ছোট ছোট কম্পন দিচ্ছে বড় ভূমিকম্পের বার্তা। প্রতিবার ভূমিকম্পের কাঁপন নাড়িয়ে দেয় আলোচনাও। রাজধানীসহ সারাদেশের ভূমিকম্পের ঝুঁকি নিয়ে ক’দিন চলে কথন। সপ্তাহ না ঘুরতেই থেমে যায় ভূমিকম্প নিয়ে রকমারি বয়ান। ঘনবসতিপূর্ণ ঢাকা নগরীর ঝুঁকি কমাতে এর আগে বিভিন্ন প্রকল্প ও পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কথা বলা হলেও এগুলোর বেশির ভাগই দেখেনি আলোর মুখ।
ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকা বিভিন্ন সময় তৈরি হলেও সেগুলো অপসারণের কোনো উদ্যোগ দৃশ্যমান হয় না। এটি অনেকটাই চিঠি চালাচালিতে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। ৩ হাজার ২০০ ভবন চিহ্নিত করেই থেমে আছে কর্তৃপক্ষ। ঢাকায় ভবন নির্মাণের অনুমোদন দেয় রাজউক। কিন্তু সেটি নকশামতো হলো কিনা, ভালো মানের সামগ্রী ব্যবহার হলো কিনা তা কেউ দেখে না। তিলোত্তমা এ নগরীতে লাখ লাখ ভাড়াটিয়া জানেই না, তারা যেখানে বাস করছে, তা কতটা ঝুঁকিপূর্ণ! আর তা জানানোর মতো কোনো সংস্থাও নেই। আবার ভবন ঝুঁকিপূর্ণ কিনা তা জানতে বাড়ির মালিককে কী করতে হবে– সে বিষয়েও সরকারের নেই কোনো প্রচারণা কিংবা কার্যক্রম।এ পটভূমিতে আজ শুক্রবার পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক দুর্যোগ প্রশমন দিবস। ১৯৮৯ সাল থেকে প্রতিবছর ১৩ অক্টোবর বিশ্বজুড়ে দিবসটি পালন হয়।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মেহেদী আহমেদ আনসারী বলেন, ৭ মাত্রার কাছাকাছি ভূমিকম্প একশ থেকে দেড়শ বছর পরপর হতে পারে। সে হিসাবে ৭ মাত্রার ভূমিকম্প বাংলাদেশে যে কোনো সময় হওয়ার আশঙ্কা আছে। ঢাকা শহরের ২৫ ভাগ ভবন ভূমিকম্প সহনশীল করে তৈরি হয়নি। কংক্রিটের মান ৩ হাজার পিএসআই থাকা উচিত হলেও আছে ১ হাজার ২০০ থেকে দেড় হাজার পিএসআই। রডের গুণগত মান থাকা উচিত ৭০ থেকে ৮০ পিএসআই। অথচ পরীক্ষা করে পাওয়া গেছে ৪০ পিএসআই। ভূমিকম্প থেকে রক্ষা পেতে কলামে ঘন ঘন রড দিতে হয়। এগুলো না মানলে ভবন ধসে পড়ার আশঙ্কা থাকে।
সিদ্ধান্ত হলেও বাস্তবায়ন নেই
সম্প্রতি হাউজিং অ্যান্ড বিল্ডিং রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এইচবিআরআই) এক গবেষণায় জানা গেছে, ঢাকা শহরে যত কংক্রিটের ভবন আছে, তার ৫৬ দশমিক ২৬ শতাংশ রয়েছে ভূমিকম্পের উচ্চ ঝুঁকির মধ্যে। মাঝারি ঝুঁকির মধ্যে ৩৬ দশমিক ৮৭ শতাংশ ভবন। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) জিআইএস ডেটাবেজ থেকে ১ লাখ ৬ হাজার ৯৩টি ভবনের তথ্য নিয়ে গবেষণা পরিচালনা করেছে এইচবিআরআই। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের ৪৮টি ওয়ার্ডে ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে থাকা ভবনের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি বলে উল্লেখ করা হয়েছে গবেষণা প্রতিবেদনে। এর মধ্যে উত্তর সিটি করপোরেশনে (ডিএনসিসি) খুব উচ্চ ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে ১, ৩, ৭, ১২, ১৪, ২২, ২৯, ৩০, ৩১, ৩২, ৩৪ ও ৩৫ নম্বর ওয়ার্ড। আর উচ্চ ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে ২, ৫, ১১, ১৩, ১৬, ১৮, ১৯, ২১, ২৩, ২৫, ২৬ ও ৩৬ নম্বর ওয়ার্ড। একইভাবে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে (ডিএসসিসি) খুব উচ্চ ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে ১, ১২, ১৩, ১৬, ১৭, ২৩, ২৫, ২৬, ২৮, ২৯, ৩০ ও ৪৪ নম্বর ওয়ার্ড। আর উচ্চ ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে ২, ৩, ৪, ৬, ৭, ৯, ১৫, ১৯, ২৭, ৩৯, ৪৫, ৪৭ ও ৪৮ নম্বর ওয়ার্ড।
এদিকে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের আরবান রেজিলিয়েন্স প্রকল্পের আওতায় ঢাকা শহরের সরকারি ভবনগুলোর ওপর সমীক্ষা করেছে রাজউক। ৩ হাজার ২০০ ভবন পরীক্ষা করে ২ হাজার ৮০০টি ঝুঁকিপূর্ণ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ২৪০টি ভবন অধিক ঝুঁকিপূর্ণ। গত ২২ মার্চ নগর উন্নয়ন কমিটির সভায় ২২৯টি ঝুঁকিপূর্ণ ভবন নিয়ে আলোচনা হয়। এর মধ্যে ৪২টি ভেঙে ফেলা ও ১৮৭টি রেট্রোফিটিং (এক ধরনের সংস্কার পদ্ধতি) করার সিদ্ধান্ত হয়। সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, অধিক ঝুঁকিপূর্ণ ৪২টি ভবন সাত দিনের মধ্যে খালি করতে চিঠি দেয় রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ। কিন্তু কমিটির নির্দেশনার সাত মাস পেরিয়ে গেলেও কোনো ভবন খালি করা হয়নি।
আরবান রেজিলিয়েন্স প্রকল্পের পরিচালক আব্দুল লতিফ হেলালী বলেন, প্রথম পর্বে স্কুল, কলেজ ও হাসপাতাল ভবনগুলোর সমীক্ষা করা হয়েছে। তারা প্রস্তাব করেছেন, ৩ হাজার ২০০ ভবনের মধ্যে ২ হাজার ৮০০টি ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় সংস্কার করতে হবে। ঢাকা শহরের ছয় লাখ ভবন পর্যায়ক্রমে পরীক্ষার আওতায় আসবে। তা ছাড়া ব্যক্তিমালিকানার কেউ যদি আবেদন করেন, সেটার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হবে। এর আগে ২০১১ সাল থেকে জাইকার সহযোগিতায় গৃহায়ন ও গণপূর্ত অধিদপ্তর পরিচালিত চার বছর মেয়াদি একটি জরিপে জানা যায়, গণপূর্ত বিভাগের মাধ্যমে নির্মিত ঢাকার ২ হাজার ১৯৩টি সরকারি ভবনের ৫৯ শতাংশ ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার অধিকতর ঝুঁকিতে রয়েছে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের শিক্ষক এবং বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সাবেক সভাপতি আকতার মাহমুদ বলেন, রাষ্ট্র যখন মনে করবে ঝুঁকিপূর্ণ, তখন অবশ্যই ব্যবস্থা নিতে হবে। কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে সেই দায় রাষ্ট্রকেই নিতে হয়। শুধু তালিকা তৈরি না করে জানমালের নিরাপত্তার স্বার্থে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। রাজউকের এক সমীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, টাঙ্গাইলের মধুপুরে মাটির নিচে যে চ্যুতিরেখা বা ফল্টলাইন রয়েছে, সেখানে ৬ দশমিক ৯ মাত্রার ভূমিকম্প হলে ঢাকায় ৮ লাখ ৬৫ হাজার ভবন ধসে পড়বে।
জনবলেরও ঘাটতি
রাজধানীর আগারগাঁওয়ে আবহাওয়া অধিদপ্তরের ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণ ও গবেষণা কেন্দ্রে গিয়ে দেখা গেছে অচলাবস্থা। দেশের বিভিন্ন স্থানে সংস্থাটির ১০টি ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র আছে। সারাদেশ থেকে পাওয়া তথ্য পর্যবেক্ষণ ও গবেষণার জন্য ঢাকা কার্যালয়ে দায়িত্বে আছেন মাত্র একজন আবহাওয়াবিদ ও একজন সহকারী আবহাওয়াবিদ। তবে দু’জন সার্বক্ষণিক দায়িত্ব পালন করতে পারেন না। এ জন্য মাঝেমধ্যে তথ্য সরবরাহ করেন ইলেকট্রনিক অ্যাসিস্ট্যান্ট, অফিস সহকারী বা ওয়্যারলেস অপারেটরের মতো তৃতীয় বা চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী।
দুর্যোগে উদ্ধারকাজ পরিচালনার জন্য রাজধানীর গুলশান ২ নম্বরে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন কার্যালয়, অর্থাৎ নগর ভবনের দ্বিতীয় তলায় প্রায় ২০ কোটি ৩০ লাখ টাকা ব্যয়ে আরবান রেজিলিয়েন্স প্রকল্পের আওতায় জরুরি পরিচালন কেন্দ্র (ইওসি) করা হয়েছে। উত্তরের মেয়র আতিকুল ইসলাম গত বছর ৩১ অক্টোবর এটি উদ্বোধন করেন। তবে এখন পর্যন্ত জনবল নিয়োগ হয়নি। সেন্টারের জন্য কেনা ১৯টি ভিন্ন কাজের প্রয়োজনীয় ৮৭ ধরনের সরঞ্জাম ও যন্ত্রাংশ পরিচালনায় ৯ জন থাকার কথা; বাস্তবে কেউই নেই।
এদিকে, সাভারের রানা প্লাজা ধসের পর উদ্ধার কার্যক্রমে যেসব সরঞ্জাম কেনা হয়েছিল, তাও ব্যবহার না করায় অকেজো হতে চলেছে। এ বিষয়ে বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মেহেদী আহমেদ আনসারী বলেন, ২০০ কোটি টাকার সরঞ্জাম কেনা হয়েছে। কিন্তু ব্যবহার না হওয়ায় সেসব নষ্ট হওয়ার পথে। রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর প্রস্তুতি কিছুটা ভালো হয়েছিল। সে সময় অনেক সরঞ্জাম কেনা, সেগুলো নিয়ে নাড়াচাড়া ও প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। কিন্তু গত ১০ বছরে বড় কোনো দুর্যোগ না হওয়ায় আমরা প্রায় ভুলেই গেছি। শুধু ভূমিকম্প নিয়ে সরকারের একটি আলাদা প্রতিষ্ঠান থাকা উচিত।
২০১৫ সালে নেপালে ভূমিকম্পের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কাউন্সিলের বৈঠকে ‘ন্যাশনাল ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার’ প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত হয়। পরে চীনের সহায়তায় সেন্টার প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়া হলেও কাজ চলছে ধীরগতিতে।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান বলেন, ভূমিকম্পে ক্ষতি কমাতে গত বছর বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড (বিএনবিসি) অনুমোদন করেছে। এ কোড মেনেই নির্মাণ করতে হবে ভবন। কোড মেনে ভবন নির্মাণ হলে সেটা ৭ দশমিক ৫ মাত্রার ভূমিকম্প সহনশীল হবে। এ ছাড়া সব ভবন পরীক্ষা করা হবে। দুর্বল অবকাঠামো নিয়ে যেসব ভবন নির্মাণ হয়ে গেছে, সেগুলো রেট্রোফিটিং করে ভূমিকম্পন সহনশীল করা হবে। ভূমিকম্পে ক্ষতি কমাতে জাপানের মতো অবকাঠামো নির্মাণে তারা কাজ করছেন। ১৫ অক্টোবর জাপানের সঙ্গে একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় সভার পর অ্যাকশন প্ল্যান তৈরি করা হবে।