ছোট্ট রাফির শরীরে এত কাটাছেঁড়া

সাতকানিয়ায় দুর্বৃত্তের গুলি শৈবাল আচার্য্য, চট্টগ্রাম

0
89
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে শিশু রাফি

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের শয্যায় তীব্র যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে চার বছরের শিশু আবদুল্লাহ রাফি। হাসপাতালের শিশু সার্জারি বিভাগে চিকিৎসাধীন সে। গত রোববার দুর্বৃত্তদের ছোড়া গুলি রাফির পেট ভেদ করে বেরিয়ে যায়। ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায় পেট।
অপারেশন করে এরই মধ্যে কেটে ফেলতে হয়েছে রাফির পেটের কয়েকটি নাড়ি। খাবার খাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে। তাকে সুস্থ করে তোলাকে চ্যালেঞ্জ মনে করছেন চিকিৎসকরা। সে এখনও শঙ্কামুক্ত নয়। পেটের অবস্থায় কিছুটা উন্নতি না হলে মুখে খাবার দেওয়া যাবে না। এ অবস্থায় দুশ্চিন্তায় অভাবী পরিবারটি। রাফির চিকিৎসা খরচ নিয়ে শঙ্কায় পড়েছেন তার বাবা-মা।
গত রোববার সাতকানিয়া উপজেলার এওচিয়া ইউনিয়নের উত্তর-পশ্চিম গাটিয়াডেঙ্গা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে চায়ের দোকানে বসা সাংবাদিক কামরুল ইসলামকে লক্ষ্য করে হামলা চালায় দুর্বৃত্তরা; ছোড়া হয় গুলি। এ সময় ওই দোকানে লজেন্স কিনতে গিয়েছিল রাফি। কিছু বুঝে ওঠার আগেই দোকানের ভেতরে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় দুর্বৃত্তদের ছোড়া গুলির শিকার হয় সে। কামরুল ঢাকা থেকে প্রকাশিত দৈনিক দ্য ইভনিং নিউজের চট্টগ্রামের ব্যুরোপ্রধান। অবৈধ বালু উত্তোলন, মাটি কাটা ও মাদকের বিরুদ্ধে লেখালেখি করায় একটি চক্র তাঁর ওপর ক্ষুব্ধ।

আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে ধারদেনা করে চলছে রাফির চিকিৎসা খরচ। ছেলের তীব্র যন্ত্রণায় কান্নায় ভেঙে পড়ছেন বাবা আবদুর রহিম ও মা সুমাইয়া ফেরদৌস। ছোট্ট নাতির অস্বাভাবিক কষ্টে মন ভালো নেই বৃদ্ধ দাদা-দাদিরও। সবার একটিই প্রশ্ন– কী দোষ ছিল শিশু রাফির। গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর রাতেই চমেক হাসপাতালে টানা সাড়ে ৩ ঘণ্টা অস্ত্রোপচার চলে তার। গুলিবিদ্ধ সাংবাদিক কামরুল ইসলামও একই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তাঁর দুই পা গুলিবিদ্ধ হয়েছে। তবে অবস্থা ভালোর দিকে।

চমেক হাসপাতালের শিশু সার্জারি বিভাগের (৮৪ নম্বর ওয়ার্ড) ২০ নম্বর শয্যায় চিকিৎসাধীন শিশু রাফি। সরেজমিনে বৃহস্পতিবার দুপুরে দেখা যায়, শয্যা থেকে রাফিকে কোলে করে ওয়ার্ডের মিনি অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাচ্ছেন বাবা আবদুর রহিম। অপারেশন করা অংশে ড্রেসিং করতে তাকে নেওয়া হচ্ছে। পাশে আছেন মা, দাদা-দাদি, চাচাসহ আত্মীয়স্বজন। কিছুক্ষণ পর অপারেশন থিয়েটার থেকে কান্নারত অবস্থায় বের হয়ে যান আবদুর রহিম। একটু কাছে গেলে কানে আসে রাফির চিৎকার। পাশে বিলাপ করছিলেন মা সুমাইয়া ফেরদৌস। নাতির চিৎকারে অনবরত চোখের পানি ফেলছেন দাদা-দাদি।
সন্তানের এমন অবস্থা মেনে নিতে পারছেন না বাবা আবদুর রহিম। তিনি পেশায় ইলেকট্রিশিয়ান। সামান্য আয় দিয়ে দুই সন্তান ও স্ত্রীকে নিয়ে অনেক কষ্টে কাটে তাঁর দিন। অভাবের সংসারে চিকিৎসা খরচ জোগাড়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাঁকে। কথা বলার শক্তিটুকুও হারিয়ে ফেলেছেন রাফির মা সুমাইয়া ফেরদৌস। তিনি  বলেন, তিনি সন্তানকে সুস্থ ফিরে পেতে চান। হামলাকারীদের বিচার চান। দাদা শামসুল ইসলাম কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, এত ছোট্ট শরীরে গুলির মারাত্মক আঘাত কীভাবে সইবে সে।

শিশু সার্জারি বিভাগের সহকারী রেজিস্ট্রার ডা. রাকিবুল ইসলাম বলেন, গুলিতে নাড়িভুঁড়ি বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অপারেশন করে কয়েকটি জোড়া লাগানো হয়েছে। আপাতত তাকে স্যালাইন দিয়ে রাখা হয়েছে। আরও কয়েকটি অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন হতে পারে।
ডা. অন্তরদ্বীপ নন্দী বলেন, রাফি নিবিড় পর্যবেক্ষণে (আইসিইউ) রয়েছে। জীবন বাঁচানোর জন্য অন্ত্রনালির অনেকাংশ কেটে ফেলতে হয়েছে। তাকে আরও এক সপ্তাহ পর্যবেক্ষণে রাখা হবে। রাফির চাচা নাজিম উদ্দিন বলেন, প্রতিদিনই চিকিৎসার জন্য ওষুধ-ইনজেকশনসহ নানা জিনিসের প্রয়োজন হচ্ছে। এত খরচের সামর্থ্য তাঁদের নেই।
২ নম্বর ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন গুলিবিদ্ধ সাংবাদিক কামরুল ইসলাম বলেন, এলাকায় অনৈতিক কাজের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ায় সংক্ষুব্ধ একটি চক্র পরিকল্পিত এ হামলা চালিয়েছে। বাঁ পায়ের দুটি গুলি এখনও বের করা সম্ভব হয়নি।

সাতকানিয়া প্রতিনিধি জানান, এ ঘটনায় গত বুধবার তিন আসামিকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। খাগড়াছড়ির মানিকছড়ি থেকে তাদের গ্রেপ্তার করা হয় বলে জানিয়ছেন জেলা ডিবি পুলিশ পরিদর্শক (ওসি) নুর আহম্মেদ। আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদের ভিত্তিতে দুটি দেশীয় বন্দুক (এলজি) উদ্ধার করা হয়। অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনায় জেলা ডিবির উপপরিদর্শক সুব্রত দাস আরেকটি মামলা করেছেন।

সাংবাদিক কামরুলের করা মামলায় গ্রেপ্তার আসামিরা হলো– সাতকানিয়া উপজেলার এওচিয়া ইউনিয়নের উত্তর-পশ্চিম গাটিয়াডেঙ্গার আবুল কাশেমের ছেলে ও মামলার প্রধান আসামি আরিফুল ইসলাম মানিক ওরফে টোকাই মানিক, একই এলাকার আবদুর রহিম ওরফে ডালিম ও আবদুর শুক্কুরের ছেলে মিজান।
অতিরিক্ত জেলা পুলিশ সুপার (ডিবি ও শিল্পাঞ্চল) আসাদুজ্জামান বলেন, আসামি মানিকের নামে ৮টি, আব্দুর রহিমের নামে ১০টি ও মিজানের নামে ৭টি হত্যা, অস্ত্র, দাঙ্গা-হাঙ্গামাসহ একাধিক মামলা রয়েছে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.