ছোট কম্পনে বড় বিপর্যয়ের আভাস

0
136
ভূমিকম্প

দেশে মাত্র ১৪ দিনের মাথায় আবারও মৃদু ভূকম্পন অনুভূত হয়েছে। মঙ্গলবার দুপুর ১টা ১৩ মিনিটে সিলেটে এ ভূকম্পন অনুভূত হয়। রিখটার স্কেলে যার মাত্রা ছিল ৩.৫। এ নিয়ে গত চার মাসে চতুর্থবার ভূমিকম্প হলো। গতকালর ভূকম্পনটি মৃদু হওয়ায় অনেকেই টের পাননি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ছোট এ ভূমিকম্প বড় বিপর্যয়ের আভাস দিচ্ছে। তাই ক্ষয়ক্ষতি রোধে এখনই প্রস্তুতি নেওয়া জরুরি।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরিচালক আজিজুর রহমান জানান, মঙ্গলবার সংঘটিত ভূমিকম্পটির উৎপত্তিস্থল ছিল সিলেটের কানাইঘাট ও জকিগঞ্জ উপজেলার মাঝামাঝি স্থানে। রাজধানী ঢাকা থেকে উৎপত্তিস্থলের দূরত্ব ১৯৫ কিলোমিটার। এর আগে গত ১৪ আগস্ট রাতে ৫.৫ মাত্রার যে ভূমিকম্প হয়েছিল, সেটির উৎপত্তিও ছিল কানাইঘাট ও ভারতের আসাম সীমান্তের কাছে। মূলত সিলেট অঞ্চলে যে ‘ফল্ট’ রয়েছে, সেটি সক্রিয় আছে, ছোট ছোট ভূমিকম্প তার আভাস দিচ্ছে। বার্মিজ প্লেট ও ইন্ডিয়ান প্লেটের পরস্পরমুখী গতির কারণেই এ ধরনের ভূমিকম্প হচ্ছে। এই দুটি প্লেটের সংযোগস্থলে প্রচুর পরিমাণে শক্তি জমে আছে; যা বের হয়ে আসার পথ খুঁজছে। সে জন্য ঘন ঘন এমন ভূমিকম্প অনুভূত হচ্ছে।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত ১৬ জুন রাজধানীসহ সারাদেশে ৪.৫ মাত্রার মৃদু ভূমিকম্প হয়। এর উৎপত্তিস্থল ছিল সিলেটের গোলাপগঞ্জ। এর আগে ৫ মে আরেকটি ভূমিকম্প হয়েছে ঢাকা ও এর আশপাশের এলাকায়। যুক্তরাষ্ট্রের ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা ইউএসজিএসের হিসাব অনুযায়ী এই ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৪.৩, যার উৎপত্তিস্থল ছিল ঢাকার কাছে বিক্রমপুরের দোহার থেকে প্রায় ১৪ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে।

ইউএসজিএসের তথ্য বলছে, সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশের ভূখণ্ডে উৎপত্তি হওয়া ভূমিকম্পগুলোর মধ্যে বেশি ৫.৬ মাত্রা ছিল ২০০৩ সালের ২৬ জুলাইয়ে সৃষ্টি হওয়া একটি ভূমিকম্পের। সেটি চট্টগ্রাম ও খাগড়াছড়িতে অনুভূত হয়। বাংলাদেশে গত এক বছরে তিনটি ৫ মাত্রার বেশি ক্ষমতার ভূমিকম্প হয়েছে। ২০২২ সালের ১৫ আগস্ট ৫.১ মাত্রা এবং গত ২৩ জানুয়ারি ৫.২ মাত্রার ভূকম্প অনুভূত হয়। সব মিলিয়ে গত এক বছরে বাংলাদেশে ১৭টি ভূমিকম্প হয়েছে, যার বেশির ভাগের মাত্রা ছিল ৪ থেকে ৫-এর মধ্যে। ১০টির উৎস ছিল চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার এলাকায়। ২০২১ সালের ৭ জুন এবং ২১ ও ৩০ মে সিলেটে মোট আটবার ভূকম্পন অনুভূত হয়।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত কয়েক বছরে সংঘটিত ভূমিকম্পের অন্তত ২০টির উৎপত্তিস্থল ছিল দেশের ভেতরে। এর মধ্যে ১১টি সিলেট অঞ্চলে। ভূমিকম্পের প্রবণতা নিয়ে ২০০৩ সাল থেকে গবেষণা করছেন উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও গবেষক অধ্যাপক সৈয়দ হুমায়ুন আখতার। তাঁর গবেষণা মডেল বলছে, ইন্ডিয়ান ইউরেশিয়ান এবং বার্মা– তিনটি গতিশীল প্লেটের সংযোগস্থলে বাংলাদেশের অবস্থান। তিনি জানান, দেশে বিপজ্জনক ভূকম্পনের প্রধান দুটি উৎস হচ্ছে– ৩০০ কিলোমিটার দীর্ঘ ডাউকি ‘ফল্ট’ এবং টেকনাফ-পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি অঞ্চল সাবডাকশন জোন। আর্থ অবজারভেটরি ভূকম্পনগুলোর উৎপত্তিস্থল হিসেবে শনাক্ত করেছে সিলেটের জৈন্তাপুর এলাকার লালাখালসংলগ্ন এলাকাকে, যেটি বিপজ্জনক ডাউকি ফল্টের পূর্ব প্রান্তের কাছাকাছি।

এদিকে সব গবেষণার তথ্যেই সিলেট অঞ্চল যে ভূমিকম্পের বড় ধরনের ঝুঁকিতে আছে তা স্পষ্ট। ২০২১ সালের মে ও জুনে পরপর আট দফা ভূমিকম্পের পর ক্ষতি কমিয়ে আনতে সিলেট নগরীর সব বহুতল ভবনের ভূমিকম্প সহনীয়তা পরীক্ষা ও অধিক ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো ভেঙে ফেলার পরামর্শ দেন বিশেষজ্ঞরা। এর পর শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) বিশেষজ্ঞদের মাধ্যমে নগরীর বন্দরবাজার ও জিন্দাবাজার এলাকার কিছু ভবন পরীক্ষা করা হয়। এই বিশেষজ্ঞ দলের সদস্য ছিলেন শাবিপ্রবি পরিবেশ ও পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. জহির বিন আলম। তিনি বলেন, সিলেটে ৭৪.৪ শতাংশ ভবন ভূমিকম্প প্রতিরোধকভাবে নির্মাণ করা হয়নি। ফলে ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হলেই ৮০ শতাংশ ভবন ভেঙে পড়তে পারে।

ভূমিকম্প গবেষক অধ্যাপক সৈয়দ হুমায়ুন আখতার বলেন, ‘বাংলাদেশে সবচেয়ে মারাত্মক হচ্ছে সিলেট থেকে টেকনাফ পর্যন্ত বিস্তৃত দুই প্লেটের সংযোগস্থল। এ অঞ্চলের ভূগর্ভে গত ৮০০ থেকে হাজার বছরের মধ্যে জমে থাকা শক্তি বের হতে পারেনি। দুই প্লেটের সংযোগস্থলে যে ভূমিকম্প হয়, তা খুবই ভয়াবহ। এ এলাকায় বড় ধরনের ভূমিকম্প হয়েছে ৮০০ থেকে হাজার বছর আগে। এর পর থেকে আবার শক্তি জমা হতে শুরু করেছে। ৮.২ থেকে শুরু করে ৯ মাত্রার ভূমিকম্প হওয়ার মতো শক্তি এ এলাকায় জমা হয়ে আছে। সেই বড় ভূমিকম্প যখন হবে, তার আগের সময়টাতে এ ধরনের ছোট ভূমিকম্প দেখা যায়।’

অধ্যাপক হুমায়ুন আরও বলেন, ‘গত কয়েক মাসে যে তিন-চারটি ভূমিকম্প দেখলাম, সবগুলোই ছিল মৃদু থেকে মাঝারি মাত্রার। বড় শক্তি বের হওয়ার একটা প্রবণতার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। তার মানে যে কোনো সময় একটি বড় ভূমিকম্প হতে পারে।’

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.