গত কয়েক বছরে বিভিন্ন ক্ষেত্রে উন্নয়ন হয়েছে। তবে এ উন্নয়ন ন্যায্য হয়নি। সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর কণ্ঠস্বর প্রতিফলিত হয়নি। সে কারণে গণতন্ত্র দুর্বল হয়েছে। গণতান্ত্রিক জবাবদিহি প্রতিষ্ঠা করতে হলে অংশগ্রহণমূলক, প্রতিযোগিতামূলক, অবাধ ও স্বচ্ছ একটি নির্বাচন প্রয়োজন।
অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন এবং ন্যায্যতাবিষয়ক এক মিডিয়া ব্রিফিংয়ে এসব কথা বলেছেন এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্মের আহ্বায়ক এবং গবেষণা সংস্থা সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, উন্নয়নে নানামুখী বৈষম্য রয়েছে। সেখানে ন্যায্যতা ফিরিয়ে আনাই এখন প্রধান চ্যালেঞ্জ। এ পরিবর্তন কার্যকর করতে হলে উন্নয়নে গণতান্ত্রিক জবাবদিহি কার্যকর করতে হবে। তা কার্যকর করার সবচেয়ে বড় জায়গা হলো নির্বাচন।
এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম বুধবার রাজধানী ব্র্যাক সেন্টারে এ ব্রিফিংয়ের আয়োজন করে। সংবাদ সম্মেলনে অন্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো এবং নাগরিক প্ল্যাটফর্মের কোরগ্রুপ সদস্য অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান। সভাপ্রধান হিসেবে বক্তব্য রাখেন প্ল্যাটফর্মের কোরগ্রুপ সদস্য এবং মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম।
উন্নয়নে বৈষম্য প্রসঙ্গে ড. দেবপ্রিয় বলেন, এক সময় ছিল এক দেশ দুই অর্থনীতি, যা এখন এক দেশ দুই সমাজে রূপান্তরিত হয়েছে। একটি সমাজ এগিয়েছে, অন্যটি পিছিয়ে পড়েছে। পিছিয়ে পড়াদের কণ্ঠস্বর সঠিকভাবে উপস্থাপিত হয়নি। এ অবস্থার পরিবর্তনে উন্নয়নে ন্যায্যতা আনতে হবে। পিছিয়ে পড়া মানুষের হিস্যা বাড়াতে হবে। এটি সম্ভব না হলে তা মানবিক সমাজ কিংবা মুক্তিযুদ্ধের সমাজ হবে না। গণতন্ত্র এবং জবাবদিহি না হলে এ ধরনের সমাজ বিনির্মাণ সম্ভব নয়। জবাবদিহি আদায়ের জন্য গণতন্ত্রে কেবল এক দিন ভোট দেওয়াই যথেষ্ট নয়। নির্বাচনী ইশতেহারে ঘোষিত প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে হবে। অতীতে দেখা গেছে, রাজনৈতিক দলগুলো বিভিন্ন প্রতিশ্রুতি দেয় বটে, তবে ৫ বছরের জন্য দেওয়া প্রতিশ্রুতি ১৫ বছরেও বাস্তবায়ন হয় না।
এক প্রশ্নের জবাবে ড. দেবপ্রিয় বলেন, বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত সমাজ দুর্বল এবং ক্ষয়প্রাপ্ত হয়েছে। এর প্রভাব শুধু অর্থনীতিতে নয়, রাজনীতি এবং সংস্কৃতিতেও রয়েছে। ষাটের দশকে সাংস্কৃতিক মান এবং রাজনৈতিক মূল্যবোধ উন্নয়নে বিকাশমান মধ্যবিত্তের বড় ভূমিকা ছিল, যা এখন নেই। তবে বিত্তবান, রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী ও আন্তর্জাতিকভাবে যুক্ত– এই তিন চরিত্র নিয়ে একটি গোষ্ঠীর উত্থান হয়েছে।
ড. দেবপ্রিয় আরও বলেন, জাতীয় নির্বাচনে নীতিমালার ক্ষেত্রে প্রভাব রাখতে চাইলে মেধাবী মানুষ এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে একত্রিত করে কিছু একটা প্রস্তুত করা দরকার। সে বিবেচনায় নাগরিক প্ল্যাটফর্মের পক্ষ থেকে এবার নির্বাচনের প্রাক্কালে রাজনৈতিভাবে প্রচারিত উন্নয়নের আখ্যান কতখানি সত্য, সঠিক ও মজবুত তা বোঝার জন্য গত দেড় দশকের মূল্যায়ন করা হয়েছে। সারাদেশের বিপন্ন জনগোষ্ঠীর সঙ্গে আলোচনা করে তাদের কণ্ঠস্বর তুলে আনার চেষ্টা করা হয়েছে। এর ওপর ভিত্তি করে বিভিন্ন বিষয়ে ১১টি প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। বিভিন্ন প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কণ্ঠস্বর যদি সোচ্চার না হয় তাহলে উন্নয়নের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়ন হবে না।
অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, এসডিজির মূল কথাই হচ্ছে, কেউ পেছনে থাকবে না। অথচ সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর মৌলিক কিছু সমস্যা রয়ে গেছে। সমাধানের জন্য এসব সমস্যা নীতিনির্ধারকদের নজরে আনতে চান তারা। শাহীন আনাম বলেন, প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষ কেমন আছে, তাদের বঞ্চনা এবং জীবন-জীবিকার চ্যালেঞ্জ, তারা কেমন সমাজ দেখতে চায়, সমাজে তাদের অবস্থান কী– এসব জবাব জানার চেষ্টা করা হয়েছে নাগরিক প্ল্যাটফর্মের পক্ষ থেকে। কারণ, এখনও বিশাল জনগোষ্ঠী বিভিন্ন মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত।
সংবাদ সম্মলেন অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন এবং ন্যায্যতার লক্ষ্যে নাগরিক এজেন্ডা : শিক্ষা, স্বাস্থ্য, জলবায়ু পরিবর্তন ও সামাজিক সুরক্ষা বিষয়ে পৃথক ৪টি প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হয়। সামাজিক সুরক্ষা বিষয়ে প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক এম আবু ইউসুফ। স্বাস্থ্য খাতের ওপর প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন হেলথ ওয়াচের উপদেষ্টা ড. ইয়াসমিন এইচ আহমেদ। এ ছাড়া শিক্ষা এবং জলবায়ু পরিবর্তন ঝুঁকি সম্পর্কিত প্রতিবেদন দুটি উপস্থান করেন গণসাক্ষরতা অভিযানের উপপরিচালক ড. মোস্তাফিজুর রহমান এবং ইস্টওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যেষ্ঠ প্রভাষক ইশতিয়াক বারী। প্রতিবেদনগুলোতে এসব খাতের বিভিন্ন দুর্বলতা এবং কিছু সুপারিশ তুলে ধরা হয়।