জুলাই আন্দোলনের শুরু থেকেই শেখ হাসিনার পতনের ছক কষছিলাম: নাজমুল হাসান

0
23
নাজমুল হাসান

গণঅভ্যুত্থানের সময় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক ছিলেন নাজমুল হাসান। স্নাতকে ভর্তির পর থেকেই তাকে আওয়ামী লীগের দমনপীড়নের মুখে পড়তে হয়। নানাভাবে হয়রানি, নির্যাতন, নিপীড়ন ও হামলার কারণে ফ্যাসিবাদী আওয়ামী সরকারের পতনের স্বপ্ন দেখছিলেন তিনি। ফলে জুলাইয়ের আন্দোলন শুরুর পর থেকেই মূলত ছক কষছিলেন শেখ হাসিনার পতনের।

ঢাকা কলেজের গণিত বিভাগের শিক্ষার্থী নাজমুল হাসান ছাত্র অধিকার পরিষদের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন। ২০১৮ সালের বিশ্ববিদ্যালয় শুরুর বছরই কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন। নিরাপদ সড়ক ও ভারতবিরোধী আন্দোলনসহ বিভিন্ন আন্দোলনে গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন তিনি। এতে করে তাকে বারবার হামলা ও মামলার শিকার হতে হয়েছে। তিনি ২০২১ সালে ভারতীয় আগ্রাসন ও আধিপত্য নিয়ে কথা বলতে গিয়ে এবং নরেন্দ্র মোদির আগমনবিরোধী আন্দোলন করায় তাকে ১৮৩ দিন কারাগারে থাকতে হয়।

কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে হাসিনা সরকারের পতনের এক দফা আন্দোলনে নাজমুল হাসান ঢাকা কলেজসহ আশেপাশের এলাকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের নিয়ে শাহবাগ ও সায়েন্সল্যাবে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। তখন সায়েন্সল্যাব ছিল আন্দোলনের অন্যতম স্থান। তার মেধাবী ও সাহসী নেতৃত্ব শিক্ষার্থীদের সুসংগঠিত করে আন্দোলনকে বেগবান করেছিলো। আন্দোলন চলাকালে ৫ আগস্ট সকালে গ্রেপ্তার হয়ে অকথ্য নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন তিনি। গণঅভ্যুত্থানের মুখে ফ্যাসিস্ট হাসিনা পালিয়ে গেলে তিনি মুক্তি পান।
বিজ্ঞাপন

বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থাকে (বাসস) দেওয়া এক একান্ত সাক্ষাৎকারে নাজমুল হাসান তার রাজনৈতিক অভিযাত্রা, নির্যাতনের অভিজ্ঞতা, আন্দোলন ও নেতৃত্বের গল্প তুলে ধরেছেন।

প্রশ্ন: আপনি কীভাবে আন্দোলনে যুক্ত হলেন?

নাজমুল হাসান: বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের নেতৃত্বে ২০১৮ সালে যে কোটা আন্দোলন হয়েছিল তাতে যুক্ত ছিলাম। তারই ধারাবাহিকতায় ২০১৮ সালের অক্টোবর মাসে কোটা বাতিল করা হয় এবং হঠাৎ করেই ২০২৪ সালের ৫ জুন সেই বাতিলকৃত কোটা আবার ফিরে আসে। এমন খবর শুনে তাৎক্ষণিকভাবে আমরা বাংলাদেশ ছাত্র অধিকার পরিষদের ব্যানারে মিছিল নিয়ে ঢাকার দোয়েল চত্বর থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রদক্ষিণ করে টিএসসিতে যাই। পরে ৯ জুন নীলক্ষেত মোড়ে সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের ব্যানারে প্রথম আমি আন্দোলনের নেতৃত্ব দিই। যেটা আমাদের সাত কলেজের প্রথম আন্দোলন। যা নীলক্ষেত মোড়ে শুরু হয়ে ঢাকা কলেজ-সাইন্সল্যাব হয়ে নীলক্ষেতে শেষ হয়। এরপর ধারাবাহিকভাবে আন্দোলন চলতে থাকে।
বিজ্ঞাপন

প্রশ্ন: ৪ জুলাই কোটার বিষয়ে আল্টিমেটামের শেষ দিন ছিল, সেদিনের বিষয়ে কিছু বলুন।

নাজমুল হাসান: আল্টিমেটামের শেষ দিনেও আমার নেতৃত্বে ঢাকা ও ইডেন কলেজের শিক্ষার্থীরা সকাল দশটা থেকে সায়েন্সল্যাবে ব্লকেডে অংশগ্রহণ করে। ওই সময় শাহবাগ বা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি সায়েন্সল্যাবে ব্লকেড ছিল। কারণ তখন আন্দোলনের ক্ষেত্রে সায়েন্সল্যাব ছিল ঢাকার অন্যতম একটা গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট।

ব্লকেড চলাকালে দুপুরের পর হাইকোর্ট ‘নট টু ডে’ বলে আদেশ দিয়েছেন বলে খবর পাওয়া যায়। আমরা সঙ্গে সঙ্গেই সেই রায় ও প্রধান বিচারপতির যে বক্তব্য ছিল তা ছাত্র সমাজের পক্ষ থেকে প্রত্যাখ্যান করেছিলাম। আমরা তাদের কাছে আহ্বান জানিয়েছিলাম, শিক্ষার্থীদের আবেগের জায়গা থেকে শিক্ষার্থীদের প্রতি অবিশ্বাসপূর্ণ আচরণ না করে দ্রুততম সময়ের মধ্যে ২০১৮ সালের যে পরিপত্র ছিল সেটা বহাল রাখার।

প্রশ্ন: ১১ জুলাইয়ের আন্দোলন নিয়ে কিছু বলুন।

নাজমুল হাসান: ১১ তারিখ আমরা দশটা বা এগারোটার দিকে প্রোগ্রামের প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম, তখন খবর পাই কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর প্রক্টরের উপস্থিতিতে বিশ্ববিদ্যালয় এরিয়াতে ঢুকে পুলিশ ও ছাত্রলীগ-যুবলীগের নেতৃত্বে নির্বিচারে হামলা করা হয়। এতে প্রায় অর্ধশতাধিক শিক্ষার্থী আহত হয়। তাৎক্ষণিকভাবে আমাদের পূর্ব ঘোষিত কর্মসূচির অংশ হিসেবে আমরা ঢাকা কলেজের সামনে থেকে মিছিল শুরু করি। মিছিল সায়েন্সল্যাবে যাওয়া মাত্রই নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা বাধা দেয়। পরে আমরা নীলক্ষেতে কর্মসূচি পালন করি।

প্রশ্ন: কোটা সমস্যা সমাধানে রাষ্ট্রপতি বরাবর স্মারকলিপি দেওয়া দরকার এমনটা কেন মনে হয়েছিল?

নাজমুল হাসান: ২০১৮ সালে আন্দোলনের পর কোটা বাতিল হয়েছিল। ২০২৪ সালে আবারও হঠাৎ করে সেই কোটা ফিরে আসায় শিক্ষার্থীদের মাঝে আবার ক্ষোভ তৈরি হয়েছিল। আমরা যদি এখন আন্দোলন করে কোটা বাতিল করি শেখ হাসিনা চাইলে আবার সেই কোটা ফিরিয়ে আনতে পারে। রাষ্ট্রের প্রধান হিসেবে তিনি যেন কোটার বিষয়ে হস্তক্ষেপ করেন। রাষ্ট্রপতি দ্রুততম সময়ের মধ্যে কোটার যৌক্তিক সমাধানের লক্ষ্যে একটি আদেশ জারি করে কোটার স্থায়ী সমাধান করবেন। পাশাপাশি সংসদে আইন করে কোটা ব্যবস্থা তুলে দেওয়ার দাবি জানাতেই মূলত সেদিন আমরা রাষ্ট্রপতি বরাবর স্মারকলিপি দিয়েছিলাম।

সেদিন পুরো ঢাকা শহর একদম শিক্ষার্থীদের নগরীতে পরিণত হয়েছিল। রাজধানীর প্রতিটি অলি-গলিতে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি ছিল। আমরা ঢাকা কলেজ থেকে চার থেকে পাঁচ হাজার শিক্ষার্থী সাইন্সল্যাব থেকে মিছিল নিয়ে স্মারকলিপি কর্মসূচিতে যোগ দিয়েছিলাম।

প্রশ্ন: ১৪ জুলাই শেখ হাসিনা প্রেস কনফারেন্সে শিক্ষার্থীদের রাজাকার বলে সম্বোধন করেন। এর প্রতিবাদে আপনারা সরব হয়েছিলেন। এটা নিয়ে কিছু বলুন।

নাজমুল হাসান: শেখ হাসিনা শিক্ষার্থীদের রাজাকার বলে সম্বোধন করায় সারাদেশের শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদে ফেটে পড়ে। এর প্রতিবাদে তুমি কে? আমি কে? রাজাকার, রাজাকার। কে বলেছে, কে বলেছে। স্বৈরাচার স্বৈরাচার। এমন নানা স্লোগানে সেদিন আমরা প্রতিবাদ করেছিলাম। যারা আন্দোলন করেছিল তারা সবাই ৭১-এর পর জন্মগ্রহণ করেছে। এই আন্দোলনে কেউ রাজাকার ছিল না। বিগত সময়ে দেখেছি কোন যৌক্তিক আন্দোলন করলেই তাদের রাজাকার বা বিভিন্ন ট্যাগিং করে আন্দোলন বানচাল করা হতো। এই ট্যাবু ভাঙার জন্যই মূলত আমরা সেদিন প্রতিবাদ করেছিলাম।

প্রশ্ন: ১৫ জুলাই ঢাবিতে শিক্ষার্থীদের ওপর যে হামলা হয় তখন আপনি কোথায় কীভাবে কাজ করেছেন?

নাজমুল হাসান: ধারাবাহিক আন্দোলনের অংশ হিসেবে আমরা ১৫ জুলাই ঢাকা কলেজের সামনে দাঁড়ালে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে কলেজের ভেতরে অবস্থান নেয়। পরে খবর আসে ইডেন কলেজের শিক্ষার্থীদের ক্যাম্পাসে অবরুদ্ধ করে রেখেছে ছাত্রলীগ। আমরা তাদের মুক্ত করি এবং দুপুরে টিএসসিতে যোগ দিই। রাজুতে আসার পর খবর পাই আমাদের কিছু শিক্ষার্থী বন্ধুদের ঢাবির হল পাড়ায় ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা আটকে রেখেছে। অবরুদ্ধ অবস্থা থেকে তাদেরকে মুক্ত করতে গেলে হলপাড়ায় ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা হামলা চালায়।

পরবর্তীতে হল থেকে বের হয়ে ভিসি চত্বরে আসলে হঠাৎ করেই ছাত্রলীগের মহানগর উত্তর-দক্ষিণ ও ঢাকা কলেজের সন্ত্রাসীরা আমাদের ওপর হামলা চালায়। রাস্তায় ফেলে উপর্যুপরি মারধর করে। সেদিন তারা হাসপাতালে গিয়েও হামলা করেছিল। নারী শিক্ষার্থীদেরও তারা ছাড় দেয় নি। আমিও সেই হামলায় আহত হয়েছিলাম।

প্রশ্ন: হামলায় আহত হওয়ার পর আন্দোলনগুলো কীভাবে এগিয়ে নিলেন?

নাজমুল হাসান: ১৫ তারিখের হামলায় আহত হয়ে প্রায় ৩-৪ দিন হাসপাতালে ছিলাম। ওই সময় পরামর্শ দিতাম কীভাবে সায়েন্সল্যাব ব্লক করা যায়। কীভাবে আন্দোলনে আরও শিক্ষার্থীদের যুক্ত করা যায়। ১৬ তারিখ ছাত্রলীগ ঢাকা কলেজের এক শিক্ষার্থীকে কৌশলে হত্যা করে শিক্ষার্থীদের ওপর দায় চাপায়। আমি হাসপাতালে থাকা অবস্থায় আমাকে সেই মামলায় আসামি করা হয়। আমার পরিবারকে বিভিন্নভাবে হুমকি-ধমকি দেওয়া শুরু করে। আন্দোলনে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীদেরও ছাত্রলীগ নানাভাবে হুমকি দিতে থাকে।

প্রশ্ন: কোনো সমন্বয়ক যদি আন্দোলনে না থাকতে পারে তখন কীভাবে আন্দোলন চালানোর পরিকল্পনা ছিল?

নাজমুল হাসান: আমাদের পরিকল্পনা ছিল কেউ যদি সরে যায় বা ভিন্ন বক্তব্য দেয় বা আহত-নিহত হয় তাহলে অন্যরা নেতৃত্ব দেবে। তবে কোনোভাবেই আন্দোলন শেষ করার সুযোগ ছিল না। আমাদেরকে সে সময় সবাই সহযোগিতা করেছিল। ‘আমাদের আন্দোলন চলবে এবং মাঠে যারা আছে তাদের সঙ্গে আলোচনা করে গতিপথ এগিয়ে নিতে হবে’ নাহিদ ভাই হাসপাতালে থাকাকালীন এক নার্সের মাধ্যমে এমন একটি বার্তা আমাকে দিয়ে দিয়েছিলেন। সেই সময় হান্নান মাসউদ, রিফাত রশিদ ও আব্দুল কাদের আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নিতেন।

প্রশ্ন: ২১ তারিখে কোটা বাতিল করা হলে আপনাদের কি মনে হয়েছিল আন্দোলন শেষ করার সময় এসেছে?

নাজমুল হাসান: আমরা দেখেছি নাহিদ ইসলামসহ অন্যদের কিভাবে নির্যাতন করা হয়েছিল। সারা দেশে ততদিনে কয়েকশ’ লাশ দেখেছি। ফলে তখন এই আন্দোলন আর কোটা সংস্কার নয় বরং রাষ্ট্র সংস্কারের আন্দোলনে পরিণত হয়েছিল। এই আন্দোলন ছিল কোটার পাশাপাশি রাষ্ট্র সংস্কারের। কারণ রাষ্ট্রের প্রতিটি রন্ধ্রে রন্ধ্রে তখন দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়েছিল। এই আন্দোলনে অভিভাবক সমাজ, রিকশাশ্রমিক, ফেরিওয়ালা, পোশাক শ্রমিক থেকে সকল শ্রেণি-পেশার মানুষ শামিল ছিলেন। আমরা শুরু থেকেই শেখ হাসিনার পতনের আন্দোলনের ছক কষছিলাম। একটা সময়ের অপেক্ষা করছিলাম। ১৯ জুলাই রাতে অপরিচিত মোবাইল নম্বর থেকে ফোন দিয়ে নুর ভাই আমাকে জানায়, ‘এখনই তোমাদের উচিত কোটা থেকে রাষ্ট্র সংস্কারের আন্দোলনের ডাক দেওয়া, শেখ হাসিনার পতনের জন্য আন্দোলন করা। অন্য সমন্বয়করা একমত না হলেও তুমি যেন শেখ হাসিনার পতনের আন্দোলনের ডাক দাও।’

প্রশ্ন: ২৩ জুলাই কোটা বাতিলের প্রজ্ঞাপন হলেও কেন আন্দোলন শেষ করেননি?

নাজমুল হাসান: আমাদের দাবি ছিল কোটা সংস্কার করা। কিন্তু সেটা না করে আমাদের রাজাকার সম্মোধন করা, ড্রাগ এডিকটেড বলে তিরস্কার করা, ছাত্রলীগ-যুবলীগ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে শিক্ষার্থীদের হত্যা করা, মিথ্যা মামলা দিয়ে দমন-নিপীড়ন করায় আমরা তখন সেই প্রজ্ঞাপন ছুড়ে ফেলে এক দফার দিকে এগিয়ে যেতে থাকি।

প্রশ্ন: শত শত শিক্ষার্থীর লাশকে উপেক্ষা করে শেখ হাসিনার মেট্রো পরিদর্শন করে কান্নায় ভেঙে পড়ার বিষয়টি কিভাবে দেখেছিলেন?

নাজমুল হাসান: আমরা যখনই শেখ হাসিনার কোনো বক্তব্য শুনতাম তখনই এনার্জেটিক হতাম। তার কথা শুনলে মনে হত আজকেই যুদ্ধ করব। শেখ হাসিনার পতনের জন্য আন্দোলন করব। তিনি প্রতিটি ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের চেয়ে জড় বস্তু (মেট্রো, সেতু ভবন) নিয়ে মায়াকান্না করতেন। স্বজন হারানোর বেদনা আমার থেকে আর কে বেশি বুঝবে এসব ডায়ালগ দিতেন। স্বজন হারানোর বেদনার কথা বলতেন আর পুলিশ দিয়ে আন্দোলনকারীদের হত্যা করতেন। এমনকি তার নির্দেশে নিরস্ত্র আবু সাঈদকে খুব কাছ থেকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল।

প্রশ্ন: ইন্টারনেট বন্ধ থাকাকালীন আপনারা কিভাবে যোগাযোগ করেছিলেন?

নাজমুল হাসান: বাটন ফোন এবং অন্যের সিম ব্যবহার করতাম। এসময় ফোনকল ও মেসেজে কথা বলতাম। মেসেজ অন্য কেউ যেন বুঝতে না পারে তাই গভ: হলে জি, পুলিশ হলে পি কোড ব্যবহার করে যোগাযোগ করতাম।

সে সময় গ্রেপ্তার আতঙ্ক নিয়ে বাইরে বের হতাম। চোখ বন্ধ করলেই ৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের মতো অবস্থা মনে হত। ছাত্রলীগ তখন রাজাকারের ন্যায় আর পুলিশ হানাদার বাহিনীর মতো ছিল।

প্রশ্ন: পাঁচ সমন্বয়ক যখন আন্দোলন বন্ধের ঘোষণা দিলেন কেন আপনারা তা প্রত্যাখান করলেন?

নাজমুল হাসান: ২৮ জুলাই ডিবি হারুন তাদের তুলে নিয়ে গিয়ে জোর করে আন্দোলন বন্ধের ঘোষণা দেয়। আমরা বলেছিলাম জিম্মি অবস্থায় দেওয়া কোনো ব্যক্তির কথায় কোনো আন্দোলন বন্ধ হবে না। তারা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সর্বোচ্চ নেতা ছিলেন। তারা আন্দোলন বন্ধের ঘোষণা দিলেও এদেশের শিক্ষার্থী ও মুক্তিকামী জনতা তা মেনে না নিয়ে আন্দোলন চালিয়ে যেতে থাকে।

প্রশ্ন: প্রোফাইল লাল করার ও মার্চ ফর জাস্টিস বিষয়ে কিছু বলুন।

নাজমুল হাসান: আন্দোলনে শহীদদের ধারণ করেই মূলত ফেসবুক প্রোফাইল লাল ও মুখে লাল কাপড় বেঁধে প্রতিবাদ করেছিলাম। আন্দোলনটি আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য করতেই মূলত মার্চ ফর জাস্টিস কর্মসূচি পালন করা হয়েছিল। বিশ্ববাসী যেন জানতে পারে যে, ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ছাত্র বিপ্লবে কিভাবে দমনপীড়ন চালানো হচ্ছিল ।

প্রশ্ন: ৩ আগস্ট শহীদ মিনারে দেওয়া এক দফার ঘোষণা বিষয়ে কিছু বলুন।

নাজমুল হাসান: সেদিন সায়েন্সল্যাব থেকে বিশাল মিছিল নিয়ে শহীদ মিনারে যাই। ঢাবি প্রাঙ্গন ছিল স্লোগানে মুখর। ঢল নেমেছিল মুক্তিকামী জনতার। সেখানে ছাত্র-জনতার বহুল কাঙ্ক্ষিত একদফা ঘোষণা করা হয়। একদফা ঘোষণার পর আমরা মিছিল নিয়ে শাহবাগে সন্ধ্যা পর্যন্ত কর্মসূচি পালন করি।

প্রশ্ন: ৫ আগস্ট হাসিনার পতন ও বিজয়ের স্মৃতি নিয়ে কিছু বলুন।

নাজমুল হাসান: ৫ আগস্ট আমি কারফিউের মধ্যে সায়েন্সল্যাবে ঢুকতে ব্যর্থ হয়ে হাজারীবাগ হয়ে নীলক্ষেত চলে আসি। এরপর রিকশা দিয়ে আমার কয়েকজন সহযোদ্ধাকে নিয়ে শহীদ মিনারের দিকে এগোতে থাকি। ঢাকা মেডিকেল এবং বকশীবাজারের মাঝখানের মোড়ে আমি ও ইশা (ইসলামি শাসনতন্ত্র) ছাত্র আন্দোলন ঢাকা কলেজের রেদোয়ান গ্রেপ্তার হই। আমাদেরকে পুলিশের গাড়িতে করে টিএসসি হয়ে শাহবাগ থানায় নেওয়া হয়। তখন আনুমানিক সকাল ৯টার দিকে শহীদ মিনারসহ ঢাবি এলাকা থেকে গুলির আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিলাম। থানায় নেওয়ার পর পরই আমাদের মেঝেতে শুইয়ে শরীরের প্রতিটি অংশে উপর্যপুরি কিল-ঘুষি মারতে থাকে। আমার চশমা ভেঙে ফেলে। এমনকি পায়ের বুট দিয়ে লাথি দিতে দিতে অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করতে থাকে। তোরা সমন্বয়করা অনেক বেড়ে গেছিস। ছয় জনকে নিয়ে গিয়েছিলাম। শেখ হাসিনা তোদেরকে মায়া দেখাচ্ছে। শেখ হাসিনা দেশের এতো উন্নয়ন করছেন তাও তার বিরুদ্ধে আন্দোলন করিস। এভাবে প্রায় ৫ মিনিটের বেশি নির্যাতন করা হয়। পরে দুপুর ১২ টার দিকে তৎকালীন শাহবাগ থানার ওসি (অপারেশন) আরশাদ আমাকে ক্রসফায়ারের হুমকি দেয়। এর কিছুক্ষণ পর আমাদের মিন্টো রোডে সিটিটিসিতে নিয়ে যায়। আমি খুব কষ্ট পাচ্ছিলাম এই ভেবে যে, প্রত্যেকটি আন্দোলন যেভাবে দমন করে এইবারও শেখ হাসিনা একইভাবে দমন করবে। অসংখ্য মা-বোন আন্দোলনের সঙ্গে সামিল হয়েছিলেন। তারা আন্দোলনে আমাদেরকে পানি খাওয়াতেন, আমাদের সেফটি হিসেবে কাজ করতেন। তাদের ত্যাগ কি এবারও বৃথা যাবে।

ওরা আমার বুকেও আঘাত করে। তাদেরকে কয়েকদফা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার কথা বলেছিলাম। তখনও তারা উগ্র আচরণ করছিল। সেই সকাল থেকে তারা আমাদের একটু পানিও খেতে দেয়নি। বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে তাদের আচরণে নমনীয়তা আসতে থাকে। এর কিছুক্ষণ পর তারা আমাদের ছেড়ে দিয়ে মাফ চাইতে থাকে। তখন সিটিটিসির অফিস প্রায় পুলিশশূন্য হয়ে পড়ে।

বাইরে এসে আমরা উত্তেজিত জনতার সঙ্গে কথা বলি। কোনোভাবেই যেন এখানে আক্রমণ না করে সেজন্য তাদের বোঝাতে থাকি। পরে পরিবার ও সহযোদ্ধাদের সঙ্গে যোগাযোগ করি। এরপর সংবাদ সম্মেলনের জন্য চ্যানেল ২৪-এর অফিসে যাই।

 

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.