কক্সবাজারের বাঁকখালী নদীর মোহনা নাজিরারটেক পয়েন্টে ট্রলারে ১০ জনের লাশ উদ্ধারের ঘটনার রহস্য ভেদ করেছে পুলিশ। গভীর তদন্ত ও আসামিদের জবানবন্দিতে উঠে এসেছে চাঞ্চল্যকর এ হত্যাকাণ্ডের আদ্যোপান্ত। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তার হয়েছে আটজন। এরই মধ্যে মামলার তদন্তকাজ গুছিয়ে এনেছে পুলিশ। অল্প সময়ের মধ্যে অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা বলছেন, সমুদ্রের নীল জলরাশিতে ঘটা এ হত্যাকাণ্ডে একদিকে লুকিয়ে আছে ডাকাত দলের নিষ্ঠুরতা, অন্যদিকে ছিল সাধারণ জেলেদের আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার মতো অপরাধ। পরিকল্পিতভাবে মাছ ধরার ট্রলারে ডাকাতি করতে গভীর সমুদ্রে যায় একটি গ্রুপ। সমুদ্রে ডাকাত দলের নেতৃত্বে ছিলেন শামসু। আর ডাঙা থেকে তাঁকে সব ধরনের পরামর্শ দেন সুমন নামের একজন। ঘটনার দিন একটি ট্রলার ডাকাতির পর আরেকটিতে করতে গিয়ে জেলেদের বাধার মুখে পড়ে দস্যু দল। এ সময় চার-পাঁচটি ট্রলারের মাঝি-মাল্লারা ডাকাতদের ট্রলার ঘেরাও করে। এরপর দফায় দফায় জেলেদের লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে ডাকাতরা। এক পর্যায়ে গুলি শেষ হয়ে গেলে জেলেরা একজোট হয়ে ডাকাতদের গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করে। তদন্তসংশ্লিষ্ট একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
মামলার তদন্ত তদারক কর্মকর্তা কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মাহফুজুল ইসলাম বলেন, তথ্যপ্রযুক্তিগত তদন্ত, আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদ ও আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে অনেক তথ্য আমরা পেয়েছি। পুরো গ্রুপকে শনাক্ত করেছি। তদন্তও শেষ পর্যায়ে। অচিরেই চার্জশিট দেওয়া হবে। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা কক্সবাজার সদর থানার পরিদর্শক দুর্জয় বিশ্বাস বলেন, এই হত্যা মামলায় ছয়জন আদালতে ১৬৪ ধারায় জবাবন্দি দিয়েছে। তাদের কাছ থেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে।
তদন্ত সূত্র জানায়, যে আটজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে তাঁরা হলেন– কামাল হোসেন ওরফে বাইট্টা কামাল, করিম শিকদার, গিয়াস উদ্দিন, ফজল মাঝি, আবু তৈয়ব, দেলোয়ার হোসেন, খায়ের হোসেন ও ইমাম হোসেন। ডাঙায় থেকে সুমন নামের এক ব্যক্তি ডাকাতির ঘটনা নিয়ন্ত্রণ করেন। ডাকাত দলের সঙ্গে লোক ভাড়া করে গভীর সমুদ্রে পাঠানো ও বিপদে পড়লে তাদের পরিবারকে সহযোগিতা করেন এই সুমন। তবে তিনি কখনও ডাকাতি করতে সমুদ্রে যান না। সমুদ্রে ডাকাত দলের সবকিছু দেখভাল করেন শামসু। গণপিটুনিতে তিনিও নিহত হয়েছেন। ঈদের আগে টাকার লোভ দেখিয়ে ডাকাতদের ট্রলারে পাঁচ কিশোরকে ‘ভাড়াটে ডাকাত’ হিসেবে নেওয়া হয়েছিল। এতেও মূল ভূমিকায় ছিলেন শামসু ও সুমন।
কী ঘটেছিল সেদিন ঘটনা গেল ৯ এপ্রিলের। ঘটনাস্থল কক্সবাজারের মহেশখালী-কুতুবদিয়া চ্যানেল। উত্তাল সমুদ্রে আনোয়ার হোসেন মাঝি জাল ফেলেন বাবুল মাঝির ট্রলারের কাছে। ভোর ৪টার দিকে দুর্ধর্ষ দস্যু শাহজাহানের নেতৃত্বে ডাকাত দলের একটি ট্রলার আনোয়ারের ট্রলারের পাশে অবস্থান নেয়। ঘুটঘুটে অন্ধকারে আনোয়ারের ট্রলারের লোকজন পাশে থাকা নৌযানটি অন্য কোনো মাঝির বলে মনে করেন। আনোয়ারের ট্রলারে ছিলেন ২০-২২ মাঝি-মাল্লা। তখন ছিল রমজান মাস। আনোয়ারের ট্রলারের অধিকাংশ লোক সেহরি খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েন। এ সুযোগে ডাকাত দলের ১০-১২ সদস্য আনোয়ারের ট্রলারে হামলে পড়ে। জিম্মি করা হয় সব মাঝি-মাল্লাকে। অস্ত্র ও মারধরের ভয় দেখিয়ে ডাকাত সদস্যরা মাঝি জয়নাল ও কায়সার বাদে সবাইকে গভীর সমুদ্রে ফেলে দেয়। এক পর্যায়ে ডাকাতরা আনোয়ারের ট্রলারের নিয়ন্ত্রণে নেয়। পরে ডাকাতদের ছোট নৌকাটি ওই ট্রলারের পেছনে বেঁধে ফেলে। কিছুক্ষণের মধ্যে মাঝি জয়নাল ও কায়সারকেও সমুদ্রে ফেলা হয়।
ডাকাতরা তাদের পরবর্তী শিকার ধরতে সমুদ্রপথে এগোতে থাকলে পাশে চলমান আফসার ও বাবুল মাঝির ট্রলারের লোকজন আনোয়ারের ট্রলার দেখেই চিনতে পারে। ওই সময় আনোয়ারের ট্রলার কোন দিকে যাচ্ছে, তা বারবার জানতে চান আফসার ও বাবুল মাঝি। তবে আনোয়ারের ট্রলার থেকে কোনো সাড়া মিলছিল না। ওই ট্রলারের পেছনে ছোট্ট আরেকটি নৌযান বাঁধা দেখে সন্দেহ হয় অন্য মাঝিদের। এরপরই আফসার ও বাবুল মাঝি চিৎকার করলে ডাকাত সদস্যরা তাদের এগোতে নিষেধ করে। তবু আফসার-বাবুল ওই ট্রলারের কাছাকাছি যাওয়ার চেষ্টা করেন। তখন ডাকাত সদস্যরা গুলি ছোড়ে। এতে আক্কাস নামের একজনের সৎভাই ও আক্কাসের ভাগিনা আলতাফ আহত হন। এরপর আফসার ও বাবুল মাঝির ট্রলারের সদস্যরা আশপাশের অন্য নৌযানের সহায়তা পেতে ‘বিপদ সংকেত’ বোঝাতে পতাকা তুলে দেন। এ ছাড়া ট্রলারের ইঞ্জিনের গতি বাড়িয়ে কালো ধোঁয়া ছেড়ে অন্য মাঝিদের সতর্ক করে সহযোগিতা চান। এমন সতর্ক সংকেত পেয়ে আমান মাঝিসহ আরও চার-পাঁচটি ট্রলার ডাকাতদের নৌযান ধাওয়া করতে থাকে। থেমে থেমে ডাকাতরা তাদের গুলি করে। এক পর্যায়ে গুলি শেষ হলে ডাকাতদের ট্রলার ঘিরে ফেলে মাঝিরা। এরপর ডাকাতরা লাফিয়ে পড়ে সমুদ্রে। তখন ডাকাত সদস্যদের সমুদ্র থেকে জোর করে নিজেদের ট্রলারে তোলেন মাঝি-মাল্লারা। এক পর্যায়ে ট্রলারের ওপর বাঁশ, বরফের মুগুর, চুলা জ্বালানোর লাঠি দিয়ে বাবুল, আফসার ও আমানের ট্রলারের কর্মীরা ডাকাতদের পিটিয়ে হত্যা করে। মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার পর লাশ মাছ রাখার কুঠুরিতে ঢুকিয়ে মুখ বন্ধ করে দেওয়া হয়। এরপর ১০ লাশসহ ডাকাতদের ট্রলারটি ডুবিয়ে দেন মাঝি-মাল্লারা। এর মধ্যে আনোয়ারের ট্রলারের সব সদস্যকে সমুদ্র থেকে উদ্ধারও করা হয়।
পরে গত ২৩ এপ্রিল কক্সবাজারের নাজিরারটেক পয়েন্ট থেকে ভাসমান ট্রলারের ভেতর থেকে উদ্ধার হয় ১০ জনের লাশ। ট্রলারের মালিক শামসুল আলমের স্ত্রী রোকেয়া আক্তার বাদী হয়ে চারজনের নাম উল্লেখ করে অচেনা আরও ৫০-৬০ জনের নামে মামলা করেন। ডিএনএ প্রতিবেদন পাওয়ার পর সর্বশেষ রোববার চারজনের লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। লাশ উদ্ধারের পরপরই ছয়জনের মরদেহ তাদের পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছিল।