
পাশের জঙ্গলে হয়তো পাখি ডাকছে, অদূরে ক্ষীণ ধারায় বয়ে চলছে পাহাড়ি ঝরনা। শত শত বছর ধরে এভাবেই চলছিল চীনের ইউনান প্রদেশের একটি পাহাড়ি গ্রামের জীবনধারা। কিন্তু কয়েক বছর ধরে প্রকৃতির এই ছন্দের পতন ঘটিয়েছে লোহালক্কড়ের শব্দ। এখন গ্রামটির নতুন পরিচয় সারা চীনে ছড়িয়ে পড়েছে।
গ্রামটিতে সাত বছর ধরে এক ব্যক্তি পুরোনো লোহা, মোটরসাইকেলের ফেলে দেওয়া ইঞ্জিন আর নির্মাণাধীন ভবনের ভাঙা কাঠামো জুড়ে দিয়ে তৈরি করে চলেছেন বিস্ময়কর সব গাড়ি। এসব গাড়ির কোনো কোনোটি পাহাড়ের উঁচু-নিচু রাস্তায় চলার উপযোগী। কোনোটি উভচর—জলে-স্থলে সমানভাবে চলতে পারে। কোনো কোনোটি দিয়ে অফিসে যেমন যাওয়া যায়, তেমনি আবার মাছও ধরা যায়।
এসব কর্মযজ্ঞের কান্ডারি ৪২ বছর বয়সী চীনের এক ব্যক্তি। তাঁর নাম গু ইউপেং, যিনি অনলাইনে ‘স্ট্রং পিগ’ নামে পরিচিত। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাঁর গাড়ির ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর অনেকে তাঁকে ‘পাহাড়ি উদ্ভাবক’ বলে ডাকছেন। একজন মন্তব্য করেছেন, ‘চীনে প্রতিভার অভাব নেই। দরকার শুধু খুঁজে বের করা।’

শিকড় থেকে শিখরে ওঠার গল্প
উত্তর-পূর্ব চীনের হেইলংজিয়াংয়ের তরুণ গু ইউপেং আগে একটি অটো পার্টস কারখানায় কাজ করতেন। বছর দশেক চাকরি করার পর কারখানার একঘেয়ে উৎপাদনব্যবস্থা থেকে তাঁর মন উঠে যায়। তিনি স্বাধীনভাবে কিছু করতে চাইলেন। ভেবেচিন্তে বড় ঝুঁকির দিকে পা বাড়ালেন।
দুটি ছোট ছোট ব্যবসার উদ্যোগ নিয়ে ব্যর্থ হন ইউপেং। এরপর ২০১৮ সালে মাত্র ৩০ হাজার ইউয়ান (প্রায় ৪ হাজার ২০০ মার্কিন ডলার) নিয়ে চলে আসেন দক্ষিণ-পশ্চিম চীনের ইউনানে। কুনমিং শহর থেকে প্রায় ১০০ কিলোমিটার দূরের পাহাড়ি এক গ্রামে গড়ে তোলেন নিজের একক ওয়ার্কশপ। খাড়া ঢালে ভরা জায়গাটি শুধু নিস্তব্ধই নয়, সেখানে বর্ষায় ভূমিধসের শঙ্কাও ব্যাপক।
তবে এই অঞ্চলে হানি ও নাসা জাতিগোষ্ঠী সদস্যরা শত শত বছর ধরে ‘টেরেস পদ্ধতিতে’ চাষাবাদের মাধ্যমে জলবৈচিত্র্য টিকিয়ে রেখেছে। টেরেস পদ্ধতি হলো সিঁড়ির মতো ধাপে ধাপে তৈরি ধানখেত।
এই পদ্ধতিতে পাহাড়ি ঢালে মাটি কেটে এমনভাবে ধানখেত তৈরি করা হয়, যেন প্রতিটি ধাপ সমতল থাকে এবং পানি ধরে রাখা যায়। এতে পানি পাহাড় থেকে নিচে নামার সময় প্রতিটি স্তরে জমা হয় এবং ধানের জন্য প্রয়োজনীয় সেচ নিশ্চিত হয়। গু ইউপেং স্থানীয়দের এই চাষাবাদপদ্ধতি থেকেও অনুপ্রেরণা লাভ করেছেন। তাঁর ভাষায়, ‘কাজের অন্যতম অনুপ্রেরণা।’

সব কাজের কাজি
ইউপেং নিজেই গাড়ির নকশা করেন, কাঠামো জোগাড় করেন, লোহা কাটেন এবং ওয়েল্ডিং করেন। যন্ত্রাংশ চালানোর প্রয়োজনীয় সফটওয়্যার কোড বা কন্ট্রোল প্রোগ্রামও তিনি তৈরি করেন। কোনো ধরনের আনুষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ ছাড়া সবকিছু তিনি নিজের চেষ্টায় শিখেছেন। পরিত্যক্ত ইস্পাত, পুরোনো মোটরসাইকেলের শক-অ্যাবসর্বার, ঘরবাড়ি নির্মাণের আই-বিম—এই সবকিছু তাঁর কাছে মূল্যবান উপাদান।
খরচ বাঁচাতে বলতে গেলে নতুন কিছুই কেনেন না গু ইউপেং। গড়ে প্রতি ১০-১১ দিনে একটি গাড়ি তৈরি করেন তিনি। এই ধারাবাহিকতায় সাত বছরে তিনি তৈরি করেছেন ৩০০–এর বেশি গাড়ি।

গাড়ির জাদু
ইউপেংয়ের সবচেয়ে আলোচিত গাড়িগুলোর একটি ‘অল-টেরেন বেড-কার’। এটি ৪৫ ডিগ্রি খাড়া ঢাল বেয়ে উঠতে পারে, ১ দশমিক ৫ মিটার চওড়া খাদ অনায়াসে পার হয়ে যেতে পারে এবং সিঁড়িও ডিঙাতে পারে। গাড়িটিতে গুটিয়ে রাখার মতো (ফোল্ডেবল) বিছানা রয়েছে, ফলে কেউ চাইলে এতে শুয়ে শুয়েই পাহাড় পার হতে পারবেন।
ইউপেংয়ের আরেকটি বিখ্যাত উদ্ভাবন ‘ওয়ার্ক-ডেস্ক ভেহিকল’। এটি একটি ছোট চলমান অফিস। বড় হাতলওয়ালা চেয়ার, ডেস্ক, টেবিল ল্যাম্পসহ পুরো কাঠামোটি এমনভাবে বানানো, যাতে পানিতে ভাসতে পারে। পাশে গ্রিল আর মাছ ধরার যন্ত্র বসানো, যাতে মাঝপথে কাজের বিরতিতে নিজের ধরা মাছ ভাজা খাওয়া যায়!

নেট–দুনিয়ার প্রিয় ‘স্ট্রং পিগ’
ইউপেং চীনের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দৌউইনে (চীনের টিকটক) ‘শিয়াংঝু’ বা ‘স্ট্রং পিগ’ নামে পরিচিত। তাঁর অনুসারীর সংখ্যা ২৯ লাখের বেশি। এতে বিভিন্ন ভিডিওতে দেখা যায়, ইউপেং কখনো লোহা কাটছেন, গাড়ি চালিয়ে পরীক্ষা করে দেখছেন, কখনোবা পেছনের ডিজাইন ট্যাব খুলে দেখাচ্ছেন। ‘ডিজাইন ট্যাব’ বলতে বোঝায়, নকশার সেই অংশ, যেখানে মূল কাজের খুঁটিনাটি বা নির্মাণের পদ্ধতি, উপাদান ও ধাপগুলো দেখানো হয়।
দৌউইনে একবার একজন লিখেছিলেন, ‘একটা উড়ুক্কু আবর্জনাপাত্র বানাতে পারেন?’ তা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ইউপেং সত্যি বানিয়ে ফেলেছেন প্রপেলারে চলা এক ট্র্যাশক্যান! দৌউইনের ব্যক্তির সংক্ষিপ্ত পরিচিতিমূলক বিবরণে (প্রোফাইল বায়ো) ইউপেং লিখেছেন, ‘জীবন মানেই পরীক্ষা-নিরীক্ষা আর আনন্দ।’

নতুন চিন্তার প্রতিচ্ছবি
২০১৫ সালের পর চীনের সরকার ‘সাংহুয়ান স্যাংচুয়াং’ নামে একটি কর্মসূচি চালু করে, যার মূল লক্ষ্য—উদ্ভাবক, উদ্যোক্তা ও শিল্পপতিদের একত্র করে গ্রামীণ অর্থনীতিকে চাঙা করা। ইউনান, সিচুয়ান, গুইঝু প্রদেশে ‘মেকার’ সংস্কৃতি এখন নতুন উদ্যোক্তাদের হাতে রূপ নিচ্ছে পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ও স্থানীয় উৎপাদনের মেলবন্ধনে। ‘মেকার’ সংস্কৃতি হলো এমন একটি সামাজিক ও প্রযুক্তিগত প্রবণতা, যেখানে মানুষ নিজেরা নতুন কিছু তৈরি করে।
ইউপেংয়ের কাজও সেই ‘মেকার’ সংস্কৃতির অংশ। তাঁর গাড়িগুলো প্রোটোটাইপ হলেও সাম্প্রতিক সময়ে তিনি তিনটি বেড-কার ৪০ হাজার ইউয়ান করে বিক্রি করেছেন বলে জানিয়েছে তাঁর এক বন্ধু। প্রোটোটাইপ বলতে বোঝায় কোনো নতুন পণ্য, যন্ত্র বা ডিজাইনের পরীক্ষামূলক প্রথম নমুনা বা মডেল।

পরিবেশবান্ধব উদ্ভাবন
চীনে পুনর্ব্যবহারযোগ্য উপাদানে তৈরি প্রযুক্তি এখন পরিবেশনীতির অগ্রাধিকার। তাই অনেক গবেষক ইউপেংয়ের গাড়িগুলোকে শুধু উদ্ভাবন নয়, বরং শহরের যান্ত্রিক বর্জ্য কমানোর সম্ভাব্য উপায় হিসেবেও দেখছেন। ইউনানের পরিবেশবিজ্ঞানী চাও মিং সিং বলেন, ‘এই মডেল গ্রামীণ অঞ্চলে বাস্তবসম্মত উদাহরণ হতে পারে।’
প্রত্যাশা
ইউপেং বলেন, ‘আমি এখন অনেক কিছু করতে চাই। আমি এমন একটি যানবাহন তৈরি করতে চাই, যা জল-স্থল-আকাশে চলতে পারবে।’ তাই তিনি এখন ড্রোনপ্রযুক্তি শেখার চেষ্টা করছেন। পুরোনো কোয়াডকপ্টারের মোটর দিয়ে তিনি একটি ছোট ফ্লাইং-কার বানাতে চান, যা দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চলে ওষুধ পৌঁছে দিতে পারবে।
পাহাড়ের হানি সম্প্রদায়ের কৃষক লি হুয়ান বলেন, ‘বর্ষায় আমাদের রাস্তা ভেঙে যায়। তখন ইউপেংয়ের বানানো ট্রাক আমাদের ধান বা অসুস্থ মানুষদের নিয়ে আসে। এটাই আমাদের অ্যাম্বুলেন্স।’

গুরুত্ব
চীনে কর্মসংস্থানের নতুন ক্ষেত্রগুলো মূলত কম উন্নত পশ্চিম ও দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে তৈরি হচ্ছে। ইউনানের মতো প্রদেশে ‘মেকার’ সংস্কৃতি যেন প্রচলিত শিল্পচর্চার বিকল্প হয়ে ওঠে, এমনটাই চায় সরকার। ইউপেংয়ের গল্প তাই শুধু অদ্ভুত গাড়ির গল্প নয়, বরং মানুষের কৌতূহল, পুনর্ব্যবহার ও ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম থেকে জীবিকা তৈরির উপাখ্যান।
ইউনানের পাহাড়ে বসে পরবর্তী উদ্ভাবনের জন্য এখনো ধাতুর টুকরা জোড়া লাগিয়ে যাচ্ছেন ইউপেং। উদ্ভাবনের আশায় দিন-রাত একাকার করে কাজ করে যাচ্ছেন এই ‘স্ট্রং পিগ’। কে জানে, আগামী সপ্তাহেই হয়তো তাঁর বানানো ফ্লাইং অফিস সত্যিই আকাশে ওড়বে!
তথ্যসূত্র: সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট, নিউজবাইটস, দ্য স্টার (মালয়েশিয়া), চায়না ডেইলি।