‘বিদ্রোহী’ প্রার্থীরা কোন পক্ষের ট্রয়ের ঘোড়া?

ফারুক ওয়াসিফ

0
120

দল সিটি নির্বাচনে যাবে না, কিন্তু স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে বিএনপি নেতারা দাঁড়িয়ে যেতে পারেন। দল যদি তাতে বাধা না দেয়, তাহলে যা দাঁড়ায় তা মোগল আমলের একটা গল্পের মতো।

মাথা উঁচু করে তবে পেছন ফিরে
মোগল রাজবংশ আর ইরানের সাফাভিদ রাজবংশের উৎপত্তি একই তৈমুর-চেঙ্গিস খানদের থেকে। একই বংশ হলেও দুই সাম্রাজ্যের ভেতরে কে বড়, তা নিয়ে দেমাগ ছিল। তো একবার পারস্যের রাজদূত এসেছেন মোগল সম্রাট শাহজাহানের দরবারে। মোগলরা জানত যে, ইরানিরা ভারতীয় কায়দায় মাথা ঝুঁকিয়ে সালাম করে না। এখন সম্রাটের সামনে মাথা নত না করলে আবার ইজ্জত থাকে না। বুদ্ধি করে দরবারের দরজা এমনভাবে বানানো হলো যে, মাথা নিচু না করে ঢোকাই অসম্ভব। কিন্তু বুদ্ধিমান পারসি দূত সেই অভিসন্ধি বুঝতে পেরে দরজার কাছে এসে, সম্রাটের দিকে পেছন ফিরে নিচু হয়ে প্রবেশ করলেন; গাধা-ঘোড়ারা যেভাবে আস্তাবলে ঢোকে। শাহজাহান পারসি চালাকির কাছে হার মেনে বললেন: ‘হা আল্লা! আপনি কি এটাকে আপনার মতো গর্দভের আস্তাবল ভেবেছেন যে ওইভাবে ঢুকলেন?’ পারস্যের দূত উত্তর দিলেন: ‘পারস্যের তুলনায় আপনার দরবার গাধার আস্তাবলই বটে, সে জন্য গাধার কায়দাতে ঢুকলাম।’

বিএনপির বুদ্ধিটাও পারস্যের দূতের মতো হতে পারে। এই সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে যাওয়া মানে মাথা নিচু করে ঢোকা। তাই তারা মাথা উঁচু রেখে (দলীয় সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন নয়) পেছন ফিরে (স্বতন্ত্র প্রার্থিতায় বাধা নেই) সিটি নির্বাচনে অংশ নিতে পারে।

ইতোমধ্যে সিলেটে বর্তমান বিএনপিদলীয় মেয়র আরিফুল হকের প্রার্থী হওয়ার কথা শোনা যাচ্ছে। অন্যান্য সিটিতেও বিএনপির আগ্রহী প্রার্থীরা স্বতন্ত্র প্রতীকে দাঁড়ানোর চেষ্টা-তদবির করছেন বলে সংবাদ আসছে। এর আগে নারায়ণগঞ্জের মেয়র পদে বিএনপি নেতা তৈমূর আলম খন্দকার স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে দল থেকে বহিষ্কৃত হয়েছিলেন। এবারও বিএনপির কেউ যদি স্বতন্ত্র প্রার্থী হন এবং দল থেকে বহিষ্কৃতও হন, তাতে দলীয় শৃঙ্খলা থাকবে; আবার সময়মতো দলের লোককে দলে ফেরানোও যাবে। এই কৌশলে বিএনপি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আনুষ্ঠানিকভাবে অংশ না নিয়েও অংশ নিতে পারে। তাতে লাভ এই; দেশের বড় নগরীগুলোতে দলটির নেতাকর্মীর সক্রিয়তা ও গণসংযোগ এগোবে।

স্বতন্ত্ররা আসলে কোন পক্ষের ট্রয়ের ঘোড়া
নির্বাচন কমিশনের তপশিল অনুযায়ী, আগামী ২৫ মে গাজীপুর সিটি করপোরেশনে ভোট। এর পর ১২ জুন খুলনা ও বরিশালে এবং ২১ জুন রাজশাহী ও সিলেট সিটি করপোরেশনে। গত মেয়র নির্বাচনে এই পাঁচ সিটিতে বিএনপির যে পাঁচজন প্রার্থী ছিলেন, তাঁদের মধ্যে অন্তত তিনজন এবারের নির্বাচন নিয়েও বেশ কৌতূহল দেখাচ্ছেন। তাঁরা হলেন– সিলেটের আরিফুল হক চৌধুরী, খুলনার নজরুল ইসলাম (মঞ্জু) ও গাজীপুরের হাসান উদ্দিন সরকার। হাসান সরকার আওয়ামী লীগকে খালি মাঠে ছেড়ে না দেওয়ার কথাও বলেছেন। একই রকম যুক্তি দিচ্ছেন আগ্রহী অন্য নেতারাও।

যুক্তির দিক থেকে বলা যায়, মাঠ ছেড়ে দিলেই বরং নির্বাচনকে একতরফা দেখানো যায়। বর্তমান অবস্থায় ঘটনাটা আওয়ামী লীগের প্রতি অনাস্থাই বাড়াবে। আবার দলীয়ভাবে না গিয়ে ব্যক্তিগতভাবে যদি বিএনপির নেতারা দাঁড়িয়ে যান, তাহলে আওয়ামী লীগ নেতা ও মন্ত্রীরা বলার মওকা পাবেন– বিএনপির মধ্যে শৃঙ্খলা নেই; তারা কীভাবে দেশ চালাবে? এর উত্তরে বিএনপি হয়তো বহিষ্কারের কার্ড খেলবে। কিন্তু নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করায় বেশি লাভ, নাকি আওয়ামী লীগকে ভোটের মাঠে নাস্তানাবুদ করায় বেশি লাভ, তা আসলে কৌশলী হিসাব-নিকাশের প্রশ্ন। এই প্রশ্নের সঙ্গে জড়িয়ে আছে মে মাসজুড়ে বিএনপির আন্দোলন কর্মসূচি সফল করার প্রসঙ্গ। একদিকে কয়েকটি মহানগরে কর্মীদের একাংশ ভোটের কাজে ব্যস্ত থাকবে; বাদ বাকিরা আন্দোলন চালাবে; সেটা এক মুশকিলের ব্যাপার হবে তাদের জন্য। যদি তারা সব দিক সামলাতে পারে এবং সে রকম পরিকল্পনা হাতে থাকে, তাহলে স্বতন্ত্রদের ‘আমাকে আমার মতো থাকতে দাও’ মনোভাবকে সাময়িকভাবে ছাড় দিয়ে বিএনপি সময়মতো টান দিতে পারে। এই স্বতন্ত্ররা অবশ্যই ট্রয়ের ঘোড়া, তবে তা কি আওয়ামী লীগের সাজানো ছকের ট্রয় নগরীতে অনুপ্রবেশকারী হিসেবে, নাকি উকিল মডেলে বিএনপি দুর্গে শত্রুপক্ষের লোক হিসেবে; তা কিছু বিষয়ের ওপর নির্ভর করবে।

আ’লীগের ‘বিদ্রোহী’ ‍+ বিএনপির ‘স্বতন্ত্র’
আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচন বয়কট, কিন্তু অনানুষ্ঠানিকভাবে স্বতন্ত্র প্রার্থী দাঁড় করানোর কৌশল তখনই ফল দেবে, যখন ব্যাপারটা কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সঙ্গে সমঝোতার ভিত্তিতে হবে। তাতে সরকারি আড়কাঠিরা যেভাবে বিএনপি নেতাদের নির্বাচনে দাঁড়াতে টোপ দিচ্ছে, সেই টোপের প্রভাব কাটানো যায়। বরং পাল্টা টোপ দিতে পারে বিএনপি– দাঁড়ালে নিজ দায়িত্বে দাঁড়াও এবং আওয়ামী লীগের জন্য খেলাটা জটিল করে দাও। দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় উপনির্বাচনে দাঁড়িয়েছিলেন দলটির প্রবীণ সদস্য ও পাঁচবারের সংসদ সদস্য উকিল আবদুস সাত্তার। বিএনপি যদি এই ‘উকিল মডেল’ খারিজ করতে চায়, তাহলে কঠোর হওয়ার বদলে কৌশলী হওয়াই ভালো। যেভাবে পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রতীকে দাঁড়াতে চাওয়া বিএনপি নেতাদের নিয়ে ‘ঝুঁকির’ কথা বলা হচ্ছে, সেটাকে সরকারের জন্যই ‘ঝুঁকি’ বানিয়ে দিতে পারে বিএনপি।

খেলাটা আওয়ামী লীগের জন্যই জটিল হয়ে যাচ্ছে। গাজীপুরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বহিষ্কৃত নেতা জাহাঙ্গীর আলমও প্রার্থী হতে চান। সেটা হলে দলের মনোনীত প্রার্থী বেকায়দায় পড়বেন। কেননা, তখন তাঁর বিরুদ্ধে শুধু স্বতন্ত্র, জাতীয় পার্টি ও ইসলামী দলের প্রার্থীই থাকবে না; সাবেক মেয়র ও বিদ্রোহী নেতার মতো শক্ত প্রতিপক্ষও থাকবে। একই ঘটনা ঘটতে পারে বরিশালেও। সেখানে বর্তমান মেয়র ও তাঁর প্রভাবশালী পিতা আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ নিজেরাই মস্ত বড় অসুবিধা তৈরি করতে পারেন সরকারদলীয় প্রার্থীর জন্য। এ জন্যই বলা হচ্ছে, যেখানে যেখানে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী থাকবে, সেখানে বিএনপির স্বতন্ত্র প্রার্থীদের জন্য সুবিধাজনক পরিস্থিতি থাকতে পারে।

নীতি বনাম কৌশল
এই সরকারের অধীনে কোনো পর্যায়ের নির্বাচনে না-যাওয়া বিএনপির জন্য নীতিগত বিষয়। ২০১৮ সালের মতো ‘আন্দোলনের কৌশল’ হিসেবে নির্বাচনে শামিল হওয়ার সুযোগ তার আর নেই। তাহলে তাদের আন্দোলনের নৈতিক ভিত্তিই থাকে না। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকারের কাছে বিএনপি হলো সেই ন্যাড়া, যাকে ছলে-বলে-কৌশলে ভোটতলায় দাঁড় করানো দরকার। যাতে ভোটের ফলের মস্ত বেলটা তার মাথায় ভাঙা যায়। ঠ্যাকাটা এখানে আওয়ামী লীগেরই। ‘মুই ঠ্যাকসি কীসে’ বলার সুযোগ তাদের নেই।

এদিকে আন্তর্জাতিক নজরদারির মধ্যে আগামী জাতীয় নির্বাচনের মহড়া হিসেবে দেখা হচ্ছে সিটি নির্বাচনকে। ২০১৩ সালে এ রকম চারটি সিটি নির্বাচনে বিএনপি জয়ী হওয়ায় বেকায়দায় পড়ে গিয়েছিল আওয়ামী লীগ। ২০১৪ সালের নির্বাচনী কৌশল তারা সেখান থেকেই ঠিক করে; বিএনপির প্রতি এমন কঠোরতা দেখায়, যাতে তারা নির্বাচনেই না আসে। বিএনপি তখন ভুল করেছিল।

এবারের সিটি নির্বাচনে কারচুপির জোরালো অভিযোগ উঠলে বেকায়দায় পড়বে আওয়ামী লীগ। জাতীয় নির্বাচনের নিরপেক্ষতা বিষয়ে বিএনপির অভিযোগ আরও পোক্ত হবে। আবার সুষ্ঠু নির্বাচন হলেও তার ফল আওয়ামী লীগের জন্য সুখকর নাও হতে পারে। সে ক্ষেত্রেও বিএনপি বলতে পারবে, এ জন্য জাতীয় নির্বাচনও সুষ্ঠুভাবে হওয়া দরকার। সিটি নির্বাচনে প্রশাসন যদি নিরপেক্ষ থাকেও, সেটা যে আসলে এই সরকারের অধীনে নির্বাচন করায় বিএনপিকে দেওয়া টোপ– তা বুঝতে কারও বাকি থাকবে না।
বিদ্রোহী+স্বতন্ত্র জুটি এখনও যেমন তখনও তেমন; স্বস্তি দেবে না সরকারকে।

ফারুক ওয়াসিফ: পরিকল্পনা সম্পাদক,
farukwasif0@gmail.com

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.