‘যৌতুকের কারণে কয়েক ডজন পাত্র আমাকে প্রত্যাখ্যান করেছে’

0
107
গুঞ্জন তিওয়ারি

ভারতে ১৯৬১ সাল থেকে যৌতুক দেওয়া এবং নেওয়া বেআইনি হলেও এখনও কনেপক্ষের কাছ থেকে নগদ অর্থ, পোশাক, স্বর্ণ উপহার হিসেবে পাবে বলে আশা করে বরপক্ষ। সম্প্রতি ভোপালের ২৭ বছর বয়সী এক শিক্ষক যৌতুক নামের এই ‘সামাজিক কুফল’ বন্ধে বিয়ের মণ্ডপে পুলিশ অফিসার মোতায়েন এবং অভিযান পরিচালনা করার জন্য আবেদন করেছেন।

গুঞ্জন তিওয়ারি (ছদ্মনাম) নামের ওই নারী বিবিসিকে জানিয়েছেন যৌতুকের কারণে কয়েক ডজন পাত্রপক্ষ তাকে প্রত্যাখ্যান করেন।

সবশেষ ফেব্রুয়ারিতে তার বাবা বিয়ের জন্য এক পাত্রকে তাদের বাড়িতে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। তার বাবা পাত্রপক্ষের সঙ্গে গল্প করার ফাঁকে বসার ঘরে তিনি অতিথিদের সামনে চা এবং নাস্তা নিয়ে যান। তিনি সেই মুহূর্তকে ‘অস্বস্তিকর’ হিসেবে বর্ণনা করেন।

তিনি বিবিসিকে মোবাইলে বলেন, ‘একবার ভাবেন সবাই একযোগে আপনার দিকে তাকিয়ে আছে। তারা আপনাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে। আপনাকে বাচ-বিচার করছে।’

এমনকি গুঞ্জন কীভাবে বরপক্ষের সামনে উপস্থিত হবে তার অনেক সূক্ষ্ম বিষয় নিয়েও আগে থেকে পরিকল্পনা করা হয়েছে। তার মা সবুজ রঙের শাড়ি পছন্দ করে রেখেছেন যেনো তার মেয়েকে দেখতে বেশি সুন্দর লাগে। তার মা তাকে বরপক্ষের সামনে হাসতে নিষেধ করেছেন কারণ তার আকাঁ-বাঁকা দাঁত যেনো বরপক্ষের মনোযোগ কেড়ে না নেয়।

গুঞ্জন জানায়, এটি এমন একটি বিষয় যার সঙ্গে সে অতি পরিচিত। বছরে ছয়বারের বেশি তাকে এই পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়েছে। তারা যে প্রশ্নগুলো করেছে সেগুলোও খুব পরিচিত। তারা তার শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং কাজ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেছে। সে রান্না পারে কিনা সেসব সম্পর্কেও জিজ্ঞাসা করেছে।

তিনি বলেন, বসার ঘরে ঢোকার আগেই আমি শুনতে পেলাম আমার বাবা বরপক্ষকে জিজ্ঞাসা করছে যৌতুক হিসেবে কত রুপি তারা আশা করছেন। তারা জানালেন, যৌতুক হিসেবে তারা ৫০ লাখ থেকে ৬০ লাখ রুপি আশা করছেন। মজার ছলে তারা বললেন, ‘যদি আপনার মেয়ে দেখতে সুন্দরী হয় তবে আমরা কিছু ডিসকাউন্ড দিবো আপনাকে।’

বিয়ের কথাবার্তা আগানোর সময় গুঞ্জন বুঝতে পারছিলেন পাত্রপক্ষ তাদেরকে যৌতুকের বিষয়ে কোন ছাড় দিবে না। কারণ, তারা তাকে কপালের তিল এবং আকাঁ-বাঁকা দাঁত নিয়ে প্রশ্ন করছিলেন।

চা-পর্ব শেষে গুঞ্জন এবং পাত্রকে আলাদা করে কথা বলার সুযোগ করে দেওয়া হয়। তখন গুঞ্জন পাত্রকে জানায়, যৌতুকের কারণে তিনি বিয়ে করতে চান না। উত্তরে পাত্র তাকে জানায় সে তার সঙ্গে একমত এবং সে বলে, ‘যৌতুক একটি সামাজিক ব্যাধি’। তখন আমি ভাবি যে, ‘আমি এ পর্যন্ত যাদের সঙ্গে দেখা করেছি তাদের থেকে সে আলাদা।’  কিন্তু তার একটু পরেই জানতে পারেন যে, গুঞ্জনকে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে।

তিনি বলেন, ‘আমার মা এর জন্য আমাকে দায়ী করেছেন, আমার যৌতুকবিরোধী অবস্থানকে দায়ী করেছেন। আমার ওপর মারাত্মক রাগন্বিত ছিলেন আমার মা। এমনকি আমার সঙ্গে দুই সপ্তাহ কোন কথা বলেন নি তিনি।’

গুঞ্জন জানায়, গত ছয় বছরে তার বাবা এবং তার পরিবার ১০০ থেকে ১৫০ পাত্রের খোঁজ করেছেন। এর মধ্যে দুই ডজনের বেশি পাত্রের সঙ্গে দেখা করেছেন। কিন্তু বেশিরভাগ পাত্রই যৌতুকের কারণে বিয়ে ভেঙে দেয়।

‘প্রতিবার প্রত্যাখ্যানের পর আমি আমার আত্ম-বিশ্বাস হারিয়ে ফেলি। অথচ আমি গণিতে স্মাতকোত্তর পাশ করেছি এবং শিক্ষকতা করি।’ বলেন গুঞ্জন

তিনি বলেন, ‘যখন আমি যৌক্তিকভাবে চিন্তা করি, তখন আমি ভাবি-দোষটা আমার নয়। দোষটা তাদের যারা যৌতুক দাবি করে। কিন্তু মাঝে মাঝে আমি ভাবি-পরিবারের কাছে বোঝা হয়ে গেছি আমি।’

এক গবেষণায় দেখা গেছে, যৌতুক দেওয়া এবং নেওয়া ৬০ বছরের বেশি সময় ধরে বেআইনি হলেও ৯০ শতাংশ ভারতীয়রা বিয়ের সময় যৌতুক দিয়ে থাকে। ১৯৫০ থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত এক ট্রিলিয়ন ডলারেরও বেশি অর্থ যৌতুক হিসেবে দেওয়া হয়েছে।

আর যৌতুকের এই মোটা অঙ্কের অর্থ পরিশোধ করতে অভিভাবকদের বিশাল অঙ্কের ঋণ গ্রহণ বা জমি ও বাড়িঘর বিক্রি করতে হয়েছে। যা দেশটির খুবই পরিচিত দৃশ্য। এ অর্থ প্রদানের পরও মেয়ে বা কনের সুখী জীবন নিশ্চিত হয় না।

দেশটির ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর তথ্য অনুসারে, ২০১৭ সাল থেকে ২০২২ সালের মধ্যে ভারতে ৩৫ হাজার ৪৯৩ গৃহবধূকে হত্যা করা হয়েছে। যার মূল কারণ ছিল অপর্যাপ্ত যৌতুক। অর্থাৎ যৌতুকের জন্য গড়ে একদিনে ২০ জন নারীর প্রাণ হারিয়েছেন।

জাতিসংঘ বলছে, দেশটিতে প্রতিবছর জন্মের পূর্বে লিঙ্গ স্ক্রীনিং পরীক্ষা করে প্রায় ৪ লাখ কন্যাশিশুর ভ্রূণ গর্ভপাত করানো হয়। এর প্রধান কারণ যৌতুক।

ভোপালের পুলিশ প্রধান হরিনারায়ণ চারি মিশ্রকে লেখা আবেদনে গুঞ্জন লিখেছেন, যৌতুক বন্ধে একমাত্র সমাধান হল বিয়ের মণ্ডপে অভিযান চালানো এবং যৌতুক দেওয়া ও গ্রহণকারীদের গ্রেপ্তার করা। তাদের শাস্তির আওতায় আনা।

এ বিষয়ে ভোপালের পুলিশ প্রধান হরিনারায়ণ চারি মিশ্র বলেন, ‘যৌতুক একটি সামাজিক কুফল এবং আমরা এটি বন্ধ করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আমি সমস্ত থানাকে নির্দেশ দিয়েছি যে কোনো নারী তাদের কাছে গেলে তাকে যথাযথ সাহায্য করতে।’

তিনি আরও বলেন, ‘পুলিশের সীমাবদ্ধতা রয়েছে, তারা সব জায়গায় উপস্থিত থাকতে পারে না। তবে আমাদের মানসিকতা পরিবর্তন প্রয়োজন। পাশাপাশি এই বিষয়ে অমাদের সচেতনতা বাড়াতে হবে।’

এদিকে গুঞ্জন জানায়, তিনি বিয়ে করতে চান। তিনি বলেন, ‘জীবন অনেক বড় একা কাটানো মুশকিল। কিন্তু বিয়ের জন্য এক রুপিও যৌতুক দিতে রাজি না।’

কিন্তু এদিকে সময় এগিয়ে চলছে, আমার বয়স বেড়েই চলেছে। কারণ বিয়ের বাজারে ২৫ বছর বয়সী নারীকে বয়স্ক বলে ধরা হয়। বলে জানান গুঞ্জন।

তিনি বলেন, ‘বিয়ের জন্য বেশিরভাগ পাত্রই ৫০ লাখ রুপির বেশি যৌতুক দাবি করেন। আমার বাবার পক্ষে এতো অর্থ দেওয়ার সক্ষমতা নেই। তিনি অর্ধেকের বেশি যৌতুক দিতে চেয়েও আমাকে বিয়ে দিতে পারেন নি। আমি পরিবারের জন্য কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছি।’

‘আমার বাবা বলেন, ছয় বছর ধরে তোমার জন্য পাত্র খুঁজে বেড়াচ্ছি কিন্তু যৌতুক ছাড়া ৬০ বছরের বৃদ্ধকেও তোমাকে বিয়ের জন্য রাজি করানো সম্ভব না।’ বলেন গুঞ্জন।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.