ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে সংস্কার প্রস্তাব জমা দিয়েছে নির্বাচন, দুদক, পুলিশ ও সংবিধান সংস্কারে গঠিত কমিশন। বুধবার (১৫ জানুয়ারি) তেজগাঁওয়ে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে কমিশন প্রধানরা এসব প্রতিবেদন জমা দেন।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম জানিয়েছেন, প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে প্রতিবেদন জমা হয়েছে। বিকেল ৩টায় সংবাদ সম্মেলন করে এ বিষয়ে গণমাধ্যমকে সরকারের পক্ষ থেকে বিস্তারিত জানানোর কথা রয়েছে।
দেখে নেওয়া যাক চার সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে যেসব সুপারিশ থাকছে
নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন
নির্বাচন ব্যবস্থাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে নির্বাচনি আইন পরিবর্তনের পাশাপাশি কিছু প্রাতিষ্ঠানিক পরিবর্তনের সুপারিশ থাকছে। অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে একটি কার্যকর ব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্যে একগুচ্ছ সুপারিশ রাখতে পারেন বদিউল আলম মজুমদারের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন।
নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় যুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর ইসির নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করা, প্রধান নির্বাচন কমিশনার নিয়োগে আইনে সংশোধন, ইসির ক্ষমতা বাড়ানো ও জবাবদিহি তৈরি, নির্বাচনি শাস্তি ও ব্যবস্থা নেওয়ার বিধানগুলো কিছু ক্ষেত্রে আরও সুনির্দিষ্ট করা, হলফনামার ছকে পরিবর্তন, হলফনামার তথ্য যাচাই বাধ্যতামূলক করার কথা থাকছে সুপারিশে। পাশাপাশি নির্বাচনে ‘না’ ভোটের সুযোগ যুক্ত করা, সংরক্ষিত নারী আসনে সরাসরি ভোটের ব্যবস্থা করা, রাজনৈতিক দলের প্রার্থী মনোনয়ন পদ্ধতিতে কিছু পরিবর্তন আনা, ন্যূনতম ভোটার ছাড়া নির্বাচন বাতিল, জাতীয় পরিচয়পত্রের সেবা ইসির অধীনে রাখা, দুই কক্ষের পার্লামেন্ট ও সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থা প্রণয়নসহ বেশ কিছু সুপারিশ থাকছে।
জানতে চাইলে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সদস্য আব্দুল আলীম বলেন, ‘আইনের পাশাপাশি নির্বাচিইন আচরণবিধিতেও স্পষ্ট পরিবর্তন এনে কঠোর তদারকির সুপারিশ করার সম্ভাবনা রয়েছে প্রতিবেদনে। এতে অন্তত এক ডজন অধ্যায় থাকছে। আদালতের রায়ে গণভোট ও তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা ফেরার পথ তো খুলছে। বিদ্যমান নির্বাচন পদ্ধতির পাশাপাশি সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতি সুপারিশের কথাও ভাবছি আমরা। দুই কক্ষের পার্লামেন্টের কথাও বিবেচনায় রয়েছে।’
দুদক সংস্কার কমিশন
দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদককে স্বাধীন ও কার্যকর করতে কী কী পদক্ষেপ নেওয়া যায়, সে বিষয়ে ৪৭ দফা সুপারিশসহ প্রতিবেদন দিচ্ছে এ সংস্কার কমিশন।
কমিশন প্রধান ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘মোটা দাগে দুই ধরনের সংস্কারের সুপারিশ রেখে প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। একটিতে দুর্নীতি দমন কমিশনের সরাসরি সংস্কার; আরেকটিতে রয়েছে এই সংস্কার কার্যকর করার জন্য পুরো রাষ্ট্রকাঠামোয় পরিবর্তন আনার সুপারিশ।’
পুলিশ সংস্কার কমিশন
সাবেক সচিব সফর রাজ হোসেনের নেতৃত্বাধীন এ কমিশন পুলিশ সংস্কারের জন্য সাধারণ মানুষের মত নিয়েছিল। সেই সমীক্ষায় অংশ নেওয়া ৮৮ দশমিক ৭ শতাংশ মানুষ এ বাহিনীকে ‘রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত’ করার ওপর জোর দেন। বাহিনীতে নিয়োগ, বদলি, বেতনভাতা ও পদোন্নতি, বৈষম্য নিরসনসহ নানা বিষয়ে সুপারিশ থাকতে পারে।
জুলাই-অগাস্টে হতাহতের জন্য দায়ী পুলিশ কর্মকর্তাদের শাস্তির সুপারিশ এবং পুলিশ যেন রাজনৈতিক দলের বাহিনীতে পরিণত না হয় ও বল প্রয়োগ-সংক্রান্ত বিষয়েও সুপারিশ থাকতে পারে পুলিশ সংস্কারে।
সংবিধান সংস্কার কমিশন
সংবিধান সংস্কার কমিশন এক গুচ্ছ সুপারিশ করতে যাচ্ছে, যার মূল লক্ষ্য রাষ্ট্র ও সরকারে ক্ষমতার ভারসাম্য আনা এবং প্রাতিষ্ঠানিক বিকেন্দ্রীকরণ। স্থানীয় সরকার শক্তিশালী করা, দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদ, নারী আসন বাড়ানো ও তাদের সরাসরি নির্বাচনসহ নির্বাহী বিভাগ, বিচার বিভাগ ও আইন সভা নিয়ে একগুচ্ছ সুপারিশ থাকবে প্রতিবেদনে।
কমিশন প্রধান অধ্যাপক আলী রীয়াজ জানিয়েছেন, ‘এক ব্যক্তির দুইবারের বেশি প্রধানমন্ত্রিত্ব নয়, ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতায় ভারসাম্য আনা, সাংবিধানিক সংস্থা বাড়ানো ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা বাড়ানোসহ সুনির্দিষ্ট কিছু সুপারিশ থাকছে কমিশনের প্রতিবদনে।’
তিনি বলেন, ‘এককেন্দ্রীকরণ থেকে ক্ষমতার ভারসাম্য তৈরির প্রস্তাব থাকছে। প্রাতিষ্ঠানিক বিকেন্দ্রীকরণের চেষ্টা থাকবে সুপারিশে। মূল কথা হচ্ছে আমরা এককেন্দ্রিকতা থেকে বেরোতে চাই জবাবদিহিমূলক একটা ব্যবস্থা তৈরি করতে।’
প্রসঙ্গত, ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। পরে একই মাসে দায়িত্ব গ্রহণের পর দুর্বল গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করতে এবং জনমালিকানা, জবাবদিহিতা ও জনকল্যাণ নিশ্চিত করার জন্য ১৫টি সংস্কার কমিশন গঠন করে অন্তর্বর্তী সরকার।
এর মধ্যে সংবিধান, নির্বাচনী ব্যবস্থা, পুলিশ, বিচার বিভাগ, জনপ্রশাসন এবং দুদকের সংস্কারের জন্য প্রথম ছয়টি কমিশন ৩ অক্টোবর গঠিত হয়। প্রতিবেদন জমা দেওয়ার জন্য ৯০ দিন সময় দেওয়া হয়েছিল তাদের। পরে বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের সময়সীমা ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত এবং বাকি পাঁচটি কমিশনের সময়সীমা ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত বাড়ানো হয়।