যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরের মেয়র হিসেবে জোহরান মামদানির নির্বাচনে বিজয়ের সম্ভাবনা আরও উজ্জ্বল হয়েছে। গত জুনে অনুষ্ঠিত ডেমোক্র্যাটিক পার্টির বাছাইপর্বের ভোটে তিনি নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী সাবেক গভর্নর অ্যান্ড্রু কুমোকে ৫৬: ৪৪ শতাংশ বা ১২ পয়েন্টে পরাস্ত করেছিলেন। সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে সে ব্যবধান আরও বেড়েছে। সর্বশেষ জনমত জরিপে অ্যান্ড্রু কুমোর চেয়ে ২২ শতাংশ পয়েন্টে এগিয়ে রয়েছেন মামদানি।
কিন্তু আগামী নভেম্বরে অনুষ্ঠেয় নির্বাচনে মামদানি জিতবেনই, সে কথা বলার সময় এখনো আসেনি। নির্বাচনে মামদানি ও কুমো ছাড়াও বর্তমান মেয়র এরিক এডামস ও রিপাবলিকান প্রার্থী কার্টিস স্লিওয়া থাকছেন। এ ছাড়া স্বতন্ত্র প্রার্থী জিম ওয়ালডেন রয়েছেন। এঁরা সবাই যদি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন, তাহলে সব ভোট পাঁচ ভাগে বিভক্ত হয়ে যাবে। সর্বোচ্চ ভোট পেয়ে সহজেই জিতে যাবেন মামদানি।
কিন্তু এঁদের মধ্যে তিন বা চারজনকে যদি প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে সরে দাঁড়াতে রাজি করানো যায়, তাহলে সরাসরি লড়াই হবে মামদানি ও কুমোর মধ্যে। মামদানি ছাড়া বাকি সবার ভোট যদি কুমোর পক্ষে এক বাক্সে রাখার ব্যবস্থা করা যায়, তাহলে নির্বাচনের ফলাফল ভিন্ন হতে পারে। সে লক্ষ্যেই চেষ্টা চলছে কুমোকে সামনে রেখে মামদানির বিপক্ষে একটি অভিন্ন জোট গঠন করার।
কোনো সন্দেহ নেই, মামদানির মেয়র পদে প্রার্থিতা এই শহরে অধিকাংশ নাগরিকের মধ্যে বিপুল উৎসাহের সঞ্চার করেছে। বাংলাদেশি-আমেরিকানসহ অধিকাংশ অভিবাসীই তাঁর পক্ষে দাঁড়িয়েছেন। কিন্তু শুধু সেই সমর্থনেই তাঁর পক্ষে জেতা সম্ভব হবে না। জিততে হলে তাঁকে সম্ভাব্য ভোটের পরিমাণ বাড়াতে হবে। এ কাজে তাঁকে তিনটি প্রধান চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হবে।
প্রথম চ্যালেঞ্জ হলো ট্রাম্প–কুমো মৈত্রী ঠেকানো। একাধিক সূত্রে বলা হয়েছে, মামদানিকে ঠেকাতে ব্যবস্থা গ্রহণের লক্ষ্যে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও কুমো টেলিফোনে কথা বলেছেন। গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রী হিসেবে পরিচিত মামদানিকে ট্রাম্প প্রথম দিন থেকেই উন্মাদ ও কমিউনিস্ট অভিহিত করে তাঁর বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করে চলেছেন।

অপর দিকে মামদানিকে নিউইয়র্কের জন্য ‘বিপজ্জনক’ বলে অভিহিত করেছেন কুমো। গাজা প্রশ্নে মামদানির অবস্থান আমেরিকার স্বার্থবিরোধী—এমন অভিযোগও তাঁর শিবির থেকে করা হয়েছে। ফলে মামদানিকে ঠেকানোর ব্যাপারে ট্রাম্প ও কুমোর একটি স্বাভাবিক অলিখিত আঁতাত রয়েছে।
ট্রাম্প যদি ব্যক্তিগতভাবে অনুরোধ করেন, তাহলে এরিক এডামস ও অন্য দুজন প্রার্থী কুমোর পক্ষে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াতে পারেন। শহরের রিপাবলিকান সমর্থকদের মধ্যেও অধিক উৎসাহের সঞ্চার হবে।
কয়েক সপ্তাহ আগেও ট্রাম্পের সমর্থনের কথা যত আস্থার সঙ্গে বলা যেত, এখন তা আর যাচ্ছে না। কুমো কিছুতেই নিজের সমর্থন-ভিত বাড়াতে পারছেন না, বরং মামদানির প্রচারের মুখে তা দিনে দিনে হ্রাস পাচ্ছে। এর প্রমাণ মিলেছে নির্বাচনী কর্তৃপক্ষ থেকে সমান অনুদান বা ম্যাচিং ফান্ডের সর্বশেষ হিসাব থেকে।
চলতি নিয়মে নিউইয়র্ক নির্বাচনী বোর্ড ভোটারদের কাছ থেকে প্রাপ্ত প্রতি ডলার অনুদানের বিপরীতে ৯ ডলার অনুদান দিয়ে থাকে। সেই হিসাবে বাছাইপর্বের পর মামদানি এ পর্যন্ত প্রায় ২০ লাখ ডলার সরকারি অনুদান পেয়েছেন। অন্যদিকে কুমো পেয়েছেন মাত্র ৪ লাখ ৮২ হাজার ডলার।
আরও খারাপ খবর দিয়েছে নিউইয়র্ক টাইমস। সংবাদমাধ্যমটি জানিয়েছে, কুমো আশা করেছিলেন, মামদানির বিরুদ্ধে নির্বাচনী প্রচারণায় শহরের অতিধনীদের কাছ থেকে খোলা হাতে অনুদান পাবেন। বাস্তবে তা ঘটেনি।
টাইমস জানাচ্ছে, এই শহরের ধনীরা সম্ভবত মেনে নিয়েছেন মামদানির বিজয় ঠেকানো অসম্ভব। এ কাজে অর্থ ঢালার অর্থ হবে সে টাকা জলে ঢালা। একই কারণে ট্রাম্পও হয়তো কুমো থেকে সযত্ন দূরত্ব রক্ষা করে চলবেন।
দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জ কমিউনিস্ট ঠেকানো। মামদানি বামপন্থী সংগঠন ডেমোক্র্যাটিক সোশ্যালিস্টস অব আমেরিকার একজন সদস্য। তিনি যে নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তা বহুলাংশে এই দলের রাজনৈতিক কর্মসূচির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ।
মামদানি নিউইয়র্কবাসীর ব্যয়ভার কমাতে ধনীদের ওপর অতিরিক্ত আয়কর আরোপের প্রস্তাব করেছেন। বিনা পয়সায় বাস চলাচলের প্রস্তাব করেছেন। এমনকি সরকারি মালিকানায় সস্তায় মুদিখানা খোলার প্রস্তাবও করেছেন। শহরের বাড়িভাড়া আগামী কয়েক বছরের জন্য না বাড়ানোর প্রস্তাবও তাঁর ঘোষিত প্রতিশ্রুতির অন্তর্গত। এ ছাড়া সরকারি খরচে শিশু পরিচর্যার ব্যবস্থার প্রতিশ্রুতি তো রয়েছেই। এই সবই কারও কারও চোখে তাঁকে কমিউনিস্ট বানিয়েছে।
এর আগে মামদানি পুলিশের জন্য বাজেট বরাদ্দ কমানোর দাবি তুলেছিলেন। শহর এলাকায় কারাগার রাখারও বিরোধিতা করেছিলেন। সোশ্যালিস্ট পার্টির কর্মসূচিতে লঘু অপরাধে দণ্ড বাতিল ও যৌনকর্মকে আইনসিদ্ধ করার কথা বলা আছে। মামদানি তারও পক্ষে। শহরের রক্ষণশীলদের কাছে এই সবই ভীষণ আপত্তির।
এসব বিষয় বিবেচনায় এনে গত সপ্তাহে সোশ্যালিস্টদের কর্মসূচি সমর্থন করেন না বলে জানিয়েছেন মামদানি। পুলিশের বাজেট হ্রাসও তিনি সমর্থন করেন না বলে জানিয়েছেন। লঘু দণ্ডব্যবস্থা বাতিলেরও সরাসরি বিরোধিতা করেছেন। ফলে রক্ষণশীলদের কোপানল থেকে তিনি রক্ষা পেলেও শহরের প্রগতিশীল ভোটাররা; প্রধানত যাঁদের সমর্থনে এই লড়াইয়ে তিনি এত দূর পর্যন্ত এসেছেন, তাঁরা অসন্তুষ্ট হন কি না, তা দেখার বিষয়। কেউ কেউ বলছেন, এত সহজে নিজের অবস্থান বদল থেকে মনে হয় মামদানি ও অন্যান্য পেশাদারি রাজনীতিকদের মধ্যে কোনো তফাত নেই।

তৃতীয় চ্যালেঞ্জ কৃষ্ণকায় ভোটারদের সমর্থন বৃদ্ধি। বাছাইপর্বের নির্বাচনী ফল থেকেই বোঝা গিয়েছিল, মামদানির জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে এই শহরের আফ্রিকান-আমেরিকান ভোটারদের সমর্থন অর্জন। প্রায় ৯০ লাখ মানুষের এই শহরে আফ্রিকান-আমেরিকানদের সংখ্যা প্রায় ২০ লাখ বা ২২ শতাংশ। বাছাইপর্বে শহরের ৩৩টি কৃষ্ণকায়-প্রধান এলাকার মাত্র আটটিতে জয়ী হয়েছিলেন মামদানি। কুমো জয়ী হয়েছিলেন বাকি ২৫টি এলাকায়।
এই দুর্বলতা মাথায় রেখে মামদানি গত কয়েক সপ্তাহ আফ্রিকান-আমেরিকানপ্রধান অঞ্চলগুলোতে ব্যাপক নির্বাচনী ক্যাম্পেইনে ব্যস্ত রয়েছেন। গত সপ্তাহে তিনি গিয়েছিলেন ব্রঙ্কসের বিখ্যাত নাগরিক অধিকার নেতা আল শার্পটনের ন্যাশনাল অ্যাকশন নেটওয়ার্কের সদর দপ্তরে। শার্পটন তাঁকে ব্যক্তিগতভাবে আপ্যায়ন করেন।
ইতিমধ্যে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ আফ্রিকান-আমেরিকান রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব মামদানির প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন। এঁদের মধ্যে রয়েছেন ব্রঙ্কস থেকে নির্বাচিত সাবেক কংগ্রেস সদস্য জামাল বোওম্যান। তবে যে আফ্রিকান-আমেরিকান নেতার সমর্থনের অপেক্ষায় রয়েছেন, তিনি হলেন চলতি মার্কিন কংগ্রেসে ডেমোক্র্যাটিক পার্টির নেতা হাকিম জেফ্রিস।
মামদানির ক্যাম্পেইন থেকে বলা হয়েছে, তারা জেফ্রিসের অনুমোদন লাভের ব্যাপারে আশাবাদী। সেটি বাস্তবায়িত হলে ভোটের লড়াইয়ে মামদানি আরও কয়েক কদম এগিয়ে যাবেন তা নিশ্চিত।
হাসান ফেরদৌস
নিউইয়র্ক থেকে