
২০১৪ বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে জার্মানির কাছে ৭-১ গোলে হারের ক্ষত ব্রাজিলের জন্য এখনো জাতীয় ট্র্যাজেডি। ‘মারাকানা ট্র্যাজেডি’র মতোই এই হার ব্রাজিলিয়ানদের জীবনে এক গভীর বেদনার প্রতীক। স্মৃতির ভেলায় ভেসে সেই ম্যাচটা ফিরে দেখা।
‘প্রতিটি দেশের অপূরণীয় জাতীয় বিপর্যয় আছে। এমন কিছু, যাকে আপনি তুলনা করতে পারেন হিরোশিমার সঙ্গে। আমাদের সেই বিপর্যয়, সেই হিরোশিমা হচ্ছে ১৯৫০ বিশ্বকাপের ফাইনালে উরুগুয়ের বিপক্ষে হার’—মারাকানা ট্র্যাজেডি ব্রাজিলিয়ানদের জীবনকে কতটা প্রভাবিত করেছিল, সে বিষয়ে কথাগুলো বলেছিলেন বিখ্যাত ব্রাজিলিয়ান সাহিত্যিক নেলসন রদ্রিগেজ।
২০১৪ সালে দ্বিতীয় ‘মারাকানাজো’ আসার আগপর্যন্ত সেটিই ছিল ব্রাজিলিয়ানদের জাতীয় জীবনের সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি। কে জানত, ৬৪ বছর পর সেই একই অনুভূতি ভিন্ন মোড়কে হাজির হবে ব্রাজিলিয়ানদের জীবনে। আর নতুন এই ক্ষত বহু অর্জনে প্রলেপ পড়তে থাকা সেই পুরোনো ক্ষতকে আবার নতুন করে খুঁচিয়ে তুলবে!
শুধু ব্রাজিলিয়ানদেরই নয়, বিশ্বজুড়ে ব্রাজিলের ভক্ত-সমর্থকদের জন্যও সেই ঘটনা এখনো বিভীষিকার মতো। এখনো অনেকে সেই ঘটনার ভয়াবহতা ভুলতে পারেননি। এখনো অনেকের ঘুমে দুঃস্বপ্নের মতো হয়তো হানা দেয় সেই দিনটি। প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলোর ভক্তরাও বারবার এই দুর্বল জায়গায় আঘাত করে ক্ষতস্থানকে সব সময় তাজা রাখে। এ যেন বিশ্বখ্যাত চিত্রশিল্পী ভ্যান গঘের মৃত্যুর আগমুহূর্তে উচ্চারিত সেই কথাটির মতো, ‘স্যাডনেস উইল লাস্ট ফরএভার।’ হ্যাঁ, ব্রাজিল সমর্থকদের জন্যও এই হারের বেদনা চিরন্তন।
কী ঘটেছিল সেই দিন
২০১৪ সালের ৮ জুলাই। বেলো হরিজেন্তের স্তাদিও মিনেইরাও ঘিরে সাজসাজ রব। বিশ্বকাপের প্রথম সেমিফাইনালে মুখোমুখি ব্রাজিল-জার্মানি। স্বাগতিক হওয়ায় সেদিন অনেকেই ব্রাজিলকে জার্মানির চেয়ে এগিয়ে রেখেছিল। তার ওপর ঘরের মাঠে প্রতিযোগিতামূলক ম্যাচে তখন ৩৯ বছর ধরে অপরাজিত ব্রাজিল। ফলে ব্রাজিলের আত্মবিশ্বাসের পারদটা ঊর্ধ্বগামী। তবে সংশয়ও কম ছিল না। বিশেষ করে নেইমার ও থিয়াগো সিলভাবিহীন ব্রাজিল আদৌ জার্মান-চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে পারবে কি না, তা নিয়ে ভয় ছিল অনেক ব্রাজিল সমর্থকেরই।

রেফারি ম্যাচ শুরুর বাঁশি বাজানোর আগে থেকেই ৫৮ হাজারের বেশি দর্শকের চিৎকারে প্রকম্পিত হয়ে উঠেছিল গোটা স্টেডিয়াম। প্রথম কয়েক মিনিট দুই দলেই খেলেছে সমানে-সমানে। ব্রাজিল চেষ্টা করছিল আক্রমণে ওঠার। কিন্তু ১১ মিনিটে জার্মানি পেয়ে যায় প্রথম গোল। কর্নার থেকে বল পেয়ে জার্মানিকে এগিয়ে দেন টমাস মুলার। তখন পর্যন্ত সব স্বাভাবিকই মনে হচ্ছিল। শুরুতে গোল খেলেই তো আর সব শেষ নয়। ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য ব্রাজিলের হাতে তখনো অনেক সময়।
কিন্তু সব হিসাব-নিকাশ, পরিসংখ্যান বা পরিকল্পনা ওলটপালট হয়ে যায় ২৩ থেকে ২৯ মিনিটের মধ্যে। এই ৬ মিনিটের মধ্যে ব্রাজিল হজম করে চার গোল অর্থাৎ ৩০ মিনিট পেরোনোর আগেই ব্রাজিল পিছিয়ে পড়ে ৫-০ গোলে।
গোলগুলো এত কম সময়ের ব্যবধানে হয়েছে যে টেলিভিশনের সামনে বসে থাকা অনেকে ভেবেছিলেন আগের গোলের হাইলাইটস দেখানো হচ্ছে। কিন্তু সংবিৎ ফিরতেই তাঁরা বুঝেছেন, এটা হাইলাইটস নয়, নয় কোনো দুঃস্বপ্নও। যা ঘটছে সবটাই বাস্তব। দেখে মনে হচ্ছিল, মাঠে শুধু জার্মানিই খেলছে। ব্রাজিলের ১১ জন ফুটবলার বিবশ ও নিথর।

গ্যালারিতে ব্রাজিলিয়ান সমর্থক যাঁরা খেলা দেখছিলেন, তাঁদের জন্য বিষয়টি ছিল একের পর এক বোমাবর্ষণের মতো। মাঠে কী ঘটছে, কেউ কিছুই বুঝে উঠতে পরছিলেন না। এই ঘটনা কি আদৌ বাস্তবে ঘটছে, নাকি স্বপ্নদৃশ্য, তা উপলব্ধি করতেও অনেকের কিছুটা সময় লেগেছে। তবে যাঁরা বুঝতে পেরেছেন, সবার চোখ ছিল কান্নাভেজা। ব্রাজিল এবং বিশ্বজুড়ে ব্রাজিলের কোটি সমর্থকের সেই অশ্রুজলে রাগ, ক্ষোভ, অবিশ্বাস, বিস্ময় এবং স্তব্ধতা সবই একসঙ্গে মিলেমিশে ছিল। এই লজ্জা ও যন্ত্রণার যে কোনো তুলনাই হয় না!
সেদিন শেষ পর্যন্ত ব্রাজিল হেরেছিল ৭-১ গোলে। দ্বিতীয়ার্ধে জার্মানি একই গতি ও তীব্রতা নিয়ে খেললে ব্রাজিলের হারের লজ্জা আরও বড় হতে পারত। ম্যাচের পর জার্মান ডিফেন্ডার ম্যাট হুমেলস বলেছিলেন, ‘আমরা দ্বিতীয়ার্ধে ব্রাজিলকে অসম্মান না করা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম।’
ম্যাচের ফল ব্রাজিলকে তো বটেই, বিস্মিত করেছিল জার্মান কোচ ইওয়াখিম ল্যোভকেও। তিনিও বলেছিলেন, ‘আমরাও স্তম্বিত এবং অভিজ্ঞতা ২০০৬ সালের মতোই (২০০৬ বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে অতিরিক্ত সময়ের শেষ মুহূর্তে ইতালির কাছে দুই গোল খেয়ে হেরেছিল জার্মানি। সেই ম্যাচে ইয়ুর্গেন ক্লিন্সম্যানের সহকারী ছিলেন লো)।’
আর ব্রাজিল কোচ লুইস ফিলিপ স্কলারি ওই দিনটাকে তাঁর জীবনের সবচেয়ে খারাপ দিন বলে উল্লেখ করেছিলেন। ব্রাজিলের ২০০২ বিশ্বকাপ জয়ের নায়ক সেদিন হয়ে যান খলনায়ক। বলেছিলেন, ‘এটা আমার জীবনের সবচেয়ে খারাপ দিন। আমি সম্পূর্ণ দায় নিচ্ছি।’ ম্যাচ শেষে কাঁদতে কাঁদতে জাতির উদ্দেশে ক্ষমা চেয়েছিলেন অধিনায়ক ডেভিড লুইজ। সেদিন দলে না থাকা নেইমার ও সিলভার হতভম্ব অভিব্যক্তি ছাপা হয়েছিল ব্রাজিলের অনেক পত্রিকায়! ব্রাজিলিয়ান সংবাদপত্র ‘ও গ্লোবো’ সেই ম্যাচের খবর প্রথম পাতায় দিয়ে শিরোনাম দিয়েছিল, ‘লজ্জা, গ্লানি এবং অপমান।’ তারা ব্রাজিলের প্রত্যেক খেলোয়াড়কে সেদিন শূন্য রেটিং দিয়েছিল।

ব্রাজিলিয়ান স্ট্রাইকার ফ্রেডের বাড়িই ছিল বেলো হরিজেন্তে এলাকাতেই। ম্যাচ শেষে তিনি বলেছিলেন, ‘ম্যাচ শেষ হওয়ার পর আমি একটা গর্তে লুকিয়ে যেতে চেয়েছিলাম। যেখান থেকে আর কখনোই ফিরে আসতে হবে না।’
সেই হারের যন্ত্রণা খুব কাছ থেকে যিনি উপলব্ধি করেছিলেন, তিনি গোলরক্ষক হুলিও সিজার। তাঁকে ফাঁকি দিয়েই একে একে সাতবার বল জড়িয়েছিল জালে। অনেক পরে এই ম্যাচ নিয়ে তাঁর বলা কথাগুলো যেন মনে করিয়ে দিচ্ছে ভ্যান গঘের মৃত্যুকালীন সময়ের সেই কথাটিকে। সিজার বলেছিলেন, ‘এখনো যখন আমি শুয়ে থাকি, অনিবার্যভাবে ম্যাচটি নিয়ে চিন্তা করি। আমি কল্পনা করি সেই দিনটির কথা, বহু বছর পর যেদিন সংবাদমাধ্যমে ঘোষণা হবে: “হুলিও সিজার, ৭ গোল খাওয়া গোলরক্ষক মারা গেছেন।”’
হাসনাত শোয়েব
ঢাকা