সরকারি মালিকানাধীন তেল পরিশোধন কোম্পানি ইস্টার্ন রিফাইনারির পরিশোধন ক্ষমতা দ্বিগুণের বেশি বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ জন্য ইস্টার্ন রিফাইনারির দ্বিতীয় ইউনিট স্থাপনের প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। যার জন্য সম্ভাব্য খরচ ধরা হয়েছে ৪২ হাজার কোটি টাকা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে ইস্টার্ন রিফাইনারির তেল পরিশোধন ক্ষমতা বেড়ে বার্ষিক ৪৫ লাখ টনে উন্নীত হবে। বর্তমানে ইস্টার্ন রিফাইনারির বছরে ১৫ লাখ টন তেল পরিশোধনের ক্ষমতা রয়েছে। দ্বিতীয় ইউনিট স্থাপন হলে তেল পরিশোধনে ডলার সাশ্রয় হবে।
দেশের একমাত্র সরকারি জ্বালানি তেল পরিশোধনাগার ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেড (ইআরএল) প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৬৮ সালে। চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় অবস্থিত এই তেল পরিশোধন কোম্পানিটি। বছরে এটির পরিশোধন ক্ষমতা ১৫ লাখ টন। প্রতিবছর দেশে তেলের চাহিদা বাড়লেও ইস্টার্ন রিফাইনারির পরিশোধন ক্ষমতা বাড়েনি। এ কারণে প্রতিষ্ঠার প্রায় ৫৭ বছর পর এসে ইআরএলের দ্বিতীয় তেল পরিশোধন ইউনিট তৈরি করতে চায় বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। ইআরএল বিপিসির একটি সহযোগী প্রতিষ্ঠান। চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় ইআরএলের নিজস্ব জায়গাতেই নতুন এই ইউনিট করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, বিপিসির মাধ্যমে আনা অপরিশোধিত জ্বালানি তেল পরিশোধন করে ইআরএল। পরে পরিশোধিত ১৪ রকমের জ্বালানি তেল ইআরএল থেকে নিয়ে সরকারি পরিচালনাধীন তেল কোম্পানি পদ্মা অয়েল, মেঘনা পেট্রোলিয়াম, যমুনা অয়েল ও স্ট্যান্ডার্ড এশিয়াটিক অয়েলের মাধ্যমে দেশজুড়ে ভোক্তাদের কাছে সরবরাহ করা হয়।
বিপিসি সূত্র জানা যায়, ইআরএলের দ্বিতীয় ইউনিট তৈরির প্রকল্পের সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৪২ হাজার কোটি টাকা। ইতিমধ্যে উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব বা ডিপিপি তৈরি করেছে বিপিসি। সম্প্রতি এই প্রকল্প প্রস্তাব পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। তবে এখনো ডিপিপি সরকারি অনুমোদন পায়নি। দ্বিতীয় এই ইউনিটটি নির্মাণ করা হলে ইআরএলের পরিশোধন ক্ষমতা আরও ৩০ লাখ টন বাড়বে। সব মিলিয়ে তখন প্রতিষ্ঠানটি বছরে ৪৫ লাখ টন তেল পরিশোধন করতে পারবে।
এ বিষয়ে বিপিসির চেয়ারম্যান আমিন উল আহসান সম্প্রতি বলেন, ‘সরকার এই প্রকল্প বাস্তবায়নে কাজ করছে। প্রকল্পের ব্যয় বিপিসি ও সরকারের পক্ষ থেকে মেটানোর প্রাথমিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ডিপিপি অনুমোদন পাওয়া গেলে দ্রুত সময়ের মধ্যে আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করা হবে। প্রকল্পের নির্মাণকাজ দ্রুত শুরু করার পরিকল্পনা রয়েছে আমাদের।’
বিপিসি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, জ্বালানি তেল পরিশোধন ক্ষমতা বাড়াতে ‘ইনস্টলেশন অব ইআরএল-২’ নামের প্রকল্পটি নেওয়া হয় ২০১২ সালে। এরপর উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) অন্তত ১১ বার সংশোধন করা হয়েছে। তারপরও প্রকল্পটি আলোর মুখ দেখেনি। গত বছরের আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের উচ্চপর্যায়ের নির্দেশে এ প্রকল্পে যুক্ত হয়েছিল বিতর্কিত ব্যবসায়ী গোষ্ঠী ‘এস আলম গ্রুপ’। তবে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর এস আলম গ্রুপকে এ প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত না করার সিদ্ধান্ত নেয়।
বিপিসি সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে বছরে ৬৫ থেকে ৬৭ লাখ টন জ্বালানি তেল বিক্রি করে বিপিসি। তবে তেলের চাহিদা বছর বছর বাড়ছে। বিপিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৯৭৬ সালে দেশে জ্বালানি তেলের চাহিদা ছিল মাত্র ১১ লাখ টন (১ বছরে), যা ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বিপিসি ৬৭ লাখ টন তেল সরবরাহ করেছে। আর সদ্য শেষ হওয়া ২০২৪-২৫ অর্থবছরেও ৬৮ লাখ টনের কাছাকাছি তেল সরবরাহ করা হয়েছে। ২০২৬-২৭ অর্থবছরে জ্বালানি তেলের চাহিদা ৮০ লাখ টন ছাড়াতে পারে বলে বিপিসি সূত্রে জানা যায়। এ কারণে দ্বিতীয় ইউনিটের গুরুত্ব বাড়ছে।
বিপিসির এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আমদানি করা জ্বালানি তেলের মাধ্যমে বিপুল চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে দেশের অর্থনীতির ওপর চাপ তৈরি হচ্ছে। এভাবে বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় করা যাবে না। জ্বালানি নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়বে। ইআরএল দ্বিতীয় ইউনিট চালু করা গেলে বছরে ২০ থেকে ২৪ কোটি ডলার সাশ্রয় করা সম্ভব হবে। দেশে তেল শোধনের মাধ্যমে এ টাকা সাশ্রয় হবে।
বিপিসির তথ্য অনুযায়ী, দেশে জ্বালানি তেলের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হয় ডিজেল। এর পরিমাণ বছরে গড়ে ৪৬ লাখ টন। অপরিশোধিত তেল এনে দেশে পরিশোধনের মাধ্যমে ডিজেল উৎপাদন করা হলে ১ ব্যারেলে (১৫৮ দশমিক ৯৯ লিটার) সাশ্রয় করা যায় ১০ থেকে ১১ ডলার। তার মানে ডলারের বর্তমান আনুষ্ঠানিক বিনিময় হার (১২২ টাকা) ধরে হিসাব করলে প্রতি লিটার ডিজেলে সাশ্রয় হয় ৮ টাকা ৪৪ পয়সা।
ইআরএলের দ্বিতীয় ইউনিট স্থাপন প্রকল্পের খরচ ধরা হয়েছে এখন ৪২ হাজার কোটি টাকা। যদিও শুরুতে ব্যয় ধরা হয়েছিল সাড়ে ১৩ হাজার কোটি টাকা। শুরু থেকেই প্রকল্পটি বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতা দেখা যায়। বিদেশি অর্থায়নের চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি। এরপর সরকারের অর্থায়নের অপেক্ষায় থেকে কেটে যায় কয়েক বছর।
জানতে চাইলে ইআরএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. শরীফ হাসনাত বলেন, দ্বিতীয় ইউনিট চালু করা গেলে দেশে জ্বালানি খাতে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যাবে। পরিশোধন সক্ষমতার সঙ্গে মজুত ক্ষমতাও বেড়ে যাবে। এতে উচ্চ মূল্যে জ্বালানি তেল আমদানি না করে পরিস্থিতি বুঝে অপেক্ষা করার সুযোগ পাবে বিপিসি। এ ছাড়া দ্বিতীয় ইউনিটে করা বিনিয়োগ উঠে আসবে ১০ বছরের মধ্যে।
সুজয় চৌধুরী
চট্টগ্রাম