
যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির (এমআইটি) এক নতুন গবেষণা বেশ উদ্বেগজনক তথ্য দিয়েছে। গবেষকেরা দেখেছেন, চ্যাটজিপিটি ব্যবহার করে যাঁরা লেখালেখি করছেন, তাঁদের মস্তিষ্কের কার্যকলাপ কমে যাচ্ছে। পাশাপাশি কমে যাচ্ছে চিন্তাভাবনার ক্ষমতা।
এমআইটি মিডিয়া ল্যাবের গবেষকেরা যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টনের ১৮-৩৯ বছর বয়সী ৫৪ জনকে নিয়ে একটি পরীক্ষা চালিয়েছেন। তাঁরা এই ব্যক্তিদের তিনটি দলে ভাগ করে কয়েকটি প্রবন্ধ লিখতে বলেছিলেন। প্রথম দলের সদস্যরা প্রবন্ধ লিখতে চ্যাটজিপিটি ব্যবহার করেছেন। দ্বিতীয় দল গুগল সার্চ ইঞ্জিন ব্যবহার করেছে এবং তৃতীয় দলের সদস্যরা প্রবন্ধগুলো লিখেছেন কোনো কিছুর সাহায্য ছাড়াই। গবেষকেরা ইইজি (ইলেক্ট্রোএনসেফ্যালোগ্রাম) মেশিন দিয়ে তাঁদের মস্তিষ্কের ৩২টি অংশের কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ করেছেন। ইইজি মেশিন দিয়ে সাধারণত মস্তিষ্কের বৈদ্যুতিক কার্যকলাপ রেকর্ড করা হয়।
ফলাফল দেখে অবাক হয়েছেন স্বয়ং গবেষকেরা। তাঁদের কপালে পড়েছে চিন্তার ভাঁজ। কারণ, চ্যাটজিপিটি ব্যবহারকারীদের মস্তিষ্কে সবচেয়ে কম কার্যকলাপ দেখা গেছে। স্নায়বিক, ভাষাগত ও আচরণগত—সব দিক থেকেই দুর্বল পারফরম্যান্স করেছেন তাঁরা। এই পরীক্ষা চলেছে কয়েক মাস ধরে। যাঁরা চ্যাটজিপিটি ব্যবহার করেছেন, তাঁরা ধীরে ধীরে আরও অলস হয়ে গেছেন। শেষের দিকে তাঁরা কেবল কপি-পেস্ট করেই কাজ সেরেছিলেন।

এমআইটির গবেষণাপত্রটি এখনো পূর্ণাঙ্গ পর্যালোচনার জন্য জমা দেওয়া হয়নি। তা ছাড়া এর নমুনাও তুলনামূলক ছোট, মাত্র ৫৪ জনকে নিয়ে এই গবেষণা করা হয়েছে। কিন্তু গবেষণার প্রধান লেখক নাতালিয়া কোসমিনা মনে করেন, এই ফলাফল এখনই প্রকাশ করা জরুরি। তাঁর আশঙ্কা, সমাজ যদি তাৎক্ষণিক সুবিধার জন্য কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ওপর বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়ে, তাহলে দীর্ঘ মেয়াদে আমাদের মস্তিষ্কের বিকাশ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
কোসমিনা বলেছেন, ‘এটা এখন প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি, কারণ, আমার ভয় হচ্ছে, ছয়–আট মাস পর হয়তো কোনো নীতিনির্ধারক জিপিটি কিন্ডারগার্টেন চালু করার সিদ্ধান্ত নেবেন। আমি মনে করি, এটা হবে ভুল সিদ্ধান্ত। বিকাশমান মস্তিষ্কগুলো ঝুঁকিতে পড়তে পারে।’
এমআইটি মিডিয়া ল্যাব সম্প্রতি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সরঞ্জামের বিভিন্ন প্রভাব নিয়ে গবেষণায় উল্লেখযোগ্য সম্পদ ব্যয় করছে। এ বছরের শুরুর দিকের এক গবেষণায় দেখা গেছে, মানুষ যত বেশি সময় চ্যাটজিপিটির সঙ্গে কথা বলে, তত বেশি একাকিত্ব অনুভব করে।
২০২১ সাল থেকে এমআইটি মিডিয়া ল্যাবে পূর্ণকালীন গবেষণাবিজ্ঞানী হিসেবে কাজ করছেন কোসমিনা। বিশেষভাবে স্কুলের কাজে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহারের প্রভাব দেখতে চেয়েছিলেন তিনি। কারণ, দিন দিন আরও বেশি শিক্ষার্থী এআই ব্যবহার করছে। তিনি ও তাঁর সহকর্মীরা এই গবেষণার সময় অংশগ্রহণকারীদের ২০ মিনিটের মধ্যে রচনা লিখতে বলেছিলেন। চ্যাটজিপিটি ব্যবহার করা দলের সবাই একই ধরনের প্রবন্ধ লিখেছে। সেসবে মৌলিক চিন্তাভাবনার অভাব ছিল। তাঁরা একই রকম অভিব্যক্তি ও ধারণাও প্রয়োগ করেছে। দুজন ইংরেজি শিক্ষক এসব প্রবন্ধ মূল্যায়ন করে বলেছেন, এসব মূলত প্রাণহীন।
এ বছরের শুরুর দিকের এক গবেষণায় দেখা গেছে, মানুষ যত বেশি সময় চ্যাটজিপিটির সঙ্গে কথা বলে, তত বেশি একাকীত্ব অনুভব করে।
ইইজি পরীক্ষায় দেখা গেছে, চ্যাটজিপিটি ব্যবহারকারীদের মনোযোগের অভাব ছিল। প্রথম দুটি প্রবন্ধ লিখতে গিয়ে অংশগ্রহণকারীরা লেখা একটু পরিবর্তন করেছেন। কিন্তু তৃতীয় প্রবন্ধে তাঁরা শুধু চ্যাটজিপিটিকে প্রম্পট দিয়েছেন এবং কপি করে লেখার কাজ শেষ করেছেন। মানে যা করার সবটা চ্যাটজিপিটিই করে দিয়েছে। কোসমিনা বলেছেন, ‘তাঁদের কাজটা এমন ছিল যে শুধু চ্যাটজিপিটিকে প্রম্পট দিয়েছেন এবং পরে বাক্য একটু সম্পাদনা করে নিজের কাজ শেষ করেছেন।’
বিপরীতে, কোনো সাহায্য ছাড়া যাঁরা প্রবন্ধ লিখেছেন, তাঁদের স্নায়বিক কার্যকলাপ অটুট ছিল। বিশেষ করে আলফা, থিটা ও ডেলটা ব্যান্ডে। মস্তিষ্কের এসব ব্যান্ড সৃজনশীল ভাবনা, স্মৃতির চাপ এবং অর্থগত প্রক্রিয়াজাতকরণের সঙ্গে সম্পর্কিত। গবেষকেরা দেখেছেন, এই দল বেশি মনোযোগী ও কৌতূহলী ছিল।
আর যাঁরা গুগল সার্চ ইঞ্জিন ব্যবহার করেছেন, তাঁদেরও মস্তিষ্কের কার্যকলাপ চ্যাটজিপিটি ব্যবহারকারীদের চেয়ে ভালো দেখা গেছে।
তিনটি প্রবন্ধ লেখার পর অংশগ্রহণকারীদের আগের একটি প্রবন্ধ আবার লিখতে বলা হয়েছিল। যাঁরা চ্যাটজিপিটি ব্যবহার করেছেন, তাঁদের এবার কোনো যন্ত্রের সাহায্য ছাড়াই লিখতে বলা হয়েছিল। যাঁরা আগে কোনো সাহায্য ছাড়া লিখেছেন, তাঁদের লিখতে বলা হয়েছিল চ্যাটজিপিটি ব্যবহার করে। প্রথম দল নিজেদের প্রবন্ধ সম্পর্কে খুব কমই মনে রাখতে পেরেছিল। তাদের মস্তিষ্কপ্রসূত চিন্তার প্রতিফলনও ছিল তুলনামূলক কম। দ্বিতীয় দলের সদস্যরা বিপরীতে ভালো পারফরম্যান্স করেছেন। তাঁরা প্রথমে কোনো সাহায্য ছাড়া নিজেরাই প্রবন্ধ লিখেছেন, পরে চ্যাটজিপিটির সাহায্য নিয়ে তাঁদের প্রবন্ধ হয়েছে আরও উন্নত।
এটি কোসমিনার প্রথম প্রাক্–পর্যালোচনামূলক গবেষণাপত্র। তাঁর দল পূর্ণাঙ্গ পর্যালোচনার জন্য সবকিছু জমা দিয়েছেন। কিন্তু অনুমোদনের জন্য অপেক্ষা করতে চাননি। কারণ, অনুমোদন পেতে প্রায় আট মাস বা তার বেশি মাস লাগতে পারে। কোসমিনা বিশ্বাস করেন, এই সমস্যা এখনই শিশুদের প্রভাবিত করছে। এখনই সচেতন না করলে মানুষ আরও বেশি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রতি আসক্ত হয়ে যেতে পারে।
সমাজ যদি তাৎক্ষণিক সুবিধার জন্য কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ওপর বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়ে, তাহলে দীর্ঘমেয়াদে আমাদের মস্তিষ্কের বিকাশ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
গবেষণাপত্রটি প্রকাশের পর একটি মজার ঘটনা ঘটেছে। বেশ কয়েকজন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারী গবেষণাপত্রটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে সংক্ষিপ্ত করে অনলাইনে পোস্ট করেছেন। কোসমিনা জানতেন যে মানুষ এই কাজটি করবে। তাই তিনি গবেষণাপত্রে ইচ্ছা করেই কয়েকটি ফাঁদ রেখেছিলেন। সেই ফাঁদে পা দিয়েছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাগুলো। যেমন কোসমিনা তাঁর গবেষণাপত্রের কোথাও লেখেননি, তিনি চ্যাটজিপিটির কোন সংস্করণ ব্যবহার করেছেন। কিন্তু এআই যখন সংক্ষিপ্ত সংস্করণ তৈরি করে দিয়েছে, সেখানে উল্লেখ করেছে যে গবেষণাপত্রটি জিপিটি-৪ দিয়ে তৈরি করা।
এটা দেখার পর কোসমিনা হেসে বলেছেন, ‘আমরা ইচ্ছা করেই এই ফাঁদ রেখেছিলাম। কারণ, আমরা নিশ্চিত ছিলাম, এআই এ বিষয়ে ভুল তথ্য দেবে।’
সূত্র: টাইম
কাজী আকাশ