্রমণ পরীক্ষার কিট উৎপাদনে জাফরুল্লাহর নেওয়া উদ্যোগ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ফিরিয়ে দেয়, অথচ বিদেশে এই কিট অহরহ উৎপাদন হচ্ছে এবং সেগুলোই আবার আমদানি করে আনার পর বাংলাদেশে ব্যবহার হচ্ছে।
শেষ বয়সে এসে, যখন শরীরেও তেমন কুলায় না, বহুবিধ কাজে যুক্ত করেছেন নিজেকে। জনগণের মুক্তির সংগ্রাম হুমকির মুখে পড়ে এমন কিছু মনে হলে তিনি সেখানে দাঁড়িয়েছেন। রাজনৈতিক পরিসরে জনগণকে ভিত্তি ধরে নিয়ে আগানোর দিন বলতে গেলে নেই হয়ে যাচ্ছে, এ অবস্থায় জাফরুল্লাহর অবস্থান কিছুটা কথামালার মতো মনে হলেও তার অদম্য স্পৃহা ও সাহসের দূরদর্শিতা অসামান্য।
অনেকে বিপ্লবের কথা বলেন বা তর্ক করেন। বাস্তবে অল্প সংখ্যক রাজনৈতিক দলের সদস্যই সামাজিক বিপ্লবকে তাদের মতাদর্শের অংশ বলে মনে করেন। এই শ্রেণির সবার জন্য বিপ্লব অনেকটা আকাঙ্খা হিসেবেই রয়ে গেছে, কারণ বাস্তবে একটি সামাজিক বিপ্লব কী, তা দেখানোর খুব কম অথবা কোনো সুযোগই তাদের ছিল না। ডা. জাফরুল্লাহ সব সময় নিজেকে একজন সমাজতান্ত্রিক বলে মনে করতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, সমাজে যে পরিবর্তন হচ্ছে তা যথেষ্ট নয় এবং ভেতর থেকে সামাজিক শৃঙ্খলা পরিবর্তন হওয়া দরকার। তিনি নিজে এটি করতে পারেননি, কারণ এই ধরনের পদক্ষেপের জন্য রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা ও বস্তুনিষ্ঠ পরিস্থিতি তৈরির দরকার ছিল। এর পরিবর্তে তিনি গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে তার বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে সাধারণ মানুষের প্রয়োজনের সঙ্গে প্রাসঙ্গিক একটি ‘সমাজতান্ত্রিক’ স্বাস্থ্যব্যবস্থা কেমন হতে পারে তা তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। সামাজিক ও জেন্ডার বিপ্লবের মাধ্যমে বঞ্চিতদের ক্ষমতায়নে কী দরকার হতে পারে তা তিনি বাস্তব জীবনে অন্বেষণ করেছেন। সাভারের মাটিতে নিজের ধারণা প্রদর্শনে যথেষ্ট সফল তিনি, যা মাঝে মাঝে স্থানীয় অভিজাত ও মৌলবাদী শক্তির মধ্যে ক্রোধ সঞ্চার করেছিল।
ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী সাধারণ জীবনযাপন করতেন। কোনো সম্পত্তির মালিক তিনি ছিলেন না। সবাই তার কাছে যেতে পারতেন, বিশেষ করে বঞ্চিতরা, যাদের কাছে তিনি নেতা নন, ছিলেন ভাই।
জাফরুল্লাহর জীবন তাদের অনুপ্রাণিত করুক, বিশেষ করে তরুণদের, যারা সামাজিক বিপ্লবে বিশ্বাস করেন; কিন্তু সামনের কঠিন বাধায় নিরুৎসাহিত হন, জাফরুল্লাহর জীবনের আলোয় তারা পথ চলুক।
নিবন্ধটি দ্য ডেইলি স্টারে প্রকাশিত এবং ইংরেজি থেকে অনুবাদ (সংক্ষিপ্ত