
আজ বুধবার চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং বেইজিংয়ে এক বিশাল সামরিক কুচকাওয়াজে সভাপতিত্ব করেন। যুদ্ধবিমান, ক্ষেপণাস্ত্র এবং সমন্বিত শৃঙ্খলাপূর্ণ কুচকাওয়াজরত সৈন্যদল প্রদর্শন করা হয়। সি চিন পিং এ আয়োজনের মাধ্যমে প্রতিপক্ষ দেশগুলোকে সরাসরি হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। এর মাধ্যমে তিনি বার্তা দিয়েছেন, খবরদার, চীনের সার্বভৌমত্বকে কেউ চ্যালেঞ্জ করতে এসো না।
মঞ্চে সির পাশে উপস্থিত অতিথিরা এ বার্তাকে আরও শক্তিশালী করেছেন। তাঁকে ঘিরে ছিলেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন, উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং-উন এবং ইরান, পাকিস্তানসহ বেশির ভাগ কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রের নেতারা। তাঁরা সবাই এমন নেতা, যাঁদের মার্কিন নেতৃত্বাধীন বৈশ্বিক শাসনব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন আছে। তাঁরা মার্কিন মোড়লগিরি মানতে চান না।
কুচকাওয়াজে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবসানের ৮০তম বার্ষিকী উপলক্ষে ৮০ বার কামানের গোলা ছোড়া হয়। সেনারা চীনের জাতীয় পতাকা হাতে তিয়েনআনমেন স্কয়ারের লাল কার্পেটের ওপর দিয়ে কুচকাওয়াজ করেন। জাতীয় সংগীত চলাকালে দর্শকেরা ছোট পতাকা নেড়ে অভিবাদন জানান। পতাকা উত্তোলনের পর আকাশে ৮০ হাজার কবুতর ও ৮০ হাজার বেলুন ছেড়ে দেওয়া হয়।
এ কুচকাওয়াজ ছিল চীনা কমিউনিস্ট পার্টির কয়েক সপ্তাহব্যাপী প্রচারণার কেন্দ্রবিন্দু। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল জাতীয়তাবাদ উসকে দেওয়া, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে চীনের ভূমিকা আবার তুলে ধরা এবং বিদেশি আগ্রাসী শক্তির (বিশেষ করে জাপান) বিরুদ্ধে চীনের কমিউনিস্ট পার্টি ও দেশের রক্ষকরূপে চীনের ভূমিকা প্রমাণ করা।
যুদ্ধের স্মৃতি ব্যবহার করে চীনের সরকার দেশের জনগণের সমর্থন জোগাড় করছে, বিশেষত এমন এক সময়ে, যখন অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে উত্তেজনা বেড়েই চলেছে। চীনকে দমন করার চেষ্টা করার জন্য সি প্রকাশ্যে যুক্তরাষ্ট্রকে অভিযুক্ত করেছেন।
তিয়েনআনমেন গেটের মঞ্চ থেকে সি চিন পিং ঘোষণা করেন, চীনা জাতি এক মহান জাতি। এই জাতি কোনো অত্যাচারকে ভয় পায় না এবং নিজের শক্তিতে দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে থাকে। তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ত্যাগ–তিতিক্ষা এবং আজকের চীনের চ্যালেঞ্জের মধ্যে সরাসরি যোগসূত্র টানেন।
তিনি বলেন, ‘অতীতে ন্যায় ও অন্যায়, আলো ও অন্ধকার, অগ্রগতি ও পশ্চাৎপদতার লড়াইয়ে জীবন বাজি ধরে চীনা জনগণ ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রতিরোধ গড়েছে। আজও আমরা শান্তি, সংলাপ ও অগ্রগতির পক্ষে অবস্থান নেব।’
ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের জন এল থর্নটন চায়না সেন্টারের পরিচালক রায়ান হাস বলেছেন, সি চিন পিং চীনকে একটি কেন্দ্রীয় বৈশ্বিক শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছেন। তিনি আন্তর্জাতিক ব্যবস্থাকে এমনভাবে বদলে দিতে চাচ্ছেন, যা চীনের স্বার্থ প্রতিষ্ঠায় কাজ করবে। এ অনুষ্ঠানে অন্য শক্তিধর নেতাদের উপস্থিতি তাঁর লক্ষ্য অর্জনের দিকে এগোচ্ছে বলে প্রমাণ দেয়।
অনুষ্ঠানজুড়ে ছিল নানা প্রতীকী আয়োজন। এসব আয়োজন বর্তমান কমিউনিস্ট পার্টিকে বিপ্লবী অতীতের সঙ্গে যুক্ত করেছে। সি চিন পিং ওই অনুষ্ঠানে মাও স্টাইলের পোশাক পরে হাজির হন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন বর্তমান ও সাবেক শীর্ষ চীনা নেতারা। পরে তিনি চীনে তৈরি ‘রেড ফ্ল্যাগ’ লিমুজিনের খোলা সানরুফে দাঁড়ান। এটি মাও আমলের স্মৃতি বহন করে এবং চীনের শিল্প স্বনির্ভরতার উচ্চাকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করে।
সি চিন পিং পিপলস লিবারেশন আর্মির সেনাদের সঙ্গে কথা বলেন। তিনি কুচকাওয়াজ পরিদর্শন করেন এবং বলেন, ‘কমরেডরা, শুভেচ্ছা! কমরেডরা, তোমরা কঠোর পরিশ্রম করছ!’
সেনারা যখন গাড়ির পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন, তাঁরা একসঙ্গে মাথা ঘুরিয়ে স্যালুট জানান এবং স্লোগান দেন, ‘দলকে অনুসরণ করো! জয়ের জন্য লড়ো!’

যুদ্ধপ্রস্তুতি প্রদর্শন করতে বন্দুক হাতে সেনারা দৌড়ে ট্যাংক ও মিসাইলবাহী যানগুলোর পাশ দিয়ে দ্রুত তাঁদের যানবাহনে ওঠেন।
চীন ও রাশিয়া কীভাবে তাদের ইতিহাসকে একত্রে উপস্থাপন করছে, তা এখানে পুতিনের উপস্থিতি স্পষ্ট করেছে। উভয় দেশই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকে নিজেদের আত্মত্যাগের প্রমাণ হিসেবে দেখাচ্ছে এবং যুদ্ধের পরবর্তী আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় আরও বেশি প্রভাব দাবি করছে।
আমেরিকান ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক জোসেফ টরিজিয়ান বলেন, ‘সি ও পুতিন দুজনই বিশ্বাস করেন, যুদ্ধের জয় অনেক মূল্য দিয়ে এসেছে, কিন্তু তা সম্পূর্ণ হয়নি। তাঁরা মনে করেন, “প্রভুত্ববাদী শক্তি” এখনো বিদেশি মডেল চাপিয়ে দিতে চায় এবং বিশ্বে তাদের প্রাপ্য অবস্থান আটকাতে চায়। তাঁরা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে পশ্চিমা মূল্যবোধ থেকে দূরে রাখতে এবং নিজেদের কল্পিত বিশ্বব্যবস্থাকে বৈধতা দিতে যুদ্ধের স্মৃতি ব্যবহার করতে চান।’
সি ভাষণে জাতীয় সার্বভৌমত্ব ও ভূখণ্ডের অখণ্ডতা রক্ষা করতে প্রতিশ্রুতি দেন এবং বলেন, চীনা মুক্তি সেনা সব সময়ই এক নায়কসুলভ শক্তি, যার ওপর দল ও জনগণ পুরোপুরি নির্ভর করতে পারে।
সি চিন পিংয়ের এ বার্তার প্রতিক্রিয়া তাৎক্ষণিকভাবে পাওয়া গেছে। অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার কয়েক মিনিটের মধ্যেই প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ওয়াশিংটন থেকে অভিযোগ করেন, সি যুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তার কথা উল্লেখ করেননি। ট্রাম্প তাঁর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ‘ট্রুথ সোশ্যাল’-এ লেখেন, ‘সি কি কখনো উল্লেখ করবেন যে কীভাবে যুক্তরাষ্ট্র চীনের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে বিপুল সহায়তা এবং রক্ত দিয়েছে?’ তিনি আরও যোগ করেন, ‘যখন তোমরা যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছ, তখন ভ্লাদিমির পুতিন ও কিম জং–উনকে আমার উষ্ণ শুভেচ্ছা পাঠাও।’
বাস্তবে সি চিন পিংয়ের এ সাড়ম্বর আয়োজন কেবল অতীত স্মরণে আটকে ছিল না, এটি চীনের ‘অপ্রতিরোধ্য’ উত্থান সম্পর্কে পশ্চিমা বিশ্বের প্রতি বার্তা ছিল। সামরিক প্রদর্শনীতে জাহাজ ধ্বংসকারী নতুন মিসাইল, জলরাশির নিচে কাজ করা ড্রোন এবং ক্রু ছাড়াই যুদ্ধ চালানো বিমান প্রদর্শিত হয়। এগুলোকে চীনের সামরিক উদ্ভাবনের প্রমাণ হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। এভাবে চীন ধীরে ধীরে এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক প্রাধান্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করছে। সি তাইওয়ান ও তার আন্তর্জাতিক সমর্থকদেরও ইঙ্গিত দিয়েছেন—তাইওয়ান স্বাধীনতা লাভের যেকোনো চেষ্টা করলে, তা হবে বিপজ্জনক।

সি ভাষণে জাতীয় সার্বভৌমত্ব ও ভূখণ্ডের অখণ্ডতা রক্ষা করতে প্রতিশ্রুতি দেন এবং বলেন, চীনা মুক্তি সেনা সব সময়ই এক নায়কসুলভ শক্তি, যার ওপর দল ও জনগণ পুরোপুরি নির্ভর করতে পারে।
অনুষ্ঠানে অতিথিদের উপস্থিতি দেখিয়েছে, বেইজিং ও পশ্চিমা বিশ্বের মধ্যে দূরত্ব কতটা বেড়েছে। উল্লেখ করার মতো বিষয় হলো, সেখানে যুক্তরাষ্ট্রসহ প্রধান পশ্চিমা গণতান্ত্রিক দেশগুলোর উচ্চপর্যায়ের কোনো প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন না। তবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও মধ্য এশিয়ার অনেক দেশের নেতারা সেখানে উপস্থিত ছিলেন। এটি আঞ্চলিক অংশীদারি শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে চীনের সাফল্য প্রমাণ করে।
ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের জন এল থর্নটন চায়না সেন্টারের পরিচালক রায়ান হাস বলেছেন, সি চিন পিং চীনকে একটি কেন্দ্রীয় বৈশ্বিক শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছেন। তিনি আন্তর্জাতিক ব্যবস্থাকে এমনভাবে বদলে দিতে চাচ্ছেন, যা চীনের স্বার্থ প্রতিষ্ঠায় কাজ করবে। এ অনুষ্ঠানে অন্য শক্তিধর নেতাদের উপস্থিতি তাঁর লক্ষ্য অর্জনের দিকে এগোচ্ছে বলে প্রমাণ দেয়।
- ডেভিড পিয়ারসন নিউইয়র্ক টাইমসের সাংবাদিক। তিনি মূলত চীনের পররাষ্ট্রনীতি এবং চীনের অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড নিয়ে রিপোর্ট করেন
নিউইয়র্ক টাইমস থেকে নেওয়া। অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ