জীবন দিয়ে আজাদুল বাঁচিয়ে গেলেন ১০ শ্রমিকের জীবন

ট্রাকচাপায় নিরাপত্তাকর্মী নিহত

0
107
ট্রাকচাপায় নিহত আজাদুল ইসলাম

শীতের কুয়াশা তখনও কাটেনি। সকালের শিফটে কাজে যোগ দিতে আসা শ্রমিকদের নিরাপদে মহাসড়ক পারাপার নিশ্চিত করতে সড়কের পাশে লাল নিশানা নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন নিরাপত্তাকর্মী আজাদুল ইসলাম (৩৫)। তার সঙ্গে ছিলেন আরও দুই নিরাপত্তাকর্মী। ফোরলেন সড়কের ডিভাইডারের দক্ষিণ পাশে হুমায়ুন কবীরসহ দুই নিরাপত্তাকর্মীও লাল নিশানা নিয়ে চলন্ত যানবাহন থামিয়ে শ্রমিকদের সড়ক পারপার নিশ্চিত করছিলেন। এরই মধ্যে সকাল পৌনে ৮টার দিকে ১৫-২০ জন শ্রমিক সড়ক অতিক্রমকালে উত্তরবঙ্গ থেকে ঢাকাগামী একটি পাথরভর্তি ট্রাক দ্রুতগতিতে আসছিল। নিরাপত্তাকর্মী আজাদুল বিষয়টি লক্ষ্য করে সড়কের মাঝে গিয়ে হাতে থাকা লাল নিশানা দিয়ে ট্রাকচালককে থামানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু ট্রাকচালক গতি নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে আজাদুলের ওপর দিয়েই ট্রাকটি চালিয়ে দেয়। এতে আজাদুল ঘটনাস্থলেই নিহত হন। এ সময় আরও তিন নারী শ্রমিক আহত হয়।

গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার চন্দ্রাস্থ মাহমুদ জিন্স কারখানার সামনে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে আজ রোববার সকালে এমন মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে।

এ খবর মাহমুদ জিন্স কারখানার শ্রমিকদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়লে শত শত শ্রমিক লাঠিশোঠা নিয়ে সড়কে থাকা শতাধিক যানবাহন ভাঙচুর করেন। এ সময় পাথরবোঝাই ট্রাকটিতে অগুন ধরিয়ে দেন বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা। এ ছাড়াও ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের দুইপাশ অবরোধ করে বিক্ষোভ করতে থাকেন তারা।

নিহত আজাদুল গাইবান্দার গোবিন্দগঞ্জ থানার গোয়ালপাড়া গ্রামের মৃত বাবর আলীর ছেলে। দুই ভাই এবং তিন বোনের মধ্যে আজাদুল সবার ছোট। আজাদুল চন্দ্রাস্থ ডাইনকিনি এলাকায় একটি কক্ষ ভাড়া নিয়ে একাই থাকতেন। স্ত্রী মিনারা বেগমের সঙ্গে ৫-৬ বছর আগে আজাদুলের ডিভোর্স হয়। তারপর আর বিয়ে করেননি তিনি।

মহাসড়ক অবরোধ করে শ্রমিকদের বিক্ষোভ

আজাদুলের বড় ভাই আইয়ুব হোসেন বলেন, আমার ছোটভাই দীর্ঘ ৬-৭ বছর ধরে এই কারখানায় নিরাপত্তাকর্মীর চাকরি করত। সে প্রত্যেক মাসেই মায়ের ভরণপোষনের বাড়িতে টাকা পাঠাত।

শ্রমিকদের সড়ক পার করানোর দায়িত্বে থাকা নিরাপত্তাকর্মী হুমায়ুন কবীর জানান, ১০-১২ জন শ্রমিকের জীবন বাঁচাতে আজাদুল ইসলাম নিজেই জীবন দিয়ে দিলেন। ওই সময় আজাদুল লাল নিশানা নিয়ে ট্রাকের সামনে না দাঁড়ালে অন্তত ১০-১২ জন শ্রমিক নিহত হত।

প্রত্যক্ষদর্শী, কারখানার শ্রমিক ও পুলিশ জানায়, ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের চন্দ্রা এলাকায় মাহমুদ জিন্স কারখানার সামনে সকাল পৌনে ৮টার দিকে মহাসড়ক অতিক্রম করার জন্য শ্রমিকরা ফোরলেন সড়কের দক্ষিণ পাশে জড়ো হয়। এ সময় ওই কারখানার নিরাপত্তাকর্মী হুমায়ুনর কবীরসহ দুজন মহাসড়কের দক্ষিণ পাশে এবং আজাদুল সড়কের উত্তর পাশে লাল নিশানা নিয়ে দাঁড়িয়ে চলন্ত যানবাহন থামিয়ে শ্রমিকদের সড়ক অতিক্রম করাতে থাকেন। এমন সময় উত্তরবঙ্গ একটি পাথরভর্তি ট্রাক (ঢাকা মেট্রো ট-১১-৭৩১৫) ঢাকার দিকে যাচ্ছিল। এ সময় সময় নারী-পুরুষসহ প্রায় ১০-১২ জন শ্রমিক সড়ক অতিক্রম করার জন্য সড়কের মাঝে চলে আসে। আজাদুল বিষয়টি দেখতে পেয়ে ট্রাকটিকে থামাতে লাল নিশানা নিয়ে সড়কের মাঝে গিয়ে দাঁড়ান। এদিকে ট্রাকচালক ট্রাকটি না থামিয়ে আজাদুলকে চাপা দেয়। ট্রাকচাপায় কারখানার নিরাপত্তাকর্মী আজাদুল ঘটনাস্থলেই নিহত এবং আরও তিন শ্রমিক আহত হয়। আহতদের উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠানো হয়।

ঘটনার পরপরই কারখানার শ্রমিকরা ক্ষিপ্ত হয়ে ট্রাকটিতে আগুন ধরিয়ে দেয়। পাশাপাশি ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করতে থাকেন শ্রমিকরা। এতে এই মহাসড়কে যানবাহন চলাচল পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। এর ফলে চন্দ্রা থেকে গাজীপুর বাইপাস সড়কের সফিপুর, কালিয়াকৈর-নবীনগর সড়কে জিরানী এবং টাঙ্গাইলের গোড়াই পর্যন্ত প্রায় ২০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে তীব্র যানজট সৃষ্টি হয়। এ সময় নারী, শিশু, বয়স্ক ও রোগীদের অভাবনীয় দুর্ভোগ পোহাতে হয়।

ঘটনার পরপরই বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা ট্রাকে আগুন ধরিয়ে দেয়

দীর্ঘ চার ঘণ্টা যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও পৌরসভার মেয়র মজিবুর রহমানসহ স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ঘটনাস্থলে গিয়ে নিহত শ্রমিকের পরিবারকে চার লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ, আহতদের সুচিকিৎসা এবং ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণ করার প্রতিশ্রুতি দিলে শ্রমিকরা অবরোধ তুলে নেয়। পরে সকাল সাড়ে ১১টার দিকে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক হয়।

মাহমুদ জিন্স কারখানার শ্রমিকরা জানান, প্রতিদিনই সড়ক দুর্ঘটনায় শ্রমিকরা মারা যাচ্ছে। আমাদের একজন নিরাপত্তাকর্মী আজ সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন। আমরা সরকারের কাছে একটি ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণের দাবি জানাই।

মাহমুদ জিন্স কারখানার ডিজিএম রফিকুল ইসলাম বলেন, কারখানার পক্ষ থেকে নিহত শ্রমিকের লাশ তার গ্রামের বাড়ি পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। কারখানার নিয়ম অনুযায়ী তার পাওনা পরিশোধ করে দেওয়া হবে।

গাজীপুর শিল্প পুলিশ-১ এর অফিসার ইনচার্জ ওসি নিতাই চন্দ্র সরকার জানান, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে এসে শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলেছেন। তাদের আশ্বাসে শ্রমিকরা অবরোধ তুলে নেওয়ায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এসেছে এবং যান চলাচল স্বাভাবিক হয়েছে।

সালনা কোনাবাড়ী হাইওয়ে থানার ওসি আতিকুল ইসলাম জানান, শ্রমিকদের বুঝিয়ে সড়ক থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। ঘাতক ট্রাকটিকে আটক করা হয়েছে।

কালিয়াকৈর থানার ওসি আকবর আলী খান জানান, শ্রমিকদের আশ্বস্ত করায় তারা অবরোধ তুলে নিয়েছে। বর্তমানে পরিস্থিতি শান্ত রয়েছে। নিহতের লাশ তার দেশের বাড়ি পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে।

এম তুষারী, কালিয়াকৈর

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.