কারাবন্দীর তথ্য প্রতারকের হাতে, মালিকের অগোচরে মুঠোফোন নম্বরে লাখ লাখ টাকা লেনদেন

0
108
প্রতারক চক্রের সদস্যদের কাছ থেকে উদ্ধার করা মুঠোফোন, মুঠোফোনের সিমসহ অন্যান্য সরঞ্জাম

‘আমি জেলার সাহেব বলিতেছি, তোমার আব্বা বরিশাল কারাগারে আছেন। সরকারিভাবে কিছু লোক ছাড়ছে। এর মধ্যে তোমার বাবা পড়ছে। কয়েদি নম্বর ৭১। তুমি ৪০ হাজার টাকা পাঠাও আমি তোমার বাবার জামিনের ব্যবস্থা করে দেব,’ এই ফোন পেয়ে উচ্ছ্বসিত মো. মোজাম্মেল স্ত্রীর গয়না বিক্রি ও ধার করে ওই টাকা দেন। তবে মুঠোফোনে আর্থিক সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানের (এমএসএফ) দুটি নম্বরে টাকা পাঠানোর পরপরই তিনি বুঝতে পারেন, প্রতারণার শিকার হয়েছেন।

মোজাম্মেল মুঠোফোনে লেনদেনের যে নম্বরগুলোতে টাকা পাঠিয়েছিলেন, তার একটি ওই প্রতারক চক্রের সদস্যদের ছিল না। সেটি রাজশাহীর গোদাগাড়ির একটি প্রত্যন্ত গ্রামের এক বৃদ্ধ নারীর নামে নিবন্ধিত। এই ঘটনা তদন্তসংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, এক মালয়েশিয়াপ্রবাসীর ইমো অ্যাকাউন্ট নিয়ন্ত্রণে নিয়ে প্রতারণার আরও একটি ঘটনায় টাকা নিতে ওই নম্বর ব্যবহার করা হয়েছিল। এমএসএফ কোম্পানির কর্মীদের সঙ্গে যোগসাজশে নম্বরটি সংগ্রহ করেছিল প্রতারক চক্রের সদস্যরা।

দীর্ঘদিন ধরে জেলে থাকা বাবার জামিন হবে শুনে ‘জেলার’ পরিচয় দেওয়া ব্যক্তির পাঠানো মুঠোফোনে এমএসএফের দুটি নম্বরে ২০ হাজার করে ৪০ হাজার টাকা পাঠান তিনি। দুটি নম্বরে বাড়তি ৮০০ টাকা পাঠান খরচ হিসেবে। মোজাম্মেল টাকা পাঠানোর পর নিশ্চিত হওয়ার জন্য ওই ব্যক্তির মুঠোফোনে কল দিয়ে বন্ধ পান। তখন তিনি বুঝতে পারেন প্রতারণার শিকার হয়েছেন।

কারাগারে থাকা বন্দীর তথ্য নিয়ে প্রতারণা এবং ইমো অ্যাকাউন্ট হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে প্রতারণার দুটি মামলার তদন্ত করছিল মিরপুর থানা–পুলিশ। এর মধ্যে ইমো হ্যাকিংয়ের মামলাটি হয় গত বছরের আগস্ট মাসে। আর কারাবন্দী বাবার জামিনের তথ্য নিয়ে ছেলের কাছ থেকে টাকা নেওয়ার ঘটনায় গত মে মাসে মামলা হয়। এই দুটি মামলা তদন্তে গত রোববার চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে প্রতারক চক্রের সাত সদস্যকে গ্রেপ্তার করে মিরপুর থানা–পুলিশ।

গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা হলেন সাব্বির করিম আহাম্মেদ (৩৭), জোবায়ের আলম (৩৬), মোক্তার হোসেন (২৫), অন্তু দে (২২), রবিউল ইসলাম (২৫), ফজলুল করিম নাহিদ (৩৪) ও মো. অনিক (২৫)। তাঁদের কাছ থেকে বিভিন্ন কোম্পানির দুই শতাধিক মুঠোফোন সিম উদ্ধার করা হয়েছে বলে পুলিশ জানিয়েছে।

এ বিষয়ে পুলিশের মিরপুর বিভাগের সহকারী কমিশনার হাসান মুহাম্মদ মুহতারিম বলেন, মুঠোফোনে লেনদেনের দুটি প্রতিষ্ঠানের কয়েকজন এজেন্ট মিথ্যা তথ্য দিয়ে মানুষের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে ভুয়া অ্যাকাউন্ট খুলছেন। এসব অ্যাকাউন্ট পরে বেশি টাকায় বিক্রি করছেন প্রতারক চক্রের কাছে। তারা এসব নম্বর ব্যবহার করছেন প্রতারণার টাকা লেনদেনের কাজে।

জেলার সাহেব পরিচয়ে আমার ফোন দিয়ে আমার বাবার নাম, কোন মামলায় জেলে রয়েছেন সেগুলো বিস্তারিত জানান। জামিন করিয়ে দেবে বলে দুটি মুঠোফোন নম্বর পাঠিয়ে আমার কাছে ৪০ হাজার টাকা চান। আমি বিশ্বাস করে ওই নম্বরে টাকা পাঠাই। মো. মোজাম্মেল

কারাবন্দীর নানা তথ্য

মোজাম্মেলের বাবা ফোরকান পেদা একটি হত্যা মামলায় ১২ বছর ধরে কারাগারে আছেন। দীর্ঘদিন ধরে জেলে থাকা বাবার জামিন হবে শুনে ‘জেলার’ পরিচয় দেওয়া ব্যক্তির পাঠানো মুঠোফোনে এমএসএফের দুটি নম্বরে ২০ হাজার করে ৪০ হাজার টাকা পাঠান তিনি। দুটি নম্বরে বাড়তি ৮০০ টাকা পাঠান খরচ হিসেবে। মোজাম্মেল টাকা পাঠানোর পর নিশ্চিত হওয়ার জন্য ওই ব্যক্তির মুঠোফোনে কল দিয়ে বন্ধ পান। তখন তিনি বুঝতে পারেন প্রতারণার শিকার হয়েছেন।

মোজাম্মেলের বাড়ি বরগুনা জেলার আমতলী এলাকার তক্তাবুনিয়া গ্রামে। দুই ছেলে ও স্ত্রীকে নিয়ে থাকেন ঢাকার মিরপুরে। বাবা হত্যা মামলায় জড়িয়ে জেলে যাওয়ায় অল্প বয়সেই সংসারের হাল ধরতে হয় মোজাম্মেলকে। গ্রাম ছেড়ে ঢাকায় এসে শুরু করেন রিকশা চালানো। মোজাম্মেল আজ বুধবার বলেন, ‘জেলার সাহেব পরিচয়ে আমার ফোন দিয়ে আমার বাবার নাম, কোন মামলায় জেলে রয়েছেন সেগুলো বিস্তারিত জানান। জামিন করিয়ে দেবে বলে দুটি মুঠোফোন নম্বর পাঠিয়ে আমার কাছে ৪০ হাজার টাকা চান। আমি বিশ্বাস করে ওই নম্বরে টাকা পাঠাই।’

পুলিশ জানায়, বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রকল্প, এনজিওর খাবার ও স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার ‘ফাঁদে’ ফেলে সাধারণ মানুষের তথ্য নিয়ে বিভিন্ন কোম্পানির এজেন্টরা এমএসএফ অ্যাকাউন্ট খুলছেন। পরে কয়েক হাত ঘুরে সেই অ্যাকাউন্ট চলে যাচ্ছে প্রতারক চক্রের হাতে।

মোজাম্মেল জানান, বাবার জামিন হবে শুনে খুশিতে স্ত্রীর গয়না বিক্রি এবং কিছু টাকা ঋণ নিয়ে ওই ৪০ হাজার টাকা পাঠিয়েছিলেন। সেই ঋণের টাকা এখনো পুরো পরিশোধ করতে পারেননি।

তদন্তসংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা বলেছেন, কারাগার থেকে কীভাবে বন্দীর তথ্য প্রতারক চক্রের হাতে যাচ্ছে, সেটা তদন্ত করে বের করার চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে জেলার পরিচয়ে কারাগারে থাকা ব্যক্তিদের পরিবারের কাছে যে ব্যক্তি ফোন করেন, তাঁকে চিহ্নিত করা গেছে। তাঁর নাম তোরাব উদ্দিন। তিনি গ্রেপ্তার অনিকের চাচা। তোরাব প্রতারণার মাধ্যমে যে টাকা মুঠোফোনে লেনদেনের অ্যাকাউন্টে আনতেন, অনিক বিভিন্ন এলাকা ঘুরে সেই টাকা তুলে চাচার কাছে পৌঁছে দিতেন। ২০ হাজার টাকা আনলে চাচা তাঁকে দুই হাজার টাকা দিতেন। অনিকের কাছ থেকে উদ্ধার করা ২৪টি এমএসএফ অ্যাকাউন্টের লেনদেনের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গত ছয় মাসে প্রায় আড়াই কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে এসব অ্যাকাউন্টে।

পুলিশ জানায়, তোরাবের গ্রামের বাড়ি কক্সবাজারের কুতুবদিয়ার লেমশাখালী এলাকায়। প্রতারণায় জড়িয়ে গ্রাম ছেড়ে বসতি গড়েন বাঁশখালী এলাকায়। প্রতারণার টাকায় বাঁশখালীতে বাগানবাড়ি করেছেন তিনি। বাড়িটি চার দিক থেকে সিসি ক্যামেরা দিয়ে ঘেরা। সেখানে থেকেই প্রতারণা করেন তিনি।

লাখ লাখ টাকা লেনদেন, জানেন না অ্যাকউন্টের মালিক

মিরপুর থানায় করা মোজাম্মেলের মামলাটি গত মে মাসে তদন্ত শুরু করে পুলিশ। মামলার এজাহারে উল্লেখ করা দুটি এমএসএফ নম্বর ঘিরে শুরু হয় তদন্ত। একপর্যায়ে তদন্ত কর্মকর্তারা টাকা লেনদেনের একটি এমএসএফ নম্বরের সন্ধান পান। দেখা যায়, ওই একটি নম্বরে প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে লাখ লাখ টাকা জমা হচ্ছে। নম্বরটির বিস্তারিত তথ্য নিয়ে তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানতে পারেন, ওই এমএসএফ অ্যাকাউন্টটি খোলা হয়েছে এক বৃদ্ধা নারীর নামে। তিনি থাকেন রাজশাহীর গোদাগাড়ির একটি প্রত্যন্ত গ্রামে।

পুলিশের তদন্ত দল ছুটে যায় রাজশাহীতে। কথা বলে সেই বৃদ্ধার সঙ্গে। সেই আলাপচারিতার বরাত দিয়ে পুলিশ জানায়, করোনা–পরবর্তী সময়ে দেশে খাদ্যসংকট হবে বলে এক কেজি তেল দিয়ে ওই বৃদ্ধার কাছ থেকে জাতীয় পরিচয়পত্র ও চোখের আইরিশের ছবি নেন এমএসএফ কোম্পানির এজেন্টরা। বৃদ্ধাকে বলা হয়, নিয়মিত তাঁকে চাল, ডাল ও তেল দেওয়া হবে।

পুলিশ জানায়, বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রকল্প, এনজিওর খাবার ও স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার ‘ফাঁদে’ ফেলে সাধারণ মানুষের তথ্য নিয়ে বিভিন্ন কোম্পানির এজেন্টরা এমএসএফ অ্যাকাউন্ট খুলছেন। পরে কয়েক হাত ঘুরে সেই অ্যাকাউন্ট চলে যাচ্ছে প্রতারক চক্রের হাতে।

এ বিষয়ে মিরপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ মহসীন বলেন, এই প্রতারক চক্রের বিস্তার দেশব্যাপী। ইতিমধ্যেই তাঁরা এ রকম হাজার হাজার সিমের মাধ্যমে এমএসএফ অ্যাকাউন্ট খুলে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।

মামার ইমো হ্যাক করে ভাগ্নির কাছ থেকে নেন আড়াই লাখ টাকা

মিরপুর থানা সূত্র জানায়, মিরপুর নতুন বাজার এলাকার বাসিন্দা বিল্লাল হোসেন। তাঁর মামা রুহুল আমিন মালয়েশিয়াপ্রবাসী। মামার মাধ্যমে বিল্লাল বিদেশে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন। গত বছরের আগস্ট মাসে মামার ইমো অ্যাকাউন্ট নিয়ন্ত্রণে (হ্যাকড) নেয় প্রতারক চক্রের সদস্যরা।

এরপর প্রতারক চক্রের সদস্যরা রুহুল আমিন সেজে বিল্লালের সঙ্গে কথা বলেন। মালয়েশিয়া নেওয়ার কথা বলে কয়েকটি এমএসএফ অ্যাকাউন্ট পাঠিয়ে ২ লাখ ৬০ হাজার টাকা নেন। টাকা দেওয়ার এক দিন পর মামা রুহুল আমিন ভাগনেকে ফোন করে জানান, তাঁর ইমো অ্যাকাউন্ট ‘হ্যাকড’ হয়েছে।

এ ঘটনায় গত বছরের আগস্ট মাসে বিল্লাল হোসেনের শ্বশুর বাদী হয়ে মিরপুর থানায় একটি মামলা করেন। এই মামলার তদন্তেও রাজশাহীর ওই বৃদ্ধা নারীর নামে খোলা অ্যাকাউন্টের সন্ধান পাওয়া যায়।

মিরপুর থানার ওসি মোহাম্মদ মহসীন বলেন, এসব প্রতারণায় একই চক্রের সদস্যরা জড়িত। এই চক্রের বাকি সদস্যদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।

নুরুল আমিন

ঢাকা

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.