চালকদের শেখাতে ৩০০ ‘প্রশিক্ষক’ তৈরি হচ্ছে, খরচ ৫৩ লাখ টাকা

0
10
বুয়েটের নকশা করা এসব ব্যাটারিচালিত রিকশা ঢাকার প্রধান সড়ক বাদে পাড়া-মহল্লার অলিগলিতে চালানোর অনুমতি দেওয়া হবে। ঢাকা উত্তর সিটির নগর ভবনের সামনে থেকে বৃহস্পতিবার তোলা

রাজধানীর রাস্তায় চলাচলে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) যন্ত্রকৌশল বিভাগের একটি দলের নকশা করা রিকশা অনুমোদন দিচ্ছে সরকার। ওই রিকশা চালাতে চালকদের দেওয়া হবে প্রশিক্ষণ ও লাইসেন্স। চালকেরা প্রশিক্ষণ নিয়ে লাইসেন্স পাওয়ার পর ঢাকার প্রধান সড়ক বাদে পাড়া-মহল্লার অলিগলিতে এসব রিকশা চালানোর অনুমতি পাবেন।

নতুন নকশার ব্যাটারিচালিত এসব রিকশা চালাতে রিকশাচালকদের যাঁরা প্রশিক্ষণ দেবেন, সরকারিভাবে সেই প্রশিক্ষকদের প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এমন ৩০০ জন প্রশিক্ষকের বা ‘মাস্টার ট্রেইনারের’ প্রশিক্ষণে ব্যয় করা হচ্ছে মোট ৫৩ লাখ ৮০ হাজার টাকা। প্রথম দফায় ২০০ জন প্রশিক্ষককে তিন দিনব্যাপী এ প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে আগামীকাল শনিবার এবং রবি ও সোমবার (২৮, ২৯ ও ৩০ জুন)।

রিকশা চালানোর প্রশিক্ষকদের প্রশিক্ষণ বাবদ এ অর্থ ব্যয় করা হচ্ছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) থেকে। ডিএনসিসি সূত্রে জানা গেছে, প্রশিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের রোড সেফটি প্রোগ্রামকে। ব্র্যাকের ২৩ জন প্রশিক্ষক তাঁদের প্রশিক্ষণ দেবেন।

ঢাকা উত্তর সিটি ও ব্র্যাক সূত্রে জানা গেছে, রিকশা চালানোর প্রশিক্ষক হতে নির্বাচিত ৩০০ জনের মধ্যে ২০০ জনের তালিকা দেওয়া হয়েছে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর থেকে। এর মধ্যে ১৭৫ জন হলেন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থী, যাঁরা ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। বাকি ১০০ জন হলেন পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের প্রতিনিধি।

বুয়েটের নকশা করা এসব ব্যাটারিচালিত রিকশা চালানোর বিষয়ে চালকদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য ৩০০ প্রশিক্ষক তৈরিতে প্রশিক্ষণ শুরু হচ্ছে আগামীকাল শনিবার। তিন দিনের প্রশিক্ষণ নিয়ে তাঁরা চালকদের প্রশিক্ষণ দেবেন। ঢাকা উত্তর সিটির নগর ভবনের সামনে থেকে বৃহস্পতিবার তোলা
বুয়েটের নকশা করা এসব ব্যাটারিচালিত রিকশা চালানোর বিষয়ে চালকদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য ৩০০ প্রশিক্ষক তৈরিতে প্রশিক্ষণ শুরু হচ্ছে আগামীকাল শনিবার। তিন দিনের প্রশিক্ষণ নিয়ে তাঁরা চালকদের প্রশিক্ষণ দেবেন। ঢাকা উত্তর সিটির নগর ভবনের সামনে থেকে বৃহস্পতিবার তোলাছবি: প্রথম আলো

এ বিষয়ে ব্র্যাকের রোড সেফটি প্রোগ্রামের ব্যবস্থাপক মতিউর রহমান বলেন, তিন দিনের প্রশিক্ষণে মাস্টার ট্রেইনারদের মূলত তাঁরা ব্যাটারিচালিত রিকশাচালকদের যেসব বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেবেন, সেগুলোই শেখানো হবে। এ–সংক্রান্ত বিষয়ের ওপর প্রশিক্ষকদের জন্য একটি উপস্থাপনা তৈরি করে দেওয়া হয়েছে। প্রথমে তাঁরা ওই সব বিষয়ে নিজেরা প্রশিক্ষণ নেবেন এবং পরে রিকশাচালকদের প্রশিক্ষণ দেবেন। পাশাপাশি একজন প্রশিক্ষকের যেসব দক্ষতা ও গুণাবলি থাকা লাগে, সেগুলোও শেখানো হবে।

তিন দিনের প্রশিক্ষণের সূচি নিয়ে মতিউর রহমান বলেন, প্রথম দিন প্রশিক্ষণের জন্য তৈরি করে দেওয়া উপস্থাপনার বিষয়গুলো প্রশিক্ষকদের শেখানো হবে। দ্বিতীয় দিন সকাল থেকে তৃতীয় দিন প্রায় দুপুর পর্যন্ত প্রশিক্ষক হিসেবে রিকশাচালকদের তাঁরা যেভাবে শেখাবেন, সেগুলো চর্চা করানো হবে। যাতে সবার সামনে কথা বলার দক্ষতা ও অভ্যাস তৈরি হয়। শেষ দিন দুপুরের পর বুয়েটের নকশা করা ব্যাটারিচালিত রিকশার কারিগরি বিষয়ের ওপর তৈরি করা উপস্থাপনা শেখানো হবে। যাতে একজন চালক ওই রিকশা সম্পর্কে জানতে পারেন এবং রিকশাটি সঠিকভাবে চালাতে পারেন।

প্রশিক্ষকদের যোগ্যতার বিষয়ে মতিউর রহমান বলেন, তিন দিনের প্রশিক্ষণটা অনেক কম সময়ের। এর মধ্যে মাস্টার ট্রেইনাররা হয়তো এত ক্যাপাবল (সক্ষম) হতে পারবেন না। তবে একজন প্রশিক্ষকের ন্যূনতম কিছু যোগ্যতা লাগে। সে অনুযায়ী প্রশিক্ষণ নিয়ে যাতে প্রশিক্ষণ দিতে পারেন, সে জন্য ন্যূনতম স্নাতক পর্যায়ে অধ্যয়ন করছেন কিংবা স্নাতক শেষ করেছেন এমন শিক্ষার্থীদের নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের বিভিন্ন কর্মসূচির প্রশিক্ষকেরাও এ প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন।

রিকশার সর্বোচ্চ গতির বিষয়ে জানতে চাইলে এই কর্মকর্তা বলেন, সিটি করপোরেশন থেকে একটি খসড়া প্রবিধান করা হয়েছে, যা এখনো চূড়ান্ত হয়নি। সেই নীতিমালা অনুযায়ী, প্রতি ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ৩০ কিলোমিটার গতিতে রিকশা চালানো যাবে। কিছু সড়কে সর্বোচ্চ গতি ঘণ্টায় ১৫-২০ কিলোমিটার নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। এটা আইন প্রয়োগের মাধ্যমে নিশ্চিত করতে হবে।

তবে রিকশাচালকেরা যেহেতু অলিগলিতে রিকশা চালাবেন, তাই নজরদারির মধ্যে আনা হয়তো এখনো সম্ভব হবে না। এ ক্ষেত্রে জরুরি হচ্ছে, রিকশাচালকদের আত্মোপলব্ধি তৈরি করা। অর্থ উপার্জনকারী হিসেবে তাঁরা যাতে নিজেদের নিরাপত্তার কথা ভাবেন, পাশাপাশি যাত্রীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করেন, অন্য চালকের ভুলেও দুর্ঘটনা হয়, গতি থামানোর জন্য যে সময় প্রয়োজন, মোড় নেওয়া, ডানে-বাঁয়ে যাওয়া—এসব বিষয়ে সচেতন করা হবে।

ব্র্যাকের পক্ষ থেকে জানানো হয়, প্রশিক্ষণের সময় দৈনিক ভাতা বাবদ প্রত্যেক প্রশিক্ষকের জন্য এক হাজার টাকা দেওয়া হবে। এর সঙ্গে প্রশিক্ষণ চলাকালে খাবার ও নাশতা থাকবে। করের টাকা বাদে প্রশিক্ষকেরা তিন দিনে আড়াই হাজার টাকা পাবেন।

ঢাকা উত্তর সিটির পরিবহন বিভাগের মহাব্যবস্থাপক আবদুল্লাহ আল মাসুদ বলেন, প্রথম দফায় ২০০ জনের মধ্যে ঢাকা উত্তর সিটিতে ১০০ জন এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে ১০০ জনের প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। দুই সিটিতেই ৫টি করে মোট ১০টি অঞ্চলে এ প্রশিক্ষণ একযোগে চলবে। প্রতিটি দলে ২০ জন করে থাকবেন। ঢাকা উত্তর সিটির গুলশান নগর ভবন, উত্তরায় ডিএনসিসির অঞ্চল-১–এর কার্যালয়, মহাখালীতে অঞ্চল-৩–এর কার্যালয়, মিরপুরে অঞ্চল–২ ও ৪–এর কার্যালয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে।

ঢাকা উত্তর সিটির সূত্রে জানা যায়, প্রশিক্ষণের পর ৩০০ প্রশিক্ষকের প্রত্যেককে একটি করে ওয়েবক্যামসহ ল্যাপটপ দেওয়া হবে। এগুলো দিয়ে পরবর্তী সময়ে প্রশিক্ষকেরা রিকশাচালকদের প্রশিক্ষণ দেবেন এবং তাঁদের তথ্য সংগ্রহের কাজ করবেন। এ জন্য মন্ত্রণালয় থেকে ইতিমধ্যে অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া মাস্টার ট্রেইনারদের প্রশিক্ষণের জন্য ১০টি ব্যাটারিচালিত রিকশা কিনতে অর্থ বরাদ্দ দিয়েছে মন্ত্রণালয়।

নগর পরিকল্পনাবিদদের সংগঠন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, বিশ্বের অনেক দেশেই তরুণদের বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় কাজে যুক্ত করা হয়ে থাকে। গণ-অভ্যুত্থানের পর দেশেও তরুণদের এমন কাজে যুক্ত করার বিষয়টি ভালো। তবে মাথায় রাখতে হবে, রিকশাচালকদের প্রশিক্ষণের বিষয়টি কারিগরি বিষয়, যা সড়ক নিরাপত্তার সঙ্গে জড়িত। রিকশাচালকেরা তাঁদের কাছে শিখবেন, নগরবাসীর উপকার হবে। প্রশিক্ষণ নিয়ে ঠিকমতো শেখাতে না পারলে সড়ক নিরাপত্তায় প্রভাব পড়বে। তাই যথাযথ প্রশিক্ষণ দিতে হবে। পাশাপাশি তরুণেরা দীর্ঘ মেয়াদে যুক্ত থাকার বিষয়টি নিশ্চিত না হলে, কিছুদিন পর খুঁজে না পাওয়া গেলে, আগ্রহ হারালে রাষ্ট্রের অর্থের অপচয় হবে। রিকশাচালকদের প্রশিক্ষক তৈরিতে তিন দিনের প্রশিক্ষণ পর্যাপ্ত নয় বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.