চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরী হত্যা মামলায় ফরেনসিক চিকিৎসকসহ তিনজন আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছেন। এ নিয়ে মামলার ৩৮ জন সাক্ষীর মধ্যে নয়জনের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়েছে। আগামী ২৬ নভেম্বর মামলার পরবর্তী সাক্ষ্যগ্রহণের দিন ধার্য করেছেন আদালত। এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন আসামিপক্ষের আইনজীবী ফারুক আহম্মেদ।
যে তিনজন আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছেন, তাঁরা হলেন কুমিল্লা-৮ আসনের সংসদ সদস্য নাছিমুল আলম চৌধুরী, ফরেনসিক চিকিৎসক বেলায়েত হোসেন খান ও আহমেদ সাঈদ।
আদালতের সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটর (এপিপি) সাদিয়া আফরিন বলেন, মামলার ৩৮ জন সাক্ষীর মধ্যে ৬ জন মারা গেছেন। মামলাটি হওয়ার প্রায় ২৪ বছর পর গত বছর সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়।
১৯৯৮ সালের ১৭ ডিসেম্বর রাজধানীর বনানীর ট্রাম্প ক্লাবের সামনে সোহেল চৌধুরীকে গুলি করে হত্যা করেন সন্ত্রাসীরা। পরে গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) তদন্তে উঠে আসে আলোচিত ব্যবসায়ী আজিজ মোহাম্মদ ভাই, ট্রাম্প ক্লাবের মালিক বান্টি ইসলাম ও আশীষ রায় চৌধুরীর সঙ্গে বিরোধের জেরে ভাড়াটে খুনিদের দিয়ে সোহেল চৌধুরীকে খুন করা হয়। খুন হওয়ার পরের বছর আশীষ রায় চৌধুরীসহ নয়জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। এর দুই বছর পর ২০০১ সালে বিচার শুরুর আদেশ হয়। ওই আদেশ চ্যালেঞ্জ করে এক আসামি উচ্চ আদালতে গেলে আটকে যায় বিচার কার্যক্রম। পরে উচ্চ আদালতের আদেশে আবার বিচার কার্যক্রম গত বছর শুরু হয় বলে জানিয়েছেন রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি।
১৭ বছর আগে ঢাকা মহানগরের পিপি দপ্তর থেকে সোহেল হত্যা মামলার তদন্তের নথিপত্র কেস ডকেট (সিডি) নিয়ে যান পুলিশের তৎকালীন পরিদর্শক ফরিদ উদ্দিন। আদালতের নির্দেশের পরও তিনি সেই সিডি আদালতে উপস্থাপন করতে পারেননি বলে জানান এপিপি সাদিয়া।
মামলার কাগজপত্র ও পুলিশের কাছে দেওয়া সাক্ষীদের জবানবন্দির তথ্য বলছে, বনানীর ট্রাম্প ক্লাবে গান বন্ধ করা নিয়ে ১৯৯৮ সালের ২৪ জুলাই আজিজ মোহাম্মদ ভাই, বান্টি ইসলাম ও বান্টির বন্ধু আশীষ রায় চৌধুরীর সঙ্গে চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরীর বিরোধের শুরু। এর জেরেই ট্রাম্প ক্লাবের সামনে ঢাকার তৎকালীন শীর্ষ সন্ত্রাসীদের দিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয় সোহেল চৌধুরীকে।
অভিযোগপত্রে বলা হয়, সোহেল চৌধুরী মসজিদ কমিটির লোকজন নিয়ে ক্লাব বন্ধ করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। ট্রাম্প ক্লাবের কাজ ব্যাহত হলে সোহেল চৌধুরীকে দেখে নেওয়ার হুমকি দেন আসামিরা। পরে তখনকার ঢাকার অন্যতম শীর্ষ সন্ত্রাসী তারিক সাঈদ ওরফে মামুন, হারুন অর রশীদ ওরফে লেদার লিটন ও শীর্ষ সন্ত্রাসী সানজিদুল ইসলাম ওরফে ইমন চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরীকে গুলি করে হত্যা করেন। তখনকার গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, ট্রাম্প ক্লাবে শীর্ষ সন্ত্রাসীদের যাতায়াত ছিল।
সোহেল চৌধুরীর মা নূরজাহান বেগম তখন বলেছিলেন, তাঁদের বাসার উল্টো দিকে ট্রাম্প ক্লাব। হত্যাকাণ্ডের দিন রাত দুইটায় সোহেল বাসায় ফেরেন। ক্লাবের সামনে জামে মসজিদ। পরে সোহেল আবার ক্লাবে গেলে সন্ত্রাসীরা তাঁকে দুটি গুলি করে। তাতে তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন।
সোহেলের তৎকালীন গাড়িচালক আবুল কালাম তখন পুলিশকে জানিয়েছিলেন, সোহেলসহ সাত থেকে আটজন লোক ক্লাবের সামনে গেলে হঠাৎ গুলি করে সন্ত্রাসীরা। গুলি করার পর ইমন, মামুন, লিটন, ফারুক গাড়িতে করে পালিয়ে যান।
মূল আসামিরা কে কোথায়
আসামিদের মধ্যে আজিজ মোহাম্মদ ভাই অন্যান্য ব্যবসার বাইরে চলচ্চিত্র প্রযোজনা করতেন। চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরী খুন হওয়ার দুই বছর আগে রাজধানীর ইস্কাটনের বাসায় চিত্রনায়ক সালমান শাহর মৃত্যু হয়। তখন সালমানের মা অভিযোগ করেন, খুনের পেছনে আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের হাত রয়েছে। সে সময় চলচ্চিত্রকেন্দ্রিক নানা ঘটনায় তিনি আলোচিত ছিলেন। চার বছর আগে (২০১৯ সালে) রাজধানীর গুলশানে আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের বাসায় অভিযান চালিয়ে বিদেশি মদ, সিসা উদ্ধার করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। সোহেল চৌধুরী খুনের ঘটনায় গ্রেপ্তার হওয়ার পর জামিন নিয়ে দেশ ছেড়েছিলেন তিনি। বর্তমানে তিনি থাইল্যান্ডে বসবাস করছেন।
এ ছাড়া গত বছরের ৬ এপ্রিল দেশের মধ্যে পালিয়ে থাকা পলাতক আসামি আশীষ রায় চৌধুরী ওরফে বোতলকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। তাঁর গুলশানের বাসা থেকে বিদেশি মদ উদ্ধার করা হয়। তিনি একাধিক বেসরকারি এয়ারলাইনসের ঊর্ধ্বতন পদে ছিলেন। সর্বশেষ তিনি জিএমজি এয়ারলাইনসের প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা (সিওও) ছিলেন।
কারাগারে আছেন আশীষ রায় চৌধুরী ও শীর্ষ সন্ত্রাসী সানজিদুল ইসলাম ওরফে ইমন। আর জামিনে আছেন আসামি ফারুক আব্বাসী। পলাতক আজিজ মোহাম্মদ ভাই ও সেলিম খানের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন আদালত।
সোহেল চৌধুরী হত্যা মামলায় অভিযুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসী তারিক সাঈদ ওরফে মামুন তিন মাস আগে জামিনে ছাড়া পান। ১৮ সেপ্টেম্বর রাজধানীর তেজগাঁও এলাকায় সন্ত্রাসী হামলায় গুলিবিদ্ধ হন তিনি।