হত্যাচেষ্টা প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের লড়াইকে কী বদলে দেয়—এমন প্রশ্নের উত্তর খুঁজছেন যুক্তরাষ্ট্রের ভোটাররা। দুই মাসের ব্যবধানে রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পকে দুইবার হত্যার চেষ্টা চলেছে।
আগামী ৫ নভেম্বর অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। নির্বাচন সামনে রেখে জোরেশোরে প্রচার চালাচ্ছেন ট্রাম্প।
এর মধ্যে গত রোববার অপ্রত্যাশিত ঘটনার মুখে পড়েন ট্রাম্প। যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা (এফবিআই) বলেছে, ট্রাম্পকে হত্যাচেষ্টা হিসেবে এ ঘটনার তদন্ত করছে তারা।
গত জুলাই মাসে পেনসিলভানিয়ায় একটি নির্বাচনী সমাবেশে ভাষণ দেওয়ার সময় বন্দুকধারীর হামলার শিকার হন ডোনাল্ড ট্রাম্প। ওই হামলায় আহত হলেও প্রাণে বেঁচে যান তিনি। এর দুই মাস পর আবারও তাঁকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে বলে ধারণা করছে এফবিআই। গত রোববার যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায় ট্রাম্পের গলফ মাঠের কাছে গুলির ঘটনা ঘটে। সেখানে ঝোপের কাছে ওত পেতেছিলেন আততায়ী। পরদিনই এ বিষয়ে মুখ খোলেন ট্রাম্প। এক বিবৃতি তিনি বলেন, ‘আমি কখনোই আত্মসমর্পণ করব না।’
জুলাই মাসে বুলেটের আঘাত থেকে প্রাণে বেঁচে গেলেও ট্রাম্পের মনোবল ছিল দৃঢ়। সেদিন রক্তাক্ত অবস্থায় সমাবেশের মঞ্চ থেকে নামতে নামতে মুষ্টি উঁচু করে জনতার উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘লড়াই, লড়াই, লড়াই।’ সর্বশেষ হামলার পর ট্রাম্পের দেওয়া বিবৃতি সেই মনোবলেরই পুনরাবৃত্তি ঘটিয়েছে।
পর পর দুটি হামলার জন্য প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী কমলা হ্যারিসকে দায়ী করেছেন ট্রাম্প। তিনি বলেন, ‘ডেমোক্র্যাটদের বাকপটুতা ও মিথ্যাচারের ফলশ্রুতিতে (তাঁর ওপর) গুলি চালানো হচ্ছে।’
ট্রাম্পের এমন প্রতিক্রিয়া নতুন কিছু নয় বলে মনে করছেন রিপাবলিকান কৌশলবিদ জেমস ডেভিস। তিনি বলেন, ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রচার শিবির জুলাইয়ে ঘটা হামলার কথা ভোটারদের মনে করিয়ে দিতে চায়।
এসব হামলার ঘটনা দোদুল্যমান অঙ্গরাজ্যগুলোয় ট্রাম্পের পক্ষে ভোটারদের আকৃষ্ট করতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এসব রাজ্যের প্রধান প্রধান এলাকায় মাত্র কয়েক হাজার ভোট নির্বাচনের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে।
ডেভিসের মতে, জুলাই মাসে ঘটা হামলায় মানুষের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছিল। তবে গত রোববারের ঘটনায় ততটা প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। এর অর্থ হলো নির্বাচনের মাঠে সহিংসতার ঘটনা অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে গেছে। এখন ভোটারদের বড় একটি অংশ তাদের প্রার্থীর জন্য কাজ করতেই বেশি ব্যস্ত।
রিপাবলিকান দলের এই বিশ্লেষক বলেন, ‘গত রোববার হামলার পর আমি কিছু মানুষের সঙ্গে কথা বলেছি। মানুষ এমন কিছু ঘটতে পারে বলেই ধরেই নিয়েছিলেন, যা খুবই ভয়ংকর।’ সর্বশেষ হামলার ঘটনা মানুষের মনে নাড়া দেয়নি। বিষয়টি নিয়ে আগের চেয়ে বেশি চিন্তাশীল ভঙ্গিতে কথা বলছেন তাঁরা।’
জুলাই মাসে হামলার পর রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। হামলার দুই দিন পরই বিজয়ীর বেশে রিপাবলিকান দলের জাতীয় সম্মেলনের মঞ্চে ওঠেন তিনি। উইসকিনসন অঙ্গরাজ্যে এ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। ওই হামলায় ট্রাম্পের ডান কান ঘেঁষে একটি বুলেট চলে যায়। কানে আঘাত পাওয়ায় সেখানে ব্যান্ডেজ বেঁধেই সম্মেলন স্থলে আসেন তিনি।
হামলার ঘটনা ওই সম্মেলনের চিত্র পুরোপুরি বদলে দেয়। সেদিন দর্শক সারিতে থাকা রিপাবলিকান দলের সমর্থকেরা ট্রাম্পের অনুকরণে কানে প্রতীকী ব্যান্ডেজ পরে উপস্থিত হয়েছিলেন।
ট্রাম্পের সমর্থকদের প্রত্যাশা, মৃত্যুর কাছ থেকে ফিরে আসার বিষয়টি ভোটারদের সামনে তাঁকে অনেক বেশি ঐক্যবদ্ধ প্রার্থী হিসেবে উপস্থাপন করবে।
কিছু রাজনৈতিক বিশ্লেষক বলছেন, গত জুনে মুখোমুখি বিতর্কে তৎকালীন ডেমোক্রেটিক দলের প্রার্থী জো বাইডেনকে হারিয়ে নির্বাচনী লড়াইয়ে অনেকটা এগিয়ে যান ট্রাম্প। জুলাই মাসে হামলার পর তাঁর জয়ের সম্ভাবনা অনেকটাই নিশ্চিত হয়ে যায়।
কিন্তু ওই হামলার মাত্র এক সপ্তাহের ব্যবধানে নির্বাচনের মাঠ থেকে সরে দাঁড়ান বাইডেন। ডেমোক্র্যাটরা প্রার্থী হিসেবে নতুন প্রার্থী হিসেবে সামনে নিয়ে আসেন কমলা হ্যারিসকে। কিছুদিনের ব্যবধানে ব্যাপক সমর্থন আদায় করে নেন কমলা। আর এতেই ট্রাম্পের একক জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়ে।
গ্রীষ্ম মৌসুমজুড়ে নির্বাচনী প্রচারাভিযান ব্যাহত হলেও বিভিন্ন জরিপে দেখা যায়, নির্বাচনের মাঠে দুই প্রার্থীই সমানে সমান। সম্প্রতি নিউইয়র্ক টাইমস/সিয়েনা কলেজের জরিপে দেখা যায়, মিশিগান, পেনসিলভানিয়া, জর্জিয়া, নর্থ ক্যারোলাইনা ও অ্যারিজোনার মতো প্রধান প্রধান অঙ্গরাজ্যে দুই প্রার্থীকে সমর্থনের ব্যবধান মাত্র ১ শতাংশ।
রাজনৈতিক কৌশলবিদ রিনা শাহের ধারণা, গত রোববারের হামলার ঘটনা আগেরবারের মতো আলোড়ন সৃষ্টি করবে না। এবার মানুষ মনে খুব বেশি সহানুভূতি তৈরি হবে না। কারণ, ভোটাররা যাঁর ওপর বিশ্বাস রাখেন, তাঁকেই সমর্থন দেবেন।
রিনা আরও বলেন, ব্যতিক্রমধর্মী কোনো ঘটনার কারণে নির্বাচনের গতিশীলতায় খুব বেশি পরিবর্তন আসে না। আর এ দাবির পক্ষে বারবার প্রমাণ পাওয়া গেছে বলেও জানান তিনি। ২০২০ সালে ট্রাম্পের নির্বাচনের ফলাফল ঘুরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা, এ বছর তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত হওয়া এবং বাইডেনের নির্বাচন থেকে সরে যাওয়ার মতো ঘটনার দিকে ইঙ্গিত করেন তিনি। এ ধরনের ঘটনায় মার্কিন জনগণ এখন খুব বেশি পরোয়া করছেন না বলেও মনে করছেন তিনি। ফলে গত রোববারের ঘটনায় নির্বাচনী দৃশ্যপটে খুব একটা পরিবর্তন আসবে না।
গত রোববার ট্রাম্পের ওপর হামলার ঘটনার দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব থাকতে পারে। রাজনীতিক অঙ্গনে এ ঘটনার তাৎপর্য অনেক। তবে ভোটের মাঠে এটি খুব বেশি প্রভাব রাখবে না।
জুলাই হামলার পর দেখা গেছে, কীভাবে গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা প্রার্থীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করেন এবং কীভাবে প্রার্থীরা নিরাপদে প্রচার চালান।
রোববার ফ্লোরিডার সম্ভাব্য হামলা রুখে দিতে সক্ষম হওয়া প্রশংসায় ভাসছেন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা। তবে ঠিক সময়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিতে না পারলে অবস্থা কতটা খারাপ হতে পারত, তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে।
গত সোমবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন, গোয়েন্দা সংস্থার আরও সাহায্য দরকার। আমি মনে করি, তাদের প্রয়োজনে কংগ্রেসকে সাড়া দেওয়া উচিত।
জুলাই হামলা পরও প্রচারাভিযান চালিয়ে যাচ্ছেন ট্রাম্প। তবে তাঁর নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। সাম্প্রতিক হামলার কারণে আসন্ন নির্বাচনী সভা ও অন্য কর্মসূচি বাতিলের কোনো ইঙ্গিত দেয়নি ট্রাম্পের প্রচার শিবির।
আল জাজিরা