জিরাফ দেখতে বহু মানুষের ভিড়। শিশু–কিশোরদের সঙ্গে আছে তাদের অভিভাবকেরাও। এর মধ্যে একজন দর্শনার্থী আরেকজনকে বিস্ময় নিয়ে বলছিলেন, ‘জিরাফ দেখতে…ল্যাহান (মতো) দেহা যায়।’
যে ব্যক্তি এ কথা বলছিলেন, তাঁর নাম আনোয়ার হোসেন। তিনি যাঁকে বলছিলেন, তাঁর নাম মো. কবির হোসেন। দুজনই শরীয়তপুরের জাজিরা এলাকার একটি ইটভাটায় কাজ করেন। জীবনে প্রথমবারের মতো তাঁরা চিড়িয়াখানায় এসেছেন। আনোয়ার জানান, জীবনে প্রথমবারের মতো আজই তাঁরা জিরাফ দেখলেন।
এই দুজনের গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জে। তাঁরা ঈদ উপলক্ষে দুদিনের ছুটি পেয়েছেন। দুদিনের ছুটিতে গ্রামে যাওয়া পোষায় না, তাই ঈদে যাননি। কবির জানান, ঈদের দিন ইটভাটাতেই কাটিয়েছেন। আজ চিড়িয়াখানায় ঘুরতে এলেন। চিড়িয়াখানায় এত পশুপাখি!
ঈদের দ্বিতীয় দিন আজ রোববার জাতীয় চিড়িয়াখানায় ঢাকা, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জসহ বিভিন্ন জেলা থেকে মানুষ এসেছেন। ঢাকা ও আশপাশ জেলার যাঁরা কর্মস্থল ছেড়ে ঈদ করতে গ্রামে বা অন্য জেলায় যাননি, তাঁরা অনেকেই এসেছেন। কর্তৃপক্ষ বলছে, চিড়িয়াখানায় আজ প্রায় দুই লাখ দর্শনার্থীর আগমন ঘটেছে।
বাঘ, সিংহ, হাতি, ময়ূর, জিরাফ, জেব্রা, হায়েনা, বানর, উটপাখি, পেলিক্যানসহ ১৩১ প্রজাতির ৩ হাজার ৩৪০টি পশুপাখি রয়েছে এই চিড়িয়াখানায়। বিশ্বের প্রায় সব অঞ্চলের পশুপাখিই রয়েছে এখানে। তার মধ্যে এশিয়া ও আফ্রিকা অঞ্চলের পশুপাখির সংখ্যা বেশি বলেও জানিয়েছে চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ।
জাতীয় চিড়িয়াখানার নিয়ন্ত্রণে এখন প্রায় ১৮৭ একর জমি রয়েছে। এখানে পশুপাখি ছাড়াও আছে জলাশয় ও নানা প্রজাতির গাছপালা। পশুপাখি, জলাশয়, গাছপালার বিশালতাই যেন পরিবার–পরিজন, বন্ধুবান্ধব, প্রতিবেশীদের সঙ্গে ঈদ করতে যাঁরা কর্মস্থল ছেড়ে যেতে পারেন না, তাঁদের টেনে আনে।
চিড়িয়াখানার ভেতর গাছতলায় ঘাস আর শুকনা পাতার ওপর বসে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন মো. আবুল কালাম আজাদ, তাঁর স্ত্রী ও মেয়ে। আবুল কালাম সাভারের আশুলিয়ার একটি পোশাক কারখানায় কাজ করেন। কুমিল্লার গ্রামের বাড়িতে ঈদ করতে না যাওয়ায় তাঁরা চিড়িয়াখানায় ঘুরতে এসেছেন। চিড়িয়াখানায় প্রবেশের আগে দুপুরের খাবারও কিনে নিয়ে আসেন। বিশ্রামের পাশাপাশি তাঁরা দুপুরের খাবারও খাচ্ছিলেন। আবুল কালামের মেয়ে আমেনা বলে, ‘ঘাসের ওপর বসে খেতে ভালো লাগছে। এর আগে আরও একবার এমন করে রাঙামাটিতে খাবার খেয়েছিলাম।’
পাশেই একটি কাঁঠালগাছের ডালে তিন শিশু বসে ছিল। নিচে দাঁড়িয়ে ছিলেন অভিভাবকেরা। মো. নিশান অভিভাবকদের একজন। তাঁরা নারায়ণগঞ্জের গাউছিয়া এলাকা থেকে মোট ১২ জন এসেছেন। গাড়িচালক নিশান বলেন, বাচ্চারা গাছে উঠছে, দৌড়াদৌড়ি করছে, খেলা করছে। সব মিলিয়ে চিড়িয়াখানার ভেতর যে প্রাকৃতিক পরিবেশ, এটাই বেশি ভালো লাগছে।
দেখা যায়, চিড়িয়াখানার বিশাল এলাকাজুড়ে এমন বহু পরিবার গাছের তলায়, ফাঁকা জায়গায় বিশ্রাম করছে, একান্ত সময় কাটাচ্ছে।
তাই বলে পশুপাখির খাঁচা ঘিরে মানুষের কমতি ছিল না। ভিড়ের কারণে কাছ থেকে পশুপাখি দেখতে প্রত্যেককে রীতিমতো হিমশিম খেতে হয়েছে। বিশেষ করে শিশুদের জন্য আরও বেশি কঠিন ছিল। তাই শিশুদের বাবার কাঁধে উঠে কিংবা মায়ের কোলে উঠে পশুপাখি দেখতে হয়েছে। বাবা সোহানুর রহমানের কাঁধে উঠে বাঘ দেখতে হয়েছে মেহেরিনাকে। তবে তাতেও সন্তুষ্ট হতে পারেনি ছোট মেহেরিনা। সে বলে, ‘বেশি ভালো লাগে নাই, কারণ বেশি বাঘ নাই। দূর থেকে একটু বাঘ দেখেছি।’
উটপাখি যখন একটু জোরে জোরে হাঁটছিল, তাকে কাছ থেকে দেখার জন্য তার সঙ্গে সঙ্গে মানুষ অনেকটাই দৌড়াচ্ছিল। কেউ উটপাখির সঙ্গে সেলফি তুলছিলেন, কেউ ভিডিও করছিলেন। আবার কেউ কেউ উটপাখিকে ঘাস খাওয়াচ্ছিলেন। মো. রাকিবুল ইসলাম নামে একজন বলেন, ‘অনেকেই ঘাস খাওয়াচ্ছে দেখে আমিও খাওয়ালাম। ভালোই লাগল।’ উটপাখির সঙ্গে নিজের সেলফি তুলতে পেরে খুশি মো. কমল হাসান। তিনি বলেন, ‘আমার সেলফিটা ভালো এসেছে।’
জাতীয় চিড়িয়াখানার ভেতরের শিশুপার্কেও উপচে পড়া ভিড়। সেখানে ট্রেন, দোলনা, চড়কি রয়েছে। ট্রেনে ওঠার লম্বা সারি। মেয়েকে নিয়ে ট্রেনে ওঠার জন্য আধা ঘণ্টার বেশি সময় সারিতে দাঁড়িয়ে আফজাল হোসেন। তিনি বলেন, ‘মেয়ে ট্রেনে উঠবে, তাই কষ্ট হলেও লাইনে দাঁড়িয়ে আছি।’
ব্যাপক জনসমাগমের কারণে মানুষের ভোগান্তিও কম হয়নি। ছিল প্রচুর ধুলা, যানজট ও যত্রতত্র ভ্রাম্যমাণ দোকানের ভোগান্তি। কমার্স কলেজ–সংলগ্ন মোড় থেকে যে সড়কটি চিড়িয়াখানার দিকে চলে গেছে, তা পুরোটাই যানজটের মধ্যে ছিল। ফলে সবাইকে সেখান থেকে চিড়িয়াখানা পর্যন্ত প্রায় এক কিলোমিটারের মতো রাস্তা হেঁটে যাতায়াত করতে হয়েছে। সেই সঙ্গে যানবাহনসংকট ও বাড়তি ভাড়ার কারণে অনেককেই মিরপুরের সনি সিনেমা হল পর্যন্ত হেঁটে আসতে দেখা গেছে।
যানজটের কারণে কমার্স কলেজ–সংলগ্ন মোড়ে সিএনজি থেকে নেমে যেতে হয় মো. রুবেল হোসেনকে। নারী, পুরুষ ও শিশু মিলিয়ে পরিবারের মোট আটজন সদস্য সেখান থেকে চিড়িয়াখানা পর্যন্ত হেঁটে এসে ক্লান্ত হয়ে পড়েন। চিড়িয়াখানায় প্রবেশের পর প্রথমেই তাঁরা বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। রুবেল হোসেন বলেন, ‘আমাদের সঙ্গে শিশু ও নারী রয়েছে। তাদের নিয়ে সিএনজি থেকে চিড়িয়াখানায় আসতে আধা ঘণ্টা লেগে গেছে।’
সঙ্গে আসা আহেদা বেগম বলেন, ‘মানুষের ভিড় ঠেলে হেঁটে আসতে গিয়েই ক্লান্ত হয়ে গেছি।’
জাতীয় চিড়িয়াখানার পরিচালক রফিকুল ইসলাম তালুকদার বলেন, ‘আজ (রোববার) প্রায় দুই লাখ মানুষের আগমন ঘটেছে চিড়িয়াখানায়। যা ঈদের দিনের প্রায় দ্বিগুণ।’