চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের শাস্তি কম যে কারণে

0
8
সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খানের মৃত্যুদণ্ড হলেও একই মামলার অন্য আসামি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের সাজা হয়েছে পাঁচ বছর কারাদণ্ড।

অ্যাপ্রুভার বা রাজসাক্ষী হয়ে মামলার অভিযোগ প্রমাণে ভূমিকা রাখার বিষয়টি সাবেক পুলিশপ্রধান আবদুল্লাহ আল-মামুনের বিরুদ্ধে রায়ের ক্ষেত্রে বিবেচনায় নেওয়া হয় বলে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল জানিয়েছেন।

জুলাই হত্যাকাণ্ড নিয়ে প্রথম মামলার রায় আজ সোমবার দেয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। বিচারপতি গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের এই ট্রাইব্যুনালের অন্য দুই সদস্য হলেন বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারপতি মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী।

এ মামলায় তিন আসামির বিরুদ্ধে মোট পাঁচটি অভিযোগ আনা হয়েছিল। সেগুলো হলো উসকানিমূলক বক্তব্য প্রদান; প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করে আন্দোলনকারীদের নির্মূল করার নির্দেশ; রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদকে গুলি করে হত্যা; রাজধানীর চানখাঁরপুল এলাকায় আন্দোলনরত ছয়জনকে গুলি করে হত্যা এবং আশুলিয়ায় ছয়জনকে পুড়িয়ে হত্যা করা।

রায়ে উসকানিমূলক বক্তব্যের মাধ্যমে মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য শেখ হাসিনাকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে শেখ হাসিনার ‘সুপিরিয়র কমান্ড রেসপনসিবিলিটি’ প্রমাণিত হওয়ায়।

ড্র্রোন ব্যবহার করে আন্দোলনকারীদের অবস্থান শনাক্ত, হেলিকপ্টার ব্যবহার করে গুলি, প্রাণঘাতী গুলি ব্যবহার করে আন্দোলনকারীদের নির্মূল ও গুলি করে হত্যার নির্দেশদাতা হিসেবে সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীকে দেওয়া হয়েছে মৃত্যুদণ্ড। একই অপরাধে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানকেও মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে।

আল মামুনের শাস্তির বিষয়ে ট্রাইব্যুনাল বলেছে, বিচারের ক্ষেত্রে তিনি অবদান রেখেছেন। তাঁর অবদান স্বীকার করার সঙ্গে বস্তুগত সাক্ষ্যপ্রমাণ বিবেচনায় তাঁর সাজা প্রদানের ক্ষেত্রে নমনীয়তা দেখানো হচ্ছে। যেখানে অপরাধের সম্পৃক্ততায় সর্বোচ্চ শাস্তি, কিন্তু তাঁর অবদান বিবেচনায় নিয়ে আদালত তাঁকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

একই অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হলেও পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনকে দেওয়া হয়েছে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড।

রায়ে যে কারণে চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের শাস্তির ঘোষণার সময় বলা হয়, এ মামলার বিচারের ক্ষেত্রে তিনি অবদান রেখেছেন। এমনকি তিনি স্বীকার করেছেন যে তিনি ৩৬ দিনের আন্দালনের সব ঘটনায় সম্পৃক্ত ছিলেন। তাঁর অবদান, স্বীকার করার সঙ্গে বস্তুগত সাক্ষ্যপ্রমাণ বিবেচনায় তাঁর সাজা প্রদানের ক্ষেত্রে নমনীয়তা দেখানো হচ্ছে। যেখানে অপরাধের সম্পৃক্ততায় সর্বোচ্চ শাস্তি। কিন্তু তাঁর অবদান বিবেচনায় নিয়ে আদালত তাঁকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।

এ মামলায় গ্রেপ্তার হওয়া একমাত্র আসামি আবদুল্লাহ আল-মামুন নিজের দোষ স্বীকার করে ‘অ্যাপ্রুভার’ বা রাজসাক্ষী হিসেবে ট্রাইব্যুনালে জবানবন্দি দেন। ট্রাইব্যুনালের ইতিহাসে তিনিই প্রথম রাজসাক্ষী।

চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন জবানবন্দিতে বলেছিলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন দমনে সরাসরি ‘লেথাল উইপন’ (মারণাস্ত্র) ব্যবহার করার নির্দেশ দিয়েছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গত বছরের ১৮ জুলাই শেখ হাসিনার ওই নির্দেশনা তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের মাধ্যমে পেয়েছিলেন তিনি।

মানবতাবিরোধী অপরাধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে আবদুল্লাহ আল-মামুনের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত দুটি মামলা হয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে অন্য মামলায় মোট আসামি ২৩ জন। আসামিরা সবাই পুলিশ ও র‍্যাবের সাবেক সদস্য।

আবদুল্লাহ আল-মামুন ২০২২ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পুলিশপ্রধানের দায়িত্ব পান। চাকরির স্বাভাবিক মেয়াদ অনুযায়ী, ২০২৩ সালের ১১ জানুয়ারি তাঁর অবসরে যাওয়ার কথা ছিল। ২০২৩ সালের ১২ জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ১১ জুলাই পর্যন্ত তাঁকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে আইজিপি পদে রেখে দিয়েছিল শেখ হাসিনার সরকার। ২০২৪ সালের জুলাই মাসে তাঁর মেয়াদ আরও এক বছর বাড়ানো হয়েছিল।

যখন দ্বিতীয়বারের মতো মেয়াদ এক বছর বাড়ানো হয়েছিল, তাতে তিনি আগ্রহী ছিলেন না। ট্রাইব্যুনালে শুনানিতে জেরার সময় তিনি এ কথা বলেছিলেন।

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মামলায় রায় শুনতে আজ সোমবার সকালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে উপস্থিত হন জুলাই যোদ্ধা অনেকে
শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মামলায় রায় শুনতে আজ সোমবার সকালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে উপস্থিত হন জুলাই যোদ্ধা অনেকে

শহীদ পরিবারগুলোর অসন্তোষ

শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খানের মৃত্যুদণ্ডের রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করলেও আবদুল্লাহ আল-মামুনের পাঁচ বছরের কারাদণ্ডের রায় মেনে নিতে পারছেন না শহীদ পরিবারের সদস্যরা। তাঁকে অন্তত যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়ার দাবি জানিয়েছে পরিবারগুলো।

আজ দুপুরে রায় ঘোষণার সময় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সামনে ছিলেন শহীদ পরিবারের সদস্যদের অনেকে। রায়ের পর শহীদ মাহফুজুর রহমান মুগ্ধর ভাই মাহবুবুর রহমান স্নিগ্ধ সাংবাদিকদের বলেন, ‘যে রায় এসেছে, তাতে শহীদ পরিবার ও আহতরা সম্পূর্ণ সন্তুষ্ট হতে পারেনি। সাবেক আইজিপির রায়ের বিরুদ্ধে আমরা উচ্চ আদালতে আপিল করব। তাঁকে ন্যূনতম যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হোক।’

শহীদ মাহামুদুর রহমান সৈকতের বোন সাবরিনা আফরোজ সেবন্তী বলেন, ‘আমরা সাবেক আইজিপির অন্তত যাবজ্জীবন কারাদণ্ড চাই। তবে শুধু রায়ে আমরা সন্তুষ্ট নই, যে দুজনের মৃত্যুদণ্ডের রায় শোনানো হয়েছে, তাঁদের যেখান থেকে পারবে সরকার ধরে নিয়ে আসুক এবং রায় কার্যকর করতে হবে। যতক্ষণ পর্যন্ত তাদের ধরে এনে ফাঁসি না দেওয়া হবে, আমরা আমাদের লড়াই চালিয়ে যাব।’

চৌধুরী আবদুল্লাহ আল–মামুনের অন্তত যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দাবি করেন শহীদ তাহির জামান প্রিয়র মা সামসি আরা জামানও।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.