চার কিশোরীর ধর্ষণ, হত্যার রহস্য উন্মোচিত হয়নি ৩৩ বছরেও

0
19
‘দ্য ইয়োগার্ট শপ মার্ডারস’ তথ্যচিত্রের দৃশ্য। আইএমডিবি ‘

১৯৯১ সালের ৬ ডিসেম্বরের রাত। টেক্সাসের অস্টিন শহরের ব্যস্ত এক বাণিজ্যিক এলাকায় ছোট্ট এক দইয়ের দোকান। সেখানেই ঘটে গেল যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড। দোকান থেকে উদ্ধার হলো চার কিশোরীর ক্ষতবিক্ষত মরদেহ। ১৩ বছরের অ্যামি এয়ারস, ১৫ বছরের সারা হারবিসন, ১৭ বছরের জেনিফার হারবিসন ও এলিজা থমাসকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছিল নির্মমভাবে। তাদের গলা টিপে ধরা হয়েছিল, শরীর বেঁধে রাখা হয়েছিল দড়ি দিয়ে, মাথায় গুলি করা হয়েছিল—এরপর প্রমাণ নষ্ট করতে দোকানেই আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়।

তিন দশকের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও এই হত্যাকাণ্ড আজও অস্টিনবাসীর মনে এক দুঃসহ স্মৃতি। এইচবিও তাই চার পর্বের তথ্যচিত্র ‘দ্য ইয়োগার্ট শপ মার্ডারস’ নির্মাণ করেছে, যেখানে আর্কাইভ ফুটেজ, তদন্তকারীদের বক্তব্য, আর নিহত ব্যক্তিদের পরিবার-বন্ধুদের সাক্ষাৎকারে ফুটে উঠেছে শোক, ক্ষোভ আর অসহায়তার চিত্র।
প্রথম পর্বেই নিহত অ্যামি এয়ারসের বাবা বব এয়ারস বলেন, ‘৩০ বছর, ৭ মাস, ৫ দিন হয়ে গেল—তবু আজও বিশ্বাস করতে পারি না।’ প্রতি রবিবার রাত ১০টায় এইচবিওতে সম্প্রচারিত হচ্ছে এই তথ্যচিত্র সিরিজ। যারা ‘ট্রু ক্রাইম’ ধরনের তথ্যচিত্রে আগ্রহী, তাঁদের কাছে এটি দেখা, নিঃসন্দেহে এক ভয়ংকর আর হৃদয়স্পর্শী অভিজ্ঞতা।

ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা আগুন নেভানোর পর ভেতরে যা দেখেছিলেন, তা বর্ণনা করতে গিয়ে সেই সময়ের একজন পুলিশ কর্মকর্তা বলেন—‘চারদিকে ধোঁয়া, ভেজা সিলিং, গলে যাওয়া আসবাবের মধ্যেই দেখা যাচ্ছিল লাশগুলো। তিনটি একসঙ্গে, আরেকটি একটু আলাদা।’

এই হত্যাকাণ্ডে অস্টিন শহর শোকে স্তব্ধ হয়ে যায়। নিহত কিশোরীদের পরিবার ও স্থানীয় ব্যক্তিরা ন্যায়বিচারের দাবিতে মিছিল করেছিলেন, শহরের রাস্তায় টাঙানো হয়েছিল পোস্টার ও বিলবোর্ড, স্থানীয় সংগীতশিল্পীরা গান লিখেছিলেন তাঁদের স্মরণে। তবু ৩৩ বছর পরেও রহস্যের জট খোলেনি।
আলোচিত এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে এইচবিওর নতুন তথ্যচিত্র ‘দ্য ইয়োগার্ট শপ মার্ডারস’। গত ৩ আগস্ট মুক্তি পেয়েছে চার পর্বের তথ্যচিত্রটি। মুক্তির পর থেকে সমালোচকদের ব্যাপক প্রশংসা পেয়েছে তথ্যচিত্রটি।

‘দ্য ইয়োগার্ট শপ মার্ডারস’ পরিচালনা করেছেন মার্গারেট ব্রাউন। তবে ব্রাউনের আগে আরও একজন নির্মাতা এই ঘটনাকে তথ্যচিত্রে রূপ দিতে চেয়েছিলেন। প্রায় এক দশক আগে চলচ্চিত্র নির্মাতা ক্লেয়ার হুই ঘটনাটির ওপর কাজ শুরু করেছিলেন। কিন্তু কিশোরীদের ওপর চালানো নির্যাতনের ভয়াবহতা ও তদন্তপ্রক্রিয়ার অন্ধকার তাঁকে এতটাই মানসিকভাবে আঘাত করেছিল যে তিনি পুরো প্রজেক্ট ছেড়ে দেন, এমনকি চলচ্চিত্র ক্যারিয়ারও ত্যাগ করেন। তাঁর সঙ্গে কাজ করা কয়েকজন ক্রু সদস্যকেও মানসিক আঘাত সামলাতে থেরাপির আশ্রয় নিতে হয়েছিল।

তদন্ত ও ভেঙে পড়া বিচারপ্রক্রিয়া
ঘটনার অল্প কিছুদিন পরই মেক্সিকোয় দুজনকে আটক করা হলেও তাঁরা জোর করে স্বীকারোক্তি নেওয়ার অভিযোগ করলে মামলা এগোয়নি। ১৯৯৯ সালে অস্টিন পুলিশ আবারও চার তরুণকে গ্রেপ্তার করে—রবার্ট স্প্রিংস্টিন জুনিয়র, মাইকেল স্কট, মরিস পিয়ার্স ও ফরেস্ট ওয়েলবর্ন।

‘দ্য ইয়োগার্ট শপ মার্ডারস’ তথ্যচিত্রের দৃশ্য। আইএমডিবি
‘দ্য ইয়োগার্ট শপ মার্ডারস’ তথ্যচিত্রের দৃশ্য। আইএমডিবি

২০০১ সালে স্প্রিংস্টিন ও ২০০২ সালে স্কটের বিচার হয়। দুজনের বিরুদ্ধেই মূল প্রমাণ ছিল তাঁদের স্বীকারোক্তি, যেখানে বলা হয় দোকান ডাকাতির পরিকল্পনা করতে গিয়েই চার কিশোরীকে হত্যা করা হয়। আদালত তাঁদের দোষী সাব্যস্ত করেন—স্প্রিংস্টিনকে দেওয়া হয় মৃত্যুদণ্ড, স্কট পান যাবজ্জীবন।

কিন্তু বছর কয়েকের মধ্যেই সবকিছু পাল্টে যায়। আপিল আদালত জানান, তাঁদের ন্যায্যভাবে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেওয়া হয়নি, আর স্বীকারোক্তি আদায় করা হয়েছিল জোরপূর্বক। ২০০৯ সালে মামলার সব আসামিকে মুক্তি দেওয়া হয়। তারপর থেকে নতুন করে আর কাউকে অভিযুক্ত করা হয়নি। ফলে এই নৃশংস হত্যাকাণ্ড রয়ে গেছে অমীমাংসিত এক রহস্য হিসেবে।

সিরিজের নির্মাতা ব্রাউন শুরু থেকেই ঠিক করেছিলেন তিনি ধীর লয়ের একটি সিরিজ বানাবেন, যেখানে উঠে আসবে স্বজন হারানো পরিবারগুলোর বেদনা; তাদের শোকস্মৃতি আঁকড়ে ধরেই এগোবে গল্প। নির্মাতার নিজেরও অস্টিনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগ, পরিচিত অনেকেই নিহত মেয়েদের সহপাঠী বা বন্ধু ছিলেন। তাই ঘটনাটি তাঁর কাছে নিছক অপরাধ কাহিনি নয়, বরং নিজের এলকার এক গভীর ক্ষত।

নতুন আশার আলো

পরিবারগুলো দীর্ঘ ৩৪ বছর ধরে সান্ত্বনার অপেক্ষায়। তবে ২০১৭ সালে অস্টিন পুলিশ ডিএনএ পরীক্ষা করে একটি সম্ভাব্য মিল পায়। এফবিআই সেই ব্যক্তির নাম জানাতে অস্বীকার করে। এটি হত্যাকাণ্ড সমাধানের দিকে একটি বড় অগ্রগতি এবং ডিএনএ প্রমাণের মাধ্যমে আসল সত্য উদ্‌ঘাটনের সম্ভাবনা আরও বেড়ে যায়। পরিবারগুলো এখনো আশা করছে, একদিন তারা জানতে পারবে, কে তাদের প্রিয়জনদের হত্যা করেছিল। যদিও ট্রমা ও শোক হয়তো কখনোই পুরোপুরি মিলবে না, সত্য উদ্‌ঘাটন পরিবারগুলোকে কিছুটা শান্তি দিতে পারে।

২০২২ সালে এই কেসের দায়িত্ব নেওয়া গোয়েন্দা ড্যান জ্যাকসন ইউএসএ টুডেকে জানান, আগুন ও আগুন নেভানোর জন্য ব্যবহৃত পানি কেসটির সমাধান কঠিন করেছে। তবু তিনি আশা হারাননি।

জ্যাকসন বলেন, ‘যদি আমি মনে করতাম, আমি এটি সমাধান করতে পারব না, তবে প্রতিদিনই এটা নিয়ে কাজ করব কেন? নতুন প্রযুক্তি ও তথ্যের সাহায্যে আমি কম প্রমাণ দিয়েও অনেক কিছু করতে পারি। ফরেনসিকসে অগ্রগতি কয়েক বছর আগের তুলনায় আলোকবর্ষের সমান।’

জ্যাকসন আরও যোগ করেন, ‘শুরুতে আমাদের অনেক বেশি ডিএনএ নমুনা প্রয়োজন ছিল। তখন আমরা তা পর্যন্ত পৌঁছাতে পারিনি। কিন্তু এখন প্রয়োজনীয় পরিমাণ অনেক কম। আমি আত্মবিশ্বাসী, আমি এই হত্যাকাণ্ড সমাধান করতে পারব।’

তথ্যচিত্রে অতীতের দগদগে ক্ষত উন্মোচন
তিন দশকের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও এই হত্যাকাণ্ড আজও অস্টিনবাসীর মনে এক দুঃসহ স্মৃতি। এইচবিও তাই চার পর্বের তথ্যচিত্র ‘দ্য ইয়োগার্ট শপ মার্ডারস’ নির্মাণ করেছে, যেখানে আর্কাইভ ফুটেজ, তদন্তকারীদের বক্তব্য, আর নিহত ব্যক্তিদের পরিবার-বন্ধুদের সাক্ষাৎকারে ফুটে উঠেছে শোক, ক্ষোভ আর অসহায়তার চিত্র।
প্রথম পর্বেই নিহত অ্যামি এয়ারসের বাবা বব এয়ারস বলেন, ‘৩০ বছর, ৭ মাস, ৫ দিন হয়ে গেল—তবু আজও বিশ্বাস করতে পারি না।’ প্রতি রবিবার রাত ১০টায় এইচবিওতে সম্প্রচারিত হচ্ছে এই তথ্যচিত্র সিরিজ। যারা ‘ট্রু ক্রাইম’ ধরনের তথ্যচিত্রে আগ্রহী, তাঁদের কাছে এটি দেখা, নিঃসন্দেহে এক ভয়ংকর আর হৃদয়স্পর্শী অভিজ্ঞতা।

‘দ্য ইয়োগার্ট শপ মার্ডারস’ তথ্যচিত্রের পোস্টার। আইএমডিবি
‘দ্য ইয়োগার্ট শপ মার্ডারস’ তথ্যচিত্রের পোস্টার। আইএমডিবি

তথ্যচিত্র বানাতে গিয়ে ট্রমায়
‘দ্য ইয়োগার্ট শপ মার্ডারস’ পরিচালনা করেছেন মার্গারেট ব্রাউন। তবে ব্রাউনের আগে আরও একজন নির্মাতা এই ঘটনাকে তথ্যচিত্রে রূপ দিতে চেয়েছিলেন। প্রায় এক দশক আগে চলচ্চিত্র নির্মাতা ক্লেয়ার হুই ঘটনাটির ওপর কাজ শুরু করেছিলেন। কিন্তু কিশোরীদের ওপর চালানো নির্যাতনের ভয়াবহতা ও তদন্তপ্রক্রিয়ার অন্ধকার তাঁকে এতটাই মানসিকভাবে আঘাত করেছিল যে তিনি পুরো প্রজেক্ট ছেড়ে দেন, এমনকি চলচ্চিত্র ক্যারিয়ারও ত্যাগ করেন। তাঁর সঙ্গে কাজ করা কয়েকজন ক্রু সদস্যকেও মানসিক আঘাত সামলাতে থেরাপির আশ্রয় নিতে হয়েছিল।
সিরিজের নির্মাতা ব্রাউন শুরু থেকেই ঠিক করেছিলেন তিনি ধীর লয়ের একটি সিরিজ বানাবেন, যেখানে উঠে আসবে স্বজন হারানো পরিবারগুলোর বেদনা; তাদের শোকস্মৃতি আঁকড়ে ধরেই এগোবে গল্প। নির্মাতার নিজেরও অস্টিনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগ, পরিচিত অনেকেই নিহত মেয়েদের সহপাঠী বা বন্ধু ছিলেন। তাই ঘটনাটি তাঁর কাছে নিছক অপরাধ কাহিনি নয়, বরং নিজের এলকার এক গভীর ক্ষত।

‘ডেভিড লিঞ্চ’-এর আবহ
পুরোনো আর্কাইভাল ফুটেজ দেখে ব্রাউন মনে করেছিলেন, এই গল্প যেন ‘টুইন পিকস’-এর মতোই ভৌতিক এক শহরের প্রতিচ্ছবি। তথ্যচিত্রের জন্য নেওয়া প্রথম সাক্ষাৎকারেই ব্রাউন বুঝে যান তিনি সাধারণ কোনো অপরাধচিত্র বানাচ্ছেন না। অ্যামি আয়ার্সের ভাই শন বলেছিলেন, ‘সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বোনের কণ্ঠ আর মুখ মনে করতে পারছেন না—যেন স্মৃতি ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে।’ সেই হৃদয়বিদারক স্বীকারোক্তি নির্মাতাকে আরও দায়িত্বশীল করে তোলে।
এই তথ্যচিত্রে দেখা যায়, কীভাবে গল্প বলা কখনো শোক নিরাময়ের পথ, আবার কখনো তা শোষণেও রূপ নেয়। এলিজা থমাসের ছোট বোন সোনোরা বলেন, এই ‘ট্রু ক্রাইম’ ঘরানা শুধু কৌতূহলের খোরাক নয়, বরং ভুক্তভোগীদের জন্যও এক মঞ্চ—যেখানে তারা এমন এক গল্প বলতে পারে, যা অন্য কোথাও শোনার জায়গা পায় না।
নির্মাতা মনে করিয়ে দেন, এই ঘরানার প্রধান দর্শক নারীরা—সম্ভবত নিজেদের ভয় আর আশঙ্কাকে মনের ভেতর থেকে পড়াশোনা করার এক উপায় হিসেবেই তারা এ ধরনের কাহিনির দিকে ঝোঁকে।

স্মৃতি: আশ্রয় না ফাঁদ?
সিরিজের ভয়াবহ জেরা দৃশ্যগুলো দেখা যায়, কীভাবে পুলিশ সন্দেহভাজনদের কাছ থেকে মিথ্যা স্বীকারোক্তি আদায় করেছিল। পরিবারগুলো যেখানে স্মৃতি আঁকড়ে ধরে প্রিয়জনকে জীবিত রাখার চেষ্টা করছে, সেখানে আইনের ভুল প্রক্রিয়া স্মৃতিকেই বানিয়েছে ভ্রান্ত ও বিপজ্জনক এক অস্ত্র।
ব্রাউনের ভাষায়, ‘স্মৃতি কখনো আমাদের বাঁচায়, আবার কখনো ফাঁদে ফেলে।’

তথ্যসূত্র: ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, দ্য গার্ডিয়ান

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.