ইউক্রেনের সঙ্গে যুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর নিষেধাজ্ঞায় পড়েছে রাশিয়া। এতে দেশটির সঙ্গে অন্য দেশের লেনদেনেও দেখা দিয়েছে নানা জটিলতা। এরই ধারাবাহিকতায় রাশিয়ার অর্থায়নে পাবনায় বাস্তবায়নাধীন রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের পরিশোধও আটকে আছে। বকেয়া প্রায় ৩৩০ মিলিয়ন ডলার সরাসরি রাশিয়াকে না দিয়ে পিপলস ব্যাংক অব চায়নার মাধ্যমে পরিশোধের জন্য গত এপ্রিলে দুই দেশের মধ্যে একটি প্রটোকল সই হয়। তবে বাংলাদেশ থেকে চীনে অর্থ পরিশোধের বার্তা পাঠানোর একমাত্র উপায় ‘সুইফট’। এ ব্যবস্থায় অর্থ দিলেই প্রশ্নের মুখে পড়তে হতে পারে– এ কারণে আপাতত পরিশোধ হচ্ছে না বকেয়া।
পরিশোধ জটিলতা নিয়ে গেল মঙ্গলবার বাংলাদেশ ব্যাংকে কয়েকটি বিভাগের মধ্যে একটি বৈঠক হয়। চীনের মাধ্যমে বকেয়া পরিশোধ করলে যে সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে– তা ওই বৈঠকে উঠে আসে। বিষয়টি শিগগিরই সরকারকে জানানো হবে। এরপর পরিশোধের বিকল্প কী হতে পারে– নতুন করে দুই দেশের বৈঠকের পর আবার সিদ্ধান্ত হবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্প বাস্তবায়নে ২০১৬ সালের জুলাইতে রাশান ফেডারেশনের ‘এটমস্ট্রয় এক্সপোর্ট’-এর সঙ্গে বাংলাদেশের ঋণচুক্তি হয়। চুক্তিমূল্যের ৯০ শতাংশ তথা ১ হাজার ১৩৮ কোটি ডলার অর্থায়ন করছে রাশিয়া। প্রকল্পের মূল ঋণ পরিশোধ শুরু হবে ২০২৭ সালের মার্চ থেকে। তবে প্রকল্প ঋণের বাইরে প্রাথমিক কাজের জন্য দেশটি থেকে ৫০ কোটি ডলার ঋণ নেয় বাংলাদেশ। ওই ঋণ পরিশোধ নিয়ে জটিলতা দেখা দিয়েছে। মূলত রাশিয়ার যেসব ব্যাংকের সঙ্গে লেনদেন হয়, তার সবকটি যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার তালিকায় রয়েছে। এ রকম পরিস্থিতিতে কোনো পরিশোধ না করতে গত বছরের ফেব্রুয়ারির শেষে বাংলাদেশকে অনুরোধ জানায় রাশিয়া। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পরিশোধ না হলে কোনো ধরনের জরিমানা, বাড়তি সুদ বা চার্জ না নেওয়ার কথা তখন জানানো হয়েছিল। তবে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ দীর্ঘ হওয়ায় বিভিন্ন ধরনের নিষেধাজ্ঞাও লম্বা হচ্ছে। এ রকম বাস্তবতায় বিকল্প উপায়ে পাওনা আদায়ের চেষ্টা করছে দেশটি।
বিশ্বজুড়ে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যকার লেনদেন নিষ্পত্তির বার্তা পাঠানোর একমাত্র নেটওয়ার্ক সোসাইটি ফর ওয়ার্ল্ডওয়াইড ইন্টারব্যাংক ফাইন্যান্সিয়াল টেলিকমিউনিকেশন বা ‘সুইফট’। বিশ্বের ১১ হাজার ব্যাংক সুইফটের সদস্য।
সংশ্লিষ্টরা জানান, সুইফটের আদলে একটি লেনদেনের বার্তা পাঠানোর মাধ্যম ‘এসপিএফএস’ নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছে রাশিয়া। এ ব্যবস্থায় বাংলাদেশকে যুক্ত করার বিষয়ে ২০১৬ সাল থেকে চেষ্টা করে আসছে দেশটি। তবে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক লেনদেনে আইএমএফ স্বীকৃত পাঁচটি মুদ্রার বাইরে পরিশোধের ব্যাপারে কখনও সম্মত হয়নি। আর ঢাকার পক্ষ থেকে লেনদেন নিষ্পত্তির বিকল্প মাধ্যম হিসেবে দুই দেশের মুদ্রা সোয়াপের প্রস্তাব দিলেও রাশিয়া তাতে রাজি হয়নি। গত এপ্রিলের বৈঠকেও ঢাকার পক্ষ থেকে বলা হয়, লেনদেন সব সময় নিরাপদ ও সুরক্ষা পদ্ধতি চায় বাংলাদেশ; যাতে কোনো ধরনের নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়তে না হয়। যদিও রাশিয়া সব সময়ই তাদের ব্যবস্থায় লেনদেন নিষ্পত্তির কথা বলে আসছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ব্যবসায়ী সহযোগী যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো। বাংলাদেশের মোট রপ্তানি আয়ের ৮০ শতাংশের বেশি আসে এসব দেশ থেকে। দেশের শীর্ষ রেমিট্যান্স আহরণকারী দেশ এখন যুক্তরাষ্ট্র। যে কারণে এসব দেশের বাজারে কোনো ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়ুক, তা কেউই চায় না।
রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্রের বকেয়া পরিশোধ নিয়ে সৃষ্ট জটিলতা নিরসনে ইন্টার-গভর্নমেন্টাল ক্রেডিট অ্যাগ্রিমেন্টের (আইজিসিএ) আওতায় ১০ থেকে ১৩ এপ্রিল দুই দেশের মধ্যে ঢাকায় বৈঠক হয়। ওই বৈঠকে মূলত চারটি বিষয় প্রাধান্য পায়। এর মধ্যে রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্রের পরিশোধ কী পদ্ধতিতে হবে, কমিটমেন্ট চার্জ কমানো, সুদহার হিসাবায়নে মূল চুক্তিতে উল্লিখিত লাইবরের পরিবর্তে এসওএফআর কার্যকর করা এবং আইজিসিএ সংশোধন নিয়ে আলোচনা হয়।
দুই দেশের প্রটোকল চুক্তির আলোচনায় রাশিয়া তাদের নিজস্ব মুদ্রা রুবলে পরিশোধের জন্য অনুরোধ জানালে বাংলাদেশ তা নাকচ করে। বাংলাদেশের তরফ থেকে বলা হয়, আইএমএফ স্বীকৃত এসডিআর বাস্কেটে উল্লিখিত পাঁচটি মুদ্রার বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই। সে আলোকে বকেয়ার সমপরিমাণ চায়নিজ মুদ্রা ইউয়ানে রাশিয়ার দায় পরিশোধের বিষয়ে আলোচনা হয়। এ জন্য ব্যাংক অব চায়নায় বাংলাদেশের পক্ষে এবং রাশিয়ার মিনিস্ট্রি অব ফাইন্যান্সের অনুকূলে একটি করে হিসাব খোলার কথা বলা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক চায়নার ওই হিসাবে অর্থ স্থানান্তর করবে। পরে চায়না রাশিয়াকে দিয়ে দেবে ওই অর্থ। দুই দেশের আলোচনায় বাংলাদেশ জানিয়েছিল, রূপপুর প্রকল্পের পরিশোধ স্থগিত করা হয় রাশিয়ার পরামর্শে। দেশটিকে পরিশোধের সমপরিমাণ অর্থ আলাদা একটি ‘স্ক্রো’ হিসাব খুলে সেখানে জমা রাখা হচ্ছে। ফলে বাংলাদেশের দিক থেকে অর্থ পরিশোধে কোনো সমস্যা নেই। আর চায়না মুদ্রায় বকেয়া দেওয়ার বিষয়ে দুই দেশ আপাতত সম্মত হলেও পরে কোনো সমস্যা দেখা দিলে বিকল্প উপায়ে লেনদেন নিষ্পত্তির বিষয়ে ভার্চুয়াল বা সরাসরি আলোচনা করে সমাধান করা হবে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, দ্বিতীয় দেশের মাধ্যমে পরিশোধ না হলে এখন বিকল্প কী হবে– তা নিয়ে ভাবা হচ্ছে। আর এ ক্ষেত্রে পশ্চিমাদের সঙ্গে সমস্যার সমাধান না হওয়া পর্যন্ত আপাতত পরিশোধ স্থগিত রাখার বিষয়ে চিন্তা চলছে। এ ছাড়া শিগগিরই রাশিয়ার সঙ্গে আবার আলোচনা করে পরিশোধের বিকল্প নিয়ে আলোচনা হবে।
রূপপুর প্রকল্পে রাশিয়া থেকে মালপত্র সরবরাহে সমস্যার বিষয়টি তুলে ধরে গত এপ্রিলে দুই দেশের আলোচনায় বলা হয়, বাকি ৮ কোটি ৮৪ লাখ ডলারের মালপত্র যথাসময়ে সরবরাহ করতে পারবে কিনা, তা এ বছরের ৩০ জুনের মধ্যে জানাতে হবে। যদি তারা মালপত্র সরবরাহ করতে না পারে, তখন ঋণের বাকি অংশ বাতিল হবে। এ জন্য বাংলাদেশ কোনো জরিমানা বা বাড়তি চার্জ দিতে পারবে না। এ ছাড়া প্রকল্পে রাশিয়ার ঋণ ব্যবহারের বার্ষিক লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ব্যবহার না হওয়ার বিষয়টি আলোচনা হয়। ঋণ ব্যবহারে রাশিয়ার লক্ষ্যমাত্রাকে অতি মূল্যায়িত উল্লেখ করে ঢাকার তরফ থেকে জানানো হয়, ২০২০ সাল থেকে প্রতিবছর কমিটমেন্ট ফি বাবদ বাড়তি অর্থ গুনতে হচ্ছে। দুই পক্ষের আলোচনার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত হয়– এখন থেকে আর বছরে আড়াই লাখ ডলারের বেশি কমিটমেন্ট ফি দেবে না ঢাকা।
এ বিষয়ে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের অতিরিক্ত সচিব উত্তম কুমার কর্মকারের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, বাংলাদেশ থেকে পরিশোধের বার্তা পাঠানোর একমাত্র মাধ্যম সুইফট। এর মাধ্যমে চীনে অর্থ দিলে কেন পাঠানো হচ্ছে, তা উল্লেখ থাকতে হবে। রাশিয়ার বকেয়া পরিশোধের জন্য চীনে অর্থ দেওয়ার কথা ওই বার্তায় উল্লেখ থাকলেও সেটি হবে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা নীতির বিপক্ষে। যে কারণে এ নিয়ে নতুন করে ভাবতে হচ্ছে।
ওবায়দুল্লাহ রনি